মিথোস ও লোগোস প্রসঙ্গে ;-
মিথোস - ক্যারেন আর্মষ্ট্রং একে সংজ্ঞায়িত করেছেন এ ভাবে যে - গ্রিক শব্দ মিথোস এর ' মিথ ' গ্রিক মাস্তেরিয়ন থেকে উদ্ভূত , ' মিস্ট্রি ' , বা ' মিস্টিসিজমের ' মতো শব্দঃ মুখ বা চোখ বন্ধ করা ৷ নীরবতা ও স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টিতে প্রোথিত জ্ঞানের এক ধরন যা জীবনের অর্থ যোগায় কিন্তু যোক্তিক পরিভাষায় বাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷ প্রাক আধুনিক বিশ্বে পৌরাণিক জ্ঞানকে লোগোসের সম্পূরক হিসাবে দেখা হত ৷
লোগোস - গ্রিক শব্দ , এর অর্থ বাণী , যাকে যৌক্তিক বা যুক্তিপূর্ণ বা বৈজ্ঞানিক ভাবে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা বা বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্স হিশেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে ৷
মানব সমাজের বিশ্বাসের প্রাচীন ধারার সঙ্গে পরবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের যে নতুন ধারার বিকাশ লাভ করেছে , তাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সমাজ বিশ্লেষকরা মিথোস ও লোগাস এর প্রসঙ্গ এনেছেন ৷
ক্যারেন আর্মষ্ট্রং এইসব ব্যাপার নিয়ে লেখা তার গবেষণা গ্রন্থ “ Battle for God” এ উল্লেখ করেছেন যে , মানুষের চিন্তাধারা অনাদিকাল থেকেই বিকাশিত হয়েছে পরিষ্কার দুটি ধারায় ৷ এর একটি হচ্ছে ‘ মিথোস’ বা মিথ যা প্রাচীণ পৌরাণিক বিশ্বাসের উপর নির্ভশীল ছিল ৷ এর কোনো বাস্তবভিত্তিক প্রমাণ দেয়ার প্রয়োজন পড়ত না ৷ ইহা সম্পূর্ণ বিশ্বাসভিত্তিক একটি ব্যাপার যা তখনকার প্রাচীন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল ৷
এবং অপরটি হচ্ছে ‘ লোগাস ’ বা যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও কোনো ঘটনার বাস্তব ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে এর সঠিক কারণ ও সত্য আবিষ্কার করা ৷
মিথোস এসেছে ইংরেজী ‘ মিথ’ থেকে , এর প্রতিশব্দগুলো mystery এবং mysticism , যা প্রকাশ করে রহস্যময়তা , দুর্জ্ঞেয়তা এবং অতীন্দ্রিয়তাকে ৷ ক্যারেন আর্মষ্ট্রং - এর মতে মিথ হচ্ছে কতকগুলো রীতি - নীতি , অচার অনুষ্ঠান ও সংস্কার - যেগুলোর কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান কখনও পাওয়া যায় না ৷ এগুলো মানব মনে জায়গা করে নিয়েছে স্রেফ কতকগুলো বিশ্বাসের কাঁধে ভর করে ৷
আর আর্মস্ট্রং গ্রিক শব্দ ‘লোগাসকে’ বর্ণনা করেছেন ‘ যুক্তি গ্রাহ্য’ ‘ প্রমানসাপেক্ষ’ ‘ বিজ্ঞানভিত্তিক’ শব্দ ক’টির সাহায্যে ৷ তিনি মনে করেন আধুনিক বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি , প্রগতি আর উন্নয়নের মূলে রয়েছে ‘ লাগোস’ - যা জ্ঞান ও যুক্তির মাপকাঠিতে প্রকৃত বাস্তবতার পরিচায়ক ৷
এবং অপরটি হচ্ছে ‘ লোগাস ’ বা যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও কোনো ঘটনার বাস্তব ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে এর সঠিক কারণ ও সত্য আবিষ্কার করা ৷
মিথোস এসেছে ইংরেজী ‘ মিথ’ থেকে , এর প্রতিশব্দগুলো mystery এবং mysticism , যা প্রকাশ করে রহস্যময়তা , দুর্জ্ঞেয়তা এবং অতীন্দ্রিয়তাকে ৷ ক্যারেন আর্মষ্ট্রং - এর মতে মিথ হচ্ছে কতকগুলো রীতি - নীতি , অচার অনুষ্ঠান ও সংস্কার - যেগুলোর কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান কখনও পাওয়া যায় না ৷ এগুলো মানব মনে জায়গা করে নিয়েছে স্রেফ কতকগুলো বিশ্বাসের কাঁধে ভর করে ৷
আর আর্মস্ট্রং গ্রিক শব্দ ‘লোগাসকে’ বর্ণনা করেছেন ‘ যুক্তি গ্রাহ্য’ ‘ প্রমানসাপেক্ষ’ ‘ বিজ্ঞানভিত্তিক’ শব্দ ক’টির সাহায্যে ৷ তিনি মনে করেন আধুনিক বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি , প্রগতি আর উন্নয়নের মূলে রয়েছে ‘ লাগোস’ - যা জ্ঞান ও যুক্তির মাপকাঠিতে প্রকৃত বাস্তবতার পরিচায়ক ৷
অতীতের মানুষ মোটামুটি আমাদের মত হলেও তাদের আধ্যাত্মিক জীবন বর্তমান থেকে অনেক ভিন্ন ছিলো ৷ পণ্ডিতেরা যার নাম দিয়েছেন (উপরে উল্লেখিত ) মিথোস ও লোগাস ৷ (সূত্র ;- জোহানেস স্লোয়েক - ডিভোশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ , ১৯৯৬ , পৃষ্টা -৫৩ ,-৯৬ )
