বাংলাদেশের স্বাধীনতার
চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে :
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে
স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশে
কি ভাবে চরিত্রহীন
পেটিবুর্জোয়াতন্ত্র ; সন্ত্রাস
ও দুর্নীতি তন্ত্রের
প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো তার কারণ বিশ্লেষণ
৷
আজ থেকে প্রায় ৮ শত বছর আগে ইংল্যান্ডে রাজার হাত থেকে
প্রজারা তাদের নাগরিক
অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বিদ্রোহ শুরু
করে গণযুদ্ধ আরম্ভ করে ৷ প্রজাদের
আন্দোলনের এক পর্যায়ে
রাজা তাদের দাবীদাবা
স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন ৷ এ উদ্দশ্যে
রাজাকে ম্যাগনা কাটা নামে একটি চুক্তিপত্র বা একটি সনদে সই করতে হয়েছিল ৷ কিন্তু প্রজাদের
এই যুদ্ধে ও বিদ্রোহে নেতৃত্বে
দিয়েছিল তখনকার সামান্ত
ও মাঝারি ভূস্বামী
শ্রেণীর লোকেরা ৷ তাই ইংল্যান্ডর
রাজা একটা আপোস ফরমূলায় বিদ্রোহীদের
নেতৃত্বকে রাজি করিয়ে নিতে পেরেছিলেন
যাতে রাজা ক্ষমতা
ছেড়ে দিলেও রাজতন্ত্র
কিছুটা হলেও টিকে
থাকে ৷ তাই ব্রিটেনে এখনও হাউস অব লর্ডস
, হাউস
অব কমন্সের মাথায ছড়ি ঘোরায় ৷ ব্রিটেনের
অভিজাত শ্রেণীর হাউস অব লর্ডস বাতিলের প্রচেষ্টা
এখনও সফল হয় নি ৷
ফরাসী বিপ্লবেও
সাধারণ মানুষ সাম্য
, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নামে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল এবং ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র
প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল
৷ কিন্তু তা বেশিদিন
ধরে রাখতে পারেনি
সাধারণ মানুষ ৷ কারণ বিপ্লবের
নেতৃত্বে ছিল পুরাতন
রাজতন্ত্রের সভাসদ সহ সামরিক ও বেসামরক আমলাতন্ত্র
৷ ফলে , পরবর্তিতে
রাজার স্থান এবং ক্ষমতা
তারাই কুক্ষিগত করে ফেলে ৷ তাই ফ্রান্স একটি গণতান্ত্রিক দেশ হলেও এখন রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত
বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতে ৷
আমেরিকার স্বাধীনতা
যদ্ধের সূচনা হয়েছিল
মলত সমাজে বৈষম্যমূলক
ট্যাক্স আরোপকে কেন্দ্র
করে ৷ আমেরিকায়
বসতিস্থাপনকারী ইংরেজ সহ অন্যান্য সাদাদের
ওপর ইংল্যান্ডর সরকার কর্তৃক বৈষম্যমূলক
করারোপ করাতেই ঐ শ্রেণী বিদ্রোহী
হয়ে ওঠে ৷ এবং এই বিদ্রোহ একপর্যায়ে
এসে স্বাধীনতার যুদ্ধে
পরিণত হয় ৷ যার অন্যতম
স্থাপতি ছিলেন আব্রাহাম
লিঙ্কন ৷ তিনি বলেছিলেন স্বাধীন
আমেরিকা হবে জনগণ দ্বারা গঠিত এবং জনগণের দ্বারা
শাসিত, জনগণের সরকার ৷ কিন্তু
বাস্তবে আমেরিকায় জনগণ কর্তৃক শাসিত এবং জনগণের
সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি ৷ কিছুকালের
মধ্যে একটি উঠতি ব্যবসায়ী শ্রেণীর
হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় ৷ তৈরি হয় ওয়ালস্ট্রিট
৷ ( বাংলাদেশের মতিঝিল
এবং খাতুন গঞ্জের
মত ) এই ওয়ালস্ট্রিট
থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ব্যবসায়ীদের মনোপলি , কার্টেল , মাল্টি ন্যাশনাল ইত্যাদি যা এখন কর্পোরেট
ও কার্টেলের ভূজবন্ধনে
গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমে পরিণত হয়েছে ৷ ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি
এখন আমেরিকার সবচাইতে
বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে ৷ তাই যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির
মুনাফার ওপর এবং যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির
বাজার রক্ষার ওপর মার্কিন অর্থনীতি
নির্ভরশীল হয়ে গেছে ৷ আমেরিকাকে তাই যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির
জন্য পৃথিবীর সর্বত্র
যুদ্ধ বাধিয়ে রাখতে হয় এবং তার সম্প্রসারণ
ঘটাতে হয় ৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময়ের এবং স্বাধীনতার পরের ধারা বিশ্লেষণ
করলে দেখা যায় যে
, যুদ্ধের সময়ের এবং এর পরবর্তিকালের
সমাজের সামগ্রিক আদর্শ ও দর্শন স্বাধীন দেশের চেহারায় প্রতিফলিত
হতে না হতেই প্রতিবিপ্লবের ধাক্কায়
ক্রমাগত ভাবে তা পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে গেছে ৷ আমাদের
স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ ও দর্শন সেক্যুলারিজম ও সোশ্যালিজম বর্তমানে
সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে ৷ যদিও স্বাধীনতা যুদ্ধে
সাধারণ মানুষের ব্যাপক
সম্পৃক্ততা ছিল ৷ সমাজবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে
প্রকৃত অর্থে তখন জনযুদ্ধ
বলে অবিহিত করেছিলেন
৷
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের
নেতৃত্ব ছিল একটি উঠতি ধনী
ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর
হাতে ৷ যাদেরকে
অবিহিত করা হত পাকিস্তানের
আইয়ুব আমলের সন্তান
বা ‘ চিলড্রেন অব আইয়ুব ইরা ’ নামে
৷ পাকিস্তানি শাসকরা
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে
অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সমাজে যে ক্ষোভের সৃষ্টি
হয়ে ছিল তা দূর করার জন্যে এ অঞ্চলে উন্নয়নের
ছিটেফোটার সঙ্গে কিছু ব্যবসা-
বানিজ্যের সুযোগ দিয়েছিল
৷ এরই ফলোশ্রুতিতে
পূর্ব পাকিস্তানে একটি আরবান নব্য ধনী শ্রেণীর
সৃষ্টি হয় ৷ আর গ্রাম পর্যায়ে উন্নয়ন
পরিকল্পনার অর্থ হাতসাফাইয়ের
মাধ্যমে একটি আর্থিকভাবে
সচ্ছল শ্রেণীর আবির্ভাব
হয় ৷ এদের প্রায় সবাই আইয়ুব আমলের শেষদিকে
আওয়ামী লীগের ছয় দফা ভিত্তিক
সরকার বিরোধী আন্দোলনে
যোগদান করে এবং পরবর্তি ধাপে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা
যুদ্ধে ও সমর্থন
জানায় ৷
এখন দেখা যাচ্ছে এদের মূল লক্ষ্য
ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতা
আন্দোলনের ফলে যদি দেশ স্বাধীন
হয়ে যায় তবে তারা স্বাধীন
বাংলাদেশে নিজস্ব পূঁজির
প্রতিযোগিতাবিহীন বাজার পাবে এবং অল্প সময়েই তারা আদমজি
, বাওয়ানি ও ইস্পাহানীদের
স্থলাভিষিক্ত হতে পারবে ৷ যার করণে এই শ্রেণীটি সহ কিছু
বুদ্ধিজীবিও স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সমর্থন
করে এবং যুদ্ধের
নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রেও
বড় ভূমিকা পালন করে
৷ তাই
যুদ্ধের সময় এদের অনেককে
প্রাণ ভয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে
চলে যায় ৷ কিন্তু মুজিবনগর সরকারের
সঙ্গে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতেন
বিদেশে অবস্থান করেও ৷
আর স্বাধীনতা যুদ্ধের
সফল সমাপ্তি হলে এরা দ্রুত দেশে ফিরে আসে এবং বঙ্গবন্ধু
ও তার
সরকারকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে ৷ এই সুযোগে তারা তখন সদ্য স্বাধীন দেশের অর্থনীতিকে প্রকৃত
সমাজতন্ত্রীকরণের বদলে ‘ হার্ভার্ড
সোশ্যালিজমের ’ অর্থনীতির আদলে একটি অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার
দ্বারা দেশের আর্থসামাজিক
ব্যবস্থায় একটি নব্য ধনী শ্রেণীর অবস্থান ও কর্তৃত্ব শক্ত করার প্রচেষ্টা চালান ৷ কিন্তু
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে দেশে একটি শোষনমূক্ত
অর্থনীতি গড়ে তোলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন ৷ তাই তারা বঙ্গবন্ধুকে
তাদের পছন্দ মত নীতিতে প্রভাবিত
করতে সফল হন নাই ৷ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব বাঙালী
নব্য ধনীদের আশা আকাঙ্খা
পূরণ
করতে সহযোগিতা করতে চান নি ৷
ফলে শুরু হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু
বিরোধী চক্রান্ত ৷ ঐ সময়ে ঐ নীতিতে
বিশ্বাসী কিছু বুদ্ধিজীবি
সম্প্রদায় বঙ্গবন্ধকে ‘ ক্লাস -ট্রেইটর ’
বা শ্রেণী স্বার্থের
বিশ্বাস হন্তা বলে বিবেচনা করতে শুরু করে ৷
অন্যদিকে ঔপনিবেশিক
আমলের মানুষিকতা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু
ও তাঁর সরকার কয়েকটি বড় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করেন ৷ ফলে ঔপনিবেশিক
কাঠামোর আমলাতন্ত্র এবং নতুন গড়ে ওঠা মিলিটারি
ব্যুরোক্রেসির একটি উচ্চাভিলাষী
ও পাকিস্তানী মনা অংশকে আতঙ্কিত
করে তোলে ৷ এই সঙ্গে
বাকশাল পদ্ধতি ও নির্বাচিত জেলা গভর্ণর প্রথা প্রবর্তনের দ্বারা
আমলাতন্ত্রের পুরানো কাঠামোর
পরিবর্তন করা হবে এবং পূর্বে
ঘোষিত সর্বদলীয় ছাত্রদের
১১ দফার আলোকে রাষ্ট্রীয়করণ নীতি ও কমান্ড
অর্থনীতি প্রবর্তনের সংবাদ ও প্রকাশিত
হয় ৷ তখন উপরে উল্লেখিত
ঐ শ্রেণী গোষ্ঠির সমর্থনকারীরা
দেখতে পান যে তাদের চোখের সামনে তাদের আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা
সহ দেশে বৃহৎ পূঁজি বিকাশের
নতুন সুযোগ অবরূদ্ধ
হয়ে যাচ্ছে ৷ অপরদিকে তারা দেখলেন
যে যদি
স্বাধীন দেশে বাকশাল পদ্ধতি
প্রবর্তিত হয়ে শ্রেণী
স্বার্থভিত্তিক বহু দলীয় রাজনৈতিক ধারা ও বিলীন হয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে স্বাধীনতা
যুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী
এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী দলগুলোকে
নিয়ে মোর্চা গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতা
তাদের হতে ন্যাস্ত
হয়ে যায় , তবে তারা যে উদ্দেশ্যে আওয়ামী
লীগকে সমর্থন করে স্বাধীনতা যুদ্ধে
অংশ নিয়েছিল তা ব্যর্থ হয়ে যাবে ৷ এই পর্যায়ে
সরকার আবার দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি
শৃঙ্খলা রক্ষা করতে এবং দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠা স্বাধীনতা
বিরোধী শক্রু নিপাতের
জন্যে মুক্তিযুদ্ধাদের সমন্নয়ে
রক্ষীবাহিনী গঠন করেন ৷ তখন ঐ শ্রেণীভূক্ত
গোষ্ঠিরা মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির
একটি পাকিস্তানী মনা অংশের মধ্যে এই ভয় ঢোকাতে
সক্ষম হয় যে অদূর ভবিষ্যতে
সামরিক বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত
করতে রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছে ৷ যদিও এটা একটি নির্জলা
মিথ্যা প্রচারণা ছিল ৷
এসব উল্টো প্রচারণা এবং প্রশাসনিক পদ্ধতির
পরিবর্তনের চেষ্টার ফল ভোগ করতে হয় বঙ্গবন্ধু
পরিবারকে এবং মুজিবনগর সরকারের
মূল নেতৃত্বকেই , পুরো সরকারকে নয় কিন্তু ৷ তাই বঙ্গবন্ধুকে
সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং পরে মুজিবনগর
সরকারের নেতৃত্বদানকারী প্রধান
চার নেতকেও জেলখানায়
প্রবেশ করে হত্যা করে
হয় ৷ এবং স্বাধীন
বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রতিবিপ্লবীদের সমন্নয়ে
গঠিত একটি নতুন শ্রেণী গোষ্ঠী
দখল করে নেয় ৷ এই গোষ্ঠীতে নব্য ধনী শ্রেণী
যেমন ছিল , তেমনি একশ্রেণীর
পাকিস্তান পন্থী বুদ্ধিজীবি
ছিল আর ছিল সামরিক
ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের
একটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী
অংশ , আর এদের সঙ্গে যুক্ত
হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী রাজাকার
গোষ্ঠী ও তাদের দোষররা
৷ ক্ষমতা দখল করে সমন্নয়কারী প্রতিবিপ্লবীরা প্রথমে
আওয়ামী লীগের ডানপন্থী
প্রতিক্রিয়াশীল অংশকে সামনে খাড়া করেছিল
আর তাদের পেছনে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের পিষ্টপোষকতা
তো ছিলোই ৷ এর পরও তারা অতিরিক্ত
সতর্কতার জন্যে একাত্তরের
পরাজিত শক্তি- সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানীমনা মৌলবাদীদের
এবং তথাকথিত চীন সমর্থক বামপন্থী
যাদের অনেকেই তখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
মেনে নিতে পারে নাই , আর চীন তখন পর্যন্ত স্বাধীন
বাংলাদেশকে স্বীকৃতিও দেয় নাই
, তাদেরকে অর্থাৎ চীনাপন্থী
বামপন্থীদের স্বাধীন বাংলাদেশের
রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে তাদেরকেও ক্ষমতার
সহায়ক শক্তি হিসেবে
গ্রহণ করে ৷ ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার
শ্রেণী চরিত্র তখনই সম্পূর্ণ
বদলে যায় ৷ পর্যায়ক্রমে
অবাঙালী ও পকিস্তানীদের
শাসন ও শোষনের
পরিবর্তে নব্য বিকাশিত
বাঙালী ধনী শ্রেণীর
শাসন ও শোষণ সমানে প্রতিষ্ঠা
লাভ করে স্বাধীন
এই বাংলাদেশে ৷
যে সেক্যুলার
ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র
গঠনের লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের
জন্ম হয়েছিল , সেই লক্ষ্যটি এখন সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছে ৷ যদিও দেশটির
নামের সঙ্গে এখনও গণপ্রজাতন্ত্র কথাটি যুক্ত আছে ৷
বর্তমানে দেশটিতে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চরিত্রহীন
পেটিবুর্জোতন্ত্র ; আর সন্ত্রাস ও দূর্নীতিতন্ত্র এখন বাংলাদেশের মূলভিত্তি এবং
মূলনীতি ৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার
শ্রেণী চরিত্র এখন নব্য
ধনী শ্রেণীর
কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্র ৷ উন্নত বিশ্বের
বুর্জোয়া রাষ্ট্রে যে আইনের শাসন থাকে তা কিন্তু বাংলাদেশে
প্রায় অনুপস্থিত অথবা অস্বীকৃত ৷ এমন কি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান
ও তাই বার বার বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে ৷ দেশে এখন আইনকেও
বিভিন্ন শ্রেণীর স্বার্থে
তার যথাযথ পথে চলতে
ও বাধাগ্রস্থ করা হয় বা বাধা দেয়া হয় ৷
৭৫ সালের পর থেকে দেশে যে অগণতান্তিক শাসন ও শোষণের
ধারাবাহিকতা চলছিল , দীর্ঘকাল
পরে ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ও সেই ধারা পরিবর্তন
করতে পারছে না এবং ক্ষেত্রবিশেষে
বোধহয় পরিবর্তন চাচ্ছেও
না ৷ কারণ দীর্ঘ ২১ বছর পর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো ১৯৯৬ সালে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে নতুন আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল সরকার হিসেবে তা যে খুব শক্তিশালী ছিল তা নয়, বরং শেখ হাসিনাকে জোড়াতালি দিয়েই সে সময় সরকার গঠন করতে হয়েছিল। তখনও শেখ হাসিনার সরকারকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল নানামুখী বিরোধ ও ষড়যন্ত্রের। কিন্তু দেখা গেলো, দলের ভেতর তখন একে একে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিছু চিহ্নিত ও বিতর্কিত ব্যক্তি; যারা কেবল নিজের স্বার্থটাই বোঝে, দল বোঝে না, সমষ্টি বোঝে না, জাতি এবং দেশ তো দূরের কথা। নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে তারা দলের আশ্রয় নেয় কেবল, কিন্তু দলকে ব্যবহার করাটাই হয় তাদের মূল কাজ ৷
তার অনেকগুলো
কারণের মধ্যে অন্যতম
প্রধান কারণ হচ্ছে সময়ের বিবর্তনে
আওয়ামী লীগের শ্রেণী
চরিত্রে অনেক পরিবর্তন
সাধিত হয়ে গেছে ৷ বর্তমানে
লুটেরা নব্য ধনী শ্রেণীর একটা বড় অংশ এবং সব দলে বিরাজমান
ফাও খাওয়া শ্রেণীর
কিছু সদস্য দলটির মধ্যে এবং দলের নেতৃত্বের মধ্যে ও কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করেছে ৷ আবার এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিভিল এন্ড মিলিটারি
ব্যুরোক্রেসির একটি সুবিধাবাদী
অংশ ৷ এ ছাড়াও বর্তমানে
দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক
শক্তি ও মৌলবাদীদর
সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তি
স্বার্থের বিনিময়ে একটি আপোসকামী অংশও
যক্ত হয়েছে ৷ সব মিলিয়ে
দলের মধ্যে বর্তমানে
অসাম্প্রদায়কতা ও সেক্যুলারিজমের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধের
চেতনার পক্ষে কথা বলার জন্যে
দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়া আর তেমন কাউকে দেখা যায়
না ৷ তাই শেখ হাসিনকে কিছু বামপন্থী ঘিরে রেখেছে বলেও পার্টির কিছু সদস্য অপবাদ দিতেও দ্বিধা
করেন না ৷ তবে এখনও দেখা যাচ্ছে
শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে
সম্প্রদায়িকতা , সন্ত্রাস ও জঙ্গী মৌলবাদের বিরুদ্ধে
দৃঢ়চিত্ত ৷ কিন্তু
এই প্রশ্নে তার সহায়ক শক্তি দলের ভেতরের
এবং বাইরের প্রতিপক্ষের
তুলনায় বেশ দুর্বল
৷
অন্যদিকে নব্য ধনীদের প্রতিনিধি
ও ফাও খাওয়া শ্রেণী সহ বুদ্ধিজীবিদের একটি অংশ ৭৫ সালের মত এককাট্রা হয়েছেন
৷ তারা দেশের ভেতরে সেন্টার ফর ফলিসি ডায়লগ ,
ট্রান্সপারেন্সি ইনর্টারনেশন্যাল
, হিউম্যান রাইট্স
সংস্থা ইত্যাদি নামে বিদেশী অর্থপূষ্টে
কিছু সংস্থা এবং তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের
জন্যে গঠিত অসংখ্য
সংস্থা গড়ে তুলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার
নামে শোরগোল সৃষ্টি
করে বর্তমান সরকারের
বিরোধীতায় ব্যস্ত ৷ এর উদ্দেশ্য
দেশের জনগণের মঙ্গলের
জন্যে নয় ৷ তারা
এসব করছেন বঙ্গবন্ধু
আমলের মত নব্য ধনী ও রক্ষণশীল সমাজের
স্বার্থ ও অধিকার
রক্ষা করে তাদেরকে
প্রয়োজনে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
করতে , তাই তাদের সব প্রতিবাদ
এখন শেখ হাসিনার সরকারের
বিরুদ্ধে ৷ সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় রাজনীতির
বিরুদ্ধে তাদেরকে কিছু বলতে দেখা যায় না ৷
বাংলাদেশের স্বাধীনতার
এই শ্রেণী মানুষিকতা
বদলাতে হলে শেখ হাসিনাকে
তার দলের শ্রেণী চরিত্র বদলাতে
হবে প্রথমে ৷ দেশের মানুষকে শান্তি ও স্বস্তি দিতে হলে শেখ হাসিনাকে প্রথম দলের ভেতরে ঘাঁটি গেড়ে বসা ও ভয়াবহ স্বার্থদ্বন্দ্বে লিপ্ত এই মাফিয়া গ্রুপগুলোকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তাদের অপরাধের বিচার ও কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে ৷ তিনি তার দলের তৃণমূল
পর্যায় থেকে একাজ আরম্ভ করতে হবে এবং দলের সাংগঠনকে
শক্তিশালী করতে হবে কারণ আওয়ামী লীগে আদর্শ বলতে যতটুকুই এখন অবশিষ্ট রয়েছে তা কেন্দ্রে বা দলের শীর্ষ পর্যায়ে এর চর্চা হয় বলেই এখনও তৃণমূল অবধি অনুসৃত হয়ে থাকে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া । আরেকটি বিষয় হলো, দলটির নেতাকর্মীরা মনে করে যে, শেখ হাসিনা যদি বেঁচে থাকেন, নিরাপদ থাকেন তাহলে তারা এবং দেশও নিরাপদ থাকবে । তাই তারা নিজেদের প্রয়োজন সহ দেশের প্রয়োজনেই তারা শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকেন। ৷ আর তার উচিত হবে দেশের অন্যান্য
ছোট-বড় এমন গণতান্ত্রিক
দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ
হওয়া , যাদের মধ্যে লুটেরা ও ফাও খাওয়া শ্রণীর কর্তৃত্ব
এখনও বিস্তার লাভ করেনি ৷ সুশীল
সমাজের যে প্রগতিশীল
এবং বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর
অংশ যারা এখনও কায়েমী স্বার্থের
কাছে বিক্রি হয়ে যাননি
, তাদেরকে ও সংঘবদ্ধ করতে হবে শেখ হাসিনাকে ৷ সর্বোপরি দুর্নীতি ,
সন্ত্রাস ও মৌলবাদের
বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাকে তৃণমল পর্যায়ের
সকল মানুষকে উজ্জীবিত
ও করতে হবে শেখ হাসিনাকে ৷ আম আদমী পার্টি
ভারতে তা প্রমাণ
করেছে ৷ উপযুক্ত
নেতৃত্ব পেলে বাংলাদেশের
মানুষও নতুন মুক্তির
ডকে সাড়া দেবে ৷ শেখ হাসিনা যদি এই অসাধ্য
কাজে নেমে তা সাধনে সক্ষম হন তবে তার দলের মধ্য থেকে তিনি গালি খাবেন
, অপমানিত হবেন কিন্তু
বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক
দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন
যেমন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগিরা ৭১ সালে বাংলাদেশকে
স্বাধীন করে একটি ঐতিহাসিক
দায়িত্ব পালন করেছিলেন
৷ এরকম কিছু একটা এখনই না করতে পারলে আমাদের সকলের চোখের সামনে ৭১-এর বাংলাদেশের
মৃত্যু অনিবার্য হয়ে যাবে ৷
( মূল সূত্র
: ২৫- মার্চ জনকণ্ঠে প্রকাশিত
আবদুল গাফ্ ফার
চৌধুরীর বাংলাদেশের
স্বাধীনতার বর্তমান
শ্রেণী-চরিত্র লেখাটির
অনুকরণে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন