বাঙালী জাতির একটি অংশ কী উত্তর ভারতীয় ঠগিগোষ্ঠীর বংশধর ?



                         বাঙালীরা  কি  জেনেটিক্যালি  ব্যামিশ্র  জাতিতে   পরিণত  হয়েছে  ? 
                 এবং  ১২৯০  সালে  ভারতের  উত্তর  প্রদেশ  থেকে  বাংলায়  নির্বাসিত
                 ঠগিগোষ্ঠীর  বংশধারা  বা  জিন  বাঙালীদের  বংশধারায়  বা  জিনে  মিশে
                 গিয়ে  একটা  নতুন  শংকর  গোষ্ঠীর  সৃষ্টি  হয়েছে  অরিজিন্যাল
                  বাঙালীদের  মধ্যে  ৷


          বাঙালী  জাতির  মূল  অরিজিন  এখনও  প্রমাণিতভাবে  স্পষ্ট  নয়  বলে  সংশ্লিষ্টরা  বলেন  ৷  তবে  ঐ  সব  আলোচনায়  না  গিয়ে  মোটা  মাপে  এতটুকু  বলা  যায়  যে ,  ভারতীয়  উপ-মহাদেশের  বর্তমান  বাংলাদেশ , পশ্চিমবঙ্গ  এবং  ত্রিপুরা ,  আসম ,  ঝাড়খন্ড ,  ও  আন্দামান  নিকোবর  দ্বীপপুঞ্জের  বসবাসকারী  মানব  সম্প্রদায়কে  বাঙালী  জাতি  হিসেবে  অবিহিত  করা  হয়  ৷  বাঙালীরা  এই  অঞ্চলে  অন্ততঃ  গত  চার  হাজার  বছর  ধরে  বসবাস  করতেছেন  ৷

         এদের  ভাষা  বাংলা  ,  যা  ইন্দ্রো-ইউরোপীয়  ভাষা  গোষ্ঠীর  পূর্ব-ইন্দো  আর্য  বিভাগের  একটি  ভাষা  ৷

          নৃতাত্বিক  ভাবে  বাঙালীরা  একদিকে  যেমন  ওড়িয়া ,  আসামী , বিহারী  ও  পূর্ব-ভারতীয়  ভাষাভাষী  গোষ্ঠীর  নিকট  আত্মিয়  ,  তেমনই  বাঙালীদের  কিছু  অংশ  মণ্ডা , প্রোটা-অস্ট্রলয়েড , তিব্বতী , বর্মী  অষ্ট্রো-এশীয়  এবং  দ্রাবিড়  গোষ্ঠীর  বংশধারার  সঙ্গে  মিশে  আছে  ৷ 

          কিন্তু  উত্তর-ভারতীয়  অংশে  বসবাসকারী  মানুষের  সঙ্গে  অরিজিন্যাল  বাঙালীদের  কোনো  বংশধারা বা জেনেটিক্যালি  কোনো  মিল  আছে  বলে  এখনও  কোনো  প্রমান বা  তথ্য  পাওয়া  যায়  নাই  ৷ তবে  ১২৯০  সালের  দিকে  উত্তর  ভারত  থেকে  তখনকার  বৃহত্তর  বাংলায়  কিছু  লোক ,  যাদেরকে  ঠগি  গোষ্ঠীর  লোক  বলে  চিহ্নিত  করা  হয়েছে  ,  তাদের  একটি  মারাত্মক  অপরাধী  অংশকে  বাংলায়  প্রেরণ  করা  হয়ে  ছিল  বলে  ইতিহাস  থেকে তথ্য   পাওয়া  যায়  ৷  দিল্লীকে  ঠগিদের থেকে    অপরাধমূক্ত  করতে  এদেরকে  ভাটির  দেশ  বাংলায়  শাস্তিস্বরূপ তখনকার  সুলতান  প্রেরণ  করেছিলেন বলে  জানা  যায়  ৷  অবশ্য  ভারতের  উত্তর  প্রদেশে  এখন  অনেক  বাঙালী বসবাস  করেন  ৷  তবে  তারা  কোনোভাবেই  ঠগিদের  বংশধর  নয়  ৷  ঐতিহাসিক  ডঃ অতুল  সুরের  মতে  বাসাংসি   ,  যাকে  এঅঞ্চলে  পক্ষী  বলা  হয়  ,  এই  অঞ্চলে  বসবারকারী  মানুষের  টোটেম  ছিল  তাহা ৷  তবে  আর্যদের  ভারত  আগমনের  পর  বাংলা  ও  বিহার  অঞ্চল  জুড়ে  মাগধ  রাজ্যের  বিস্তার  ঘটে  ৷

          ইতিহাস   থেকে  প্রাপ্ত  তথ্য  অনুসারে  ঠগি  প্রজাতির  মানুষগুলোর  উৎপত্তি  হয়েছিল  উত্তর  ভারতে  ৷  ঠগিরা  উত্তর  ভারতে  বহু  শতাব্দী  ধরে  বংশ  পরস্পর  তাদের  এই  অমানুষিক  কর্মকাণ্ড  চালাত  এবং  বিষয়টি  অত্যান্ত  গোপনীয়ভাবে  চালাতে  সক্ষম  ছিল  ৷  তবুও  নিশ্চয়  সমাজের  কিছু  সুবিধাভোগী  লোকের  সাহায্য  ও  সহায়তা  অর্থের  বিনিময়ে  আদায়  করেই   তারা  এই  অমানুষিক  হত্যাকান্ড ও  লুণ্ঠণ   যুগের  পর  যুগব্যাপি  চালাতে  পেরেছে  ৷  অনেকটা  বর্তমান  বাংলাদেশের    মত  , গডফাদারদের  ছত্রছায়ায়  থেকে  যে  রকম  এখন  সন্ত্রাসীরা  ও  ভাড়াটিয়ে  খুনিরা  অর্থের  বিনিময়ে  মানুষ  হত্যা  বা  গুম  করে  থাকে  ৷

          তবে  ১২৯০  সালের  দিকে  দিল্লীর  আশেপাশে হঠাৎ  করে  ঠগিদের  কার্যক্রম  অতিরিক্তভাবে  বেড়ে  যায়  ৷  ব্যাপারটি  সুলতানের  নজরে  আনা  হয়  ৷  সুলতানের  নির্দেশে  ঠগিদের  প্রায়  সবাইকে  ধরা  হয়  তখন  ৷   তবে কিছু  ঠগি  এই  পেশা  ছেড়ে  অন্যত্র  পালিয়ে  যেতে  সমর্থ  হয়  এবং  অন্য  পেশা  গ্রহণ  করেছিল  ৷  এর  পরও  প্রায়  একহাজার জন  ঠগিকে  দিল্লীর  দরবারে  শাস্তির  জন্যে  প্রেরণ  করা  হয়  ৷  দিল্লীতে  সুলতানের পরিষদবর্গ  অপরাধীদের  মৃত্যুদণ্ড  প্রদানের  সুপারিশ  করেন  ৷   কিন্তু  সুলতান  ঠগিদের  মৃত্যুদণ্ড  না  দিয়ে  নির্বাসিত  করেন  অনেকটা  দ্বিপান্তরে  প্রেরণের মত  ৷  তখন  বৃহত্তর  বাংলা  অঞ্চলকে  দিল্লীবাসী  ভাটির  দেশ  হিসেবে  অবিহিত  করত  ৷  সুলতান  অপরাধী  ঠগীদের ,  যাদের  সংখ্যা  প্রায়  হাজারেরও  অধিক  ছিল  তাদের  সবাইকে  ভাটির  দেশ  তথা  বাংলা  অঞ্চলে  প্রহরী  বেষ্টিত  নৌকা  যোগে   প্রেরণ  করেন  ৷  সুলতানের  মূল  উদ্দেশ্য  ছিল  দিল্লীকে  ঠগি  মুক্ত  করা এবং  তাদের  গোষ্ঠকে  বিচ্ছিন্ন  করে  ফেলা ৷ যাতে তারা   দ্বিপান্তরের  এবং  শাস্তির  ভয়ে  ভবিষ্যতে  কেউ  যেন  আর  দিল্লী  বা  তার  আশে  পাশে  বিশৃঙ্খলা  সৃষ্টি  করতে  না  পারে  এবং  এই  ঠগি  পেশা  পরিবর্তনে  বাধ্য  হয়  ৷

          বাংলা  অঞ্চলে  পৌঁছেই  ঠগি  গোষ্ঠীরা  বাংলার  জলে  , স্থলে  ,  মাঠে ,  ঘাটে  সব  স্থানে  যে  যেখানে  সুবিধা  পেয়েছে  সেখানে  ছড়িয়ে  পড়েছে   এবং  অপেক্ষাকৃত  কম  চালাক  বাংলার  স্থানীয়  অধিবাসীদের  সঙ্গে  মিলে  মিশে  বসবাস  আরম্ভ  করে  দেয়  ৷  এবং  স্থানীয়দেরকে  বিয়ে  সাদি  করে  তাদের  বংশধরের  সংখ্যা  বৃদ্ধি  করা  আরম্ভ  করে    ৷  

          কিন্তু  কিছুদিনের  মধ্যেই ঠগিরা নতুন  অবস্থা  ও  পরিবেশের  সঙ্গে  খাপ  খাইয়ে  নিতে  সক্ষম  হয়  ৷  আর  এই  অঞ্চলে  নতুন  ভাবে  তাদের  পূর্বেকার ঠগি  কার্যক্রম  অর্থাৎ  মানুষকে  হত্যা  করে  লাশ  গুম  করে  মানুষের  সবকিছু  লুট  নেয়া  আরম্ভ  করে  ৷   বাংলা  অঞ্চলে  কয়েক  শতাব্দী  জুড়ে  তাদের  এই  অমানুষিক  কাজ  চালিয়ে  গিয়েছে  ৷  

           অন্যদিকে  আবার  ঠগিরা  হিন্দু -  মুসলিম  ও  শিখ  ধর্মে   বিশ্বাসী  হলেও  তারা  সবাই  হিন্দু  ধর্মের  ভবানী  বা  কালীর  উপাসক  ছিল  ৷  ঠগিরা  বিশ্বাস  করত যে ভবানী  বা  কালী  তাদেরকে  সব  ধরণের  বিপদ  আপদ থেকে  মুক্ত করেন  এবং  তাদেরকে  নিত্য  নতুন  শিকারের সন্ধান দিয়ে  থাকেন  ৷   তাই ঠগিরা  কালীর  উপাসনা  করত  প্রাণভরে  ৷  ভিন্ন  ভিন্ন  ধর্মে  বিশ্বাসী  হলেও  এই  কাজটি  সবাই  সম্মিলিতভাবে  পালন  করত  ৷ বর্তমান  পশ্চিমবাংলার  গঙ্গা  নদীর  ধারে  অবস্থিত    কালীঘাট  মন্দির  হয়ে  উঠেছিল  তাদের  এই  অমানুষিক  হত্যা  কাণ্ডের  এবং  লুণ্ঠনের  মূল  ব্যবসা  কেন্দ্র  ৷ 

          ব্রিটিশ  শাসিত  ভারতের   বাংলা  এবং  এর  আশে  পাশের  অঞ্চলে  দীর্ঘদিন  ধরে  ঠগিদের মানুষ  হত্যা  করে  লাশ  গুম  করে  সর্বস্ব  লুটে  নেয়ার  কার্যক্রম  চালুছিল  ৷  কোনো  এক  পর্যায়ে  তা  অতিরিক্তভাবে  বৃদ্ধি  পায়  ৷  সাধারণ  মানুষ  অতিষ্ট  হয়ে  ওঠে যখন  এদের  আক্রমণ  তীব্র  হয়ে  দেখা  দেয় সর্বসাধারণের  মাঝে ৷  এই  সংবাদ  ব্রিটিশ  শাসকদের  কাছে  ও  পৌছে  যায়  ৷ তাই ১৮৩০  সালে  ভারতে  তখনকার  একজন  ব্রিটিশ  প্রশাসককে    জনস্বার্থে  ঠগিদের  উৎপাত  চিরতরে  বন্ধ  করতে  নির্দেশ  প্রদান  করেন    ৷   এবং  এক  ব্রিটিশ  প্রশাসক  উইলিয়াম  হেনরি  শ্লীম্যানকে  ঠগিদের  দমন  করতে  দায়িত্ব  দেয়া  হয়  ৷  তিনি  অত্যান্ত  দক্ষতার  সঙ্গে  ঠগিদের  প্রায়  সবাইকে  ধরে  আইনের  আওতায়  এনে  মৃত্যুদণ্ড ,  যাবজ্জীন  কারাদণ্ড  ও  দ্বীপান্তরের  ব্যবস্থা  করেন  ৷  যারা  পালাতে  সক্ষম  হয়ে  ছিল  তারাও  ভয়ে  এই  মানুষ  খুনের  পেশা  বা  তাদের  ভাষায়  এই  ব্যবসা  পরিবর্তন  করতে  বাধ্য  হয়ে  অন্য  পেশা  গ্রহণ  করে  ৷  ফলে  তখনকার  বাংলা  অঞ্চল  ঠগি  মুক্ত  অঞ্চল  হিসেবে  ঘোষিত  হয়  এবং  দীর্ঘদিন  তা  অব্যাহত  থাকে  ৷

          বর্তমান  বাংলাদেশের  খুন , গুম  , ছিনতাই  , অজ্ঞানপার্ঠী  ও  মলমপার্ঠীর  কার্যক্রম সহ  অন্যান্য  অমানুষিক  কার্যক্রম   যা  সমাজে  ব্যাপকভাবে  চালু  হয়েছে  তাহা  বিবেচনায়  নিয়ে  একটু  চিন্তা  ভাবনা  করে  তা  বিশ্লেষণ  করলে   দেখা  যাবে  যে   , শাস্তি  প্রাপ্ত  বা  শাস্তির  ভয়ে পেশা  পরিবর্তনকারী  ঠগিদের  ডিএনএ  বা  বংশধারা  বাংলাদেশে  জন্মগ্রহণকারী     ঠগিদের  পরবর্তী  বংশধরদের  মাঝে  বিস্তার  লাভ  করেছে  ৷  ইহা  হয়ত  সুপ্ত  অবস্থায় ছিল  এতদিন  ৷   তবে  বর্তমান  বাংলাদেশে এখন উপযুক্ত  পরিবেশ  পেয়ে  তা  আবার  ব্যাপকভাবে  জেগে      উঠেছে  ৷  তাই হয়ত বর্তমানে  বাংলাদেশে   যারা  সন্ত্রাসী  কার্যক্রমের  সঙ্গে  জড়িত  তাদের  মধ্যে  ঠগিদের  বংশধারা  বা  জিন  মিশে  ছিল  তা  জেগে  উঠেছে  ৷  হয়ত  অরিজিন্যাল  বাঙালীদের  মধ্যে  এই  জিনের  প্রভাব পূর্বে  ছিল  না ,  বর্তমানেও নেই  ৷ তাই  এখনও  বোধহয় বাংলাদেশে কম  শিক্ষিত  সাধারণ  মানুষদের  মধ্যে  ভাল  মানুষের  সংখ্যা  বেশী  দেখা  যায়  ৷ তবে  আলোচ্য  ঠগিদের  বংশধররা  এখন  সমাজর  সর্বস্তরে  ছড়িয়ে  পড়েছে  বা  পড়তে  আরম্ভ করেছে ৷    দেশের  রাজনীতির  ক্ষেত্রও  এদের  আওতায়  চলে  এসেছে  ৷  এটা  অনেকটা  গণ  হিষ্টিরিয়া  রোগের  আকার  ধারণ  করছে  !

         এই  ঠগি  বাঙালী  বংশধরদের  থেকে  সাধারণ  মানুষকে  মুক্ত  করতে  ব্রিটিশ  প্রশাসক  উইলিয়াম  হেনরি  শ্লীম্যানের  মত আর কারো  বাংলার  মাটিতে  জন্ম  নেয়ার  সম্ভাবনা  নেই  বলা  যায় অনায়াসেই  ৷  তাই এদের দমন  করতে  হলে  যা  করতে  হবে  তা  বাংলার  সাধারণ  মানুষকেই  করতে  হবে  ৷  আর  একাজে  বাংলার  বর্তমান  নতুন  প্রজন্মকেই  এগিয়ে  আসতে  হবে  ৷

   ( সূত্র;-সুকান্ত  কুমার  সাহার  ঠগিদের  নিয়ে  একটি  লিখা  যা
       bdnews24.com  এর  ব্লগে  প্রকাশিত  হয়েছে , সে  লিখা
       কিছু  তথ্য  নুয়া  হয়েছে ৷
           উইকিপিডিয়া  মুক্ত  বিশ্বকেষের  ও  কিছু  তথ্য  সংযুক্ত

            করা  হয়ছে  এই  লিখাটিতে  )  

মন্তব্যসমূহ