মানবসমাজে তখন দুটোই ছিলো আবশ্যক , কারণ তখন সত্য অর্জনের ক্ষেত্রে দুটোকেই সম্পূরক মনে করা হত ৷ কারণ তখন মিথকেও মৌলিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হত এবং মিথ তখন ছিল জীবনের উৎস এবং মিথ ছিল সংস্কৃতির ভিত্তি ও মানব মনের গভীরতর স্তরেও মিথ দৃষ্টি দিতে পারতো বলে বিশ্বাস করা হতো ৷ যদিও বাস্তব বিষয় - আশয়ের সাথে মিথের কোনো সম্পর্ক ছিলো না ৷ মিথের সম্পর্ক ছিলো অর্থের সাথে ৷ এর পর ও মিথোস মানুষকে তখন হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারত বলে চলমান ও প্রচলিত বিশ্বাস ছিল তখনকার সমাজে ৷ এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের একটা অর্থও মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারতো মিথ ৷ অর্থাৎ মিথোস বা মিথ মানুষের অবচেতন মনে প্রোথিত হয়ে পৌরাণিক কাহিনী গুলোকে মানুষের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর গভীর প্রভাবের সৃষ্টি করে মানুষের অবচেতন বলয়ের অস্পষ্ট এলাকাসমূহকে আলোয় তুলে নিয়ে আসতে পারত ৷ ফলে সমাজে মিথোস মানুষকে এমন এক প্রেক্ষিতের যোগান দেয় যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা আলাদা অর্থ তুলে ধরতো বলে মনে করা হয় ৷ কিন্তু বর্তমানে যাকে একবারেই যোক্তিক মনের অনুসন্ধানে বোধগম্য হয় না বা বিশ্বাসযোগ্য হয় মনে হয় না , আধুনিক চিন্তা চেতনা বিশিষ্ট মানুষর কাছে ৷ তবে তখন মানুষের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর এর যে একটা গভীর প্রভাব পড়েছিলো , তা কোনো ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই ৷
(সূত্র;- মির্চা এলিয়ান , প্যাটার্নস ইন কম্প্যারেটিভ রিলিজিয়ন , ১৯৫৮, পৃষ্টা- ৪৫৩-৫৫ )
তাই বর্তমান আধুনিক সমাজে মিথ- এর মৃত্যুর ফলে মানুষের অন্তস্থঃ জগতের মোকাবিলা করতে সাইকোএনালিসিসের বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করতে হয়েছে ৷ কারণ যৌক্তিক প্রমান দিয়ে মিথকে এখন আর বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয় না ৷ মিথ ও কাল্ট পরস্পরের সাথে আবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মিথ আবার অতীন্দ্রিয়বাদের সাথেও সম্পর্কিত ছিল : কল্ট বা মরমী চর্চা ছাড়া ধর্মের মিথসমূহ বিমূর্ত রয়ে যায় ও অবিশ্বাস্য ঠেকে , তাই তাকে বুঝতে হলে এক বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে ৷
(সূত্র;-জোহানেস স্লোয়েক, ডিভোশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ , প্রকাশ ১৯৯৬ , পৃষ্টা ৭৫-৭৬ )
প্রাক - আধুনিক বিশ্বে ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ৷ তখন তারা আসলে কী ঘটনা ঘটেছিলো তা জানতে তেমন আগ্রহী ছিলো না এখনকার মানুষের মতো ৷ তারা তখন ঘটে য়াওয়া ঘটনার নিগূঢ় অর্থ জানতে বেশি আগ্রহী ছিলো ৷ ঘটনা সত্য না মিথ্যা তা জানতে তাদের কোনো আগ্রহ থাকতো না ৷ তাই ঐসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহকে তারা এক অটল , সময়হীন , বাস্তবতার প্রকাশ বলে মনে করতো ৷ কারণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে মিথে পরিণত করে একে অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী কাল্টে রূপান্তরিত না করতে পারলে তা তখন ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হতে পারত না ৷ আর কোনোভাবে তা ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিনত হয়ে গেলেই তা সত্য ঘটনায় রূপান্তরিত হতে আর বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো না ৷ আর এভাবে তখন সমাজে এক অন্ধ বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত ৷
পরবর্তি সময়ে প্রযুক্তির আবির্ভাবে লোগোস ও যুক্তিবিদ্যা সমাজে ক্রমান্নয়ে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ৷ লোগোস হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে এবং যার যার ক্ষেত্রে কর্মক্ষম করে তোলার যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনা ৷ মিথোস এর বোধ এখন পশ্চিমে প্রায় হারিয়ে গেছে , তার পরিবর্তে এখন পশ্চিমের সমাজ লোগোস এর সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়ে উঠছে ৷ আর এটাই এখন বর্তমান পশ্চিমের সমাজের মূল ভিত্তি হিশেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে ৷ তাই বর্তমানে পশ্চিমা সমাজে কোনো যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ছাড়া কোনো বিষয়ের সমাপ্তি টানা সম্ভব হয় না ৷ লোগোস বর্তমানে বাস্তবভিত্তিক , তাই এর সূচনা ভিত্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকারী মিথের বিপরিতে লোগোস দৃঢ়তার সাথে সামনে অগ্রসর হচ্ছে ৷ আর প্রাচীন দর্শনকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে নতুন এক আবিস্কারের চেষ্টা করে পরিবেশের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে ৷ এবং বর্তমানে আনকোরা আরো কিছু আবিষ্কার করে এবং এর সঙ্গে নতুন আরো কিছু উদ্ভাবণ করে পশ্চিমা সমাজে লোগোস তার উপযোগীতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে ৷
তবে প্রাক - আধুনিক বিশ্বে একসময়ে মিথোস ও লোগোস উভয়ই সমাজে অপরিহার্য ছিলো ৷ অর্থাৎ একটা ছাড়া অপরটা অচল হয়ে পড়তো , যদিও তাদের কাজ তখনও ভিন্ন ভিন্ন ছিলো এবং একে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলাকেও বিপজ্জনক বলে মনে করা হতো ৷
কিন্তু লোগোস এর নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিলো ৷ লোগোস মানব জীবনের পরম মূল্য সম্পর্কে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা বা তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের চাহিদামত উত্তর যোগাতে সমর্থ হতো না ৷ তাই জীবনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে মিথ আর কাল্টের প্রয়োজন হতো ৷ অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর সাফল্যের পর পশ্চিমে মিথোস কে মিথ্যা ও কুসংস্কার বলে নাকচ করে দিয়েছে এখন ৷ আর লোগোস কেই সত্য জানার একমাত্র উপায় হিশেবে গ্রহন করা আরম্ভ হয়ে গেছে ৷
তখন তারা ধর্ম বিশ্বাসের মিথোস কে প্রায়শ:ই লোগোস এ পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছে ৷ আর মৌলবাদীরা বর্তমানে একই প্রয়াস পাচ্ছে এখন আবার নতুন করে ৷ যা বর্তমানে ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি করে সমস্যার সৃষ্টি করেছে ৷ বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে ৷ কারণ মৌলবাদীরা মনে করে তারা তাদের পবিত্রতম মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্রান্তকারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে ৷ মৌলবাদীদের ধারনা , আধুনিকায়নে তাদের কোনো মুক্তি অর্জিত হচ্ছে না , বরং তারা বিশ্বাস করে যে ইহা তাদের পবিত্রতম বিশ্বাসের উপর একধরনের আক্রমাণাত্বক হামলা । যাহা থেকে তাদের বিশ্বাস ও আদর্শকে রক্ষা করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই নতুনভাবে এবং নতুন টেকনিকে এক মৌলবাদী আদর্শের যুদ্ধে অবতির্ণ হতে হবে ৷ তাদের বিশ্বাস সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই যুদ্ধ করা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প পন্থা নেই ৷
ড. আবুল বারকাতের ভাষায় মৌলবাদীরা ইদানিং মিথোস আর লোগোসকে এক সম্মিলনের মাধ্যমে নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে যার সফল ব্যবহার করে অচিরেই মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবে ৷ যদি অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসীরা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব সঠিক পথে পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন ৷
ড. আবুল বারকাতের ভাষায় মৌলবাদীরা ইদানিং মিথোস আর লোগোসকে এক সম্মিলনের মাধ্যমে নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে যার সফল ব্যবহার করে অচিরেই মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হবে ৷ যদি অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসীরা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব সঠিক পথে পালন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন