বাংলা ও বাঙালীর ঐতিহ্যগত অসাম্প্রদায়িক চেতনা কী রুদ্ধ হয়ে যাবে ?
বাংলাদেশের সমাজ বিজ্ঞানিদের মতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতির
প্রধান উপাদান হলো অসাম্প্রদায়িকতা
ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ৷ যদিও বাংলাদেশের
মানুষ ধর্মপ্রাণ , কিন্তু ধর্মকর্মের
সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার
রাজনীতির সংমিশ্রণ ভাল চোখে দেখে না
এ দেশের সাধারণ মানুষ ৷ যদি বাংলাদেশের সাহিত্য
এবং লোকজ বা গ্রামিন সংস্কৃতির
শাখাগুলোর দিখে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে
, ভক্তিগীতি , দেহতত্ত্ব , মুর্শিদি , বাউল , মারফতি , কীর্তন , যাত্রাপালা
, এমনকি গ্রামবাংলার মেলা
, ঘোড়দোড় , বারণী ইত্যাদিতে
সাধারণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক
জীবন দর্শন প্রতিপালিত
হয় ৷ অর্থাৎ
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সবসময় লোকজ সংস্কৃতির
একটা অসাম্প্রদায়িক ধারা বিদ্যমান ছিল ৷ ফলে সমাজে সুফিবাদের সঙ্গে চৈতন্যবাদের একটা সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদের
ধারা বিকাশমান ছিল ৷ বোধহয় এরই ফলোশ্রুতিতে
এই সমাজে মরমী কবি লালন শাহ এবং বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ
ঠাকুরের মত মানুষের
জন্ম নেয়া সম্ভব হয়েছে ৷
কিন্তু এই সাংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক ধারাকে
প্রত্যাখান করে প্রথমে
ওহাবী এবং বর্তমানে
জামায়াতি , হেফাজতি
, ও কওমী মাদ্রাসার ধর্মীয়
শিক্ষায় শিক্ষিতরা রাজনৈতিক
ইসলাম ও ধর্মীয়
সাম্প্রদায়িকতার সংমিশ্রনে বাংলাদেশে একটি নতুন সমাজিক
ও সংস্কৃতিক ধারা নির্মান করতে সক্ষম হয়েছে ৷ মোহাম্মদ
আলী জিন্নাহ্ ১৯৪০ সালের দিকে দ্বি-জাতিতত্ত্বের আবিষ্কার
করে এর প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন
৷ আর ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মধ্যে দিয়ে তা সমাজে বিষবৃক্ষের মতো ছড়িয়ে পড়ে ৷ এর ইতিহাস সবার জানা ৷ যা বাংলাদেশের
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখন আবার নতুন ভাবে মহীরূপে
উপস্থিত হয়েছে ৷
অবশ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে
একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক স্বাধীন
সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়
হওয়ার পর ৭১ সাল থেকে সরকারি ভাবে এবং রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃত পন্থায় ( পূর্বে যা ব্যক্তি পর্যায়ে
সীমাবদ্ধ ছিল ) বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক
জগতে ইহলৌকিকতার ভিত্তিতে
যে সামাজিক রূপান্তরের
উদ্বোধন ঘটেছিল এবং যুক্তিবাদী বিজ্ঞানভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক মুক্ত চিন্তা চেতনা সম্পূর্ণ একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল শ্রেণীর
আবির্ভাব হচ্ছিল তার দুয়ার আবার ক্রমাগতভবে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে ৷ যা একটি আধুনিক
ও মানবিক এবং গণতান্ত্রিক, আর অসাম্প্রদায়িক কল্যানমূলক
রাষ্ট্রের পূর্ব শর্ত হিসেবে ৭১ সাল
থেকে বিবেচিত হয়ে আসছিল
৷
৭৫ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের
পর স্বাধীন দেশে আবার নতুন করে ধর্মভিত্তিক
রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি
করে দেয়ার পর দেশকে এখন আবার সাতচল্লিশের
পাকিস্তানের সেই পূরোনো
বাতাবরণে ফিরিয়ে নেয়া আরম্ভ
হয়ে ছিল যা এরই মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে ৷
ইসলামের নামে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশের
গণতন্ত্র ও ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের জন্যে এক ভয়াবহ বিপদ হিসেবে কাজ করছে এখন ৷ সম্প্রদায়কতা এখন শুধু ধর্মীয়
বাতাবরণে সীমাবদ্ধ নেই ৷ তা ক্রমশঃ জাতিগত
, ভাষাগত , ও সংস্কৃতিগত ভিন্নতাকে
চিহ্নিত করে ক্রমাগত
সহিংস হয়ে উঠছে ৷
এই প্রেক্ষাপটে
এখন মুক্তচিন্তার অধিকারীদের
সমাজে ধর্মের রজনৈতিক
অপব্যবহারের স্বরূপ উন্মোচন
করা আজ আবার জরুরী হয়ে উঠেছে ৷
কারণ ধর্মভিত্তিক
রাজনৈতিক ধারণার বিপরিতে ধর্মনিরপেক্ষ
রাজনীতি রাষ্ট্র
পরিচালনার ক্ষেত্রে অবশ্যই , ধর্মকে
রাষ্ট্র
থেকে পৃথক বিবেচিত
করে এ ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠা
করতে হবে যে “
ধর্ম যার যার রাষ্ট্র
কিন্তু সবার ”৷ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি
আধুনিক বিশ্বে ধর্মরাষ্ট্রকে
প্রত্যাখ্যান করে ৷ আর যেসব রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে
নাগরিকদের মধ্যে বৈষ্যমের
সৃষ্টি করে সমাজের
একটি অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে
সংঘাতে লিপ্ত করে , আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই রাষ্ট্রকেও প্রত্যাখ্যান
করে ৷ অন্যদিকে
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি গণতন্ত্রকে
ও অগ্রাহ্য করে , যেখানে একমাত্র
গণতন্ত্রই হচ্ছে রাষ্ট্র
ও সমাজের অসাম্প্রদায়িকরণের মূল সৃত্র ৷ আর গণতন্ত্রেই
প্রত্যেক মানুষের মত প্রকাশের সুযোগের
সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও সমাজকে
প্রভাবিত করে এমন সব বিষয়ে অভিমত দেয়ার সুযোগ ও রয়েছে ৷ তাই ৭১ এর বাঙলাদেশকে রক্ষা করতে হলে ৭২ এর সংবিধানের অসাম্প্রদায়িকতাকে ফিরিয়ে
আনতে হবে অবশ্যই ৷
তবে একাজে ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক
দল আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য
রাজনৈতিক দল এগিয়ে আসবে না ৷ আর ধর্মীয়
সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর
তো বিপরিত অবস্থান
এ সব ক্ষেত্রে
৷ আর বর্তমান অন্যান্য রাজনৈতিক
দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায়
ঠিকে থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে ব্যস্ত ৷ তাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কোনো ব্যাপারই নয় , যা তারা বিবেচনায় নিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের চিন্তায় এগিয়ে আসবে ৷ সুশীল
সমাজ হিসেবে যারা বর্তমানে সমাজে পরিচিত তরাও তাদের
নিজেদের ঘরণা ও ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে এরকম কাজে আসবেনা
৷
তাই যা করার নিরপেক্ষ
আর যুক্তিবাদী ও
অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায়
বিশ্বাসী সম্প্রদায়ভূক্তদেরই করতে হবে
, যারা
দেশ ও জাতির মঙ্গল চান
৷ আর
মূক্তচিন্তার নতুন প্রজন্ম
যারা দেশে এবং প্রবাসে ছড়িয়ে আছেন
বিভিন্ন
ভাবে বিভিন্ন অবস্থানে , তারাও সবাই নিশ্চয়
একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক
আধুনিক ও গণতান্ত্রিক
বাংলাদেশ গঠনে এগিয়ে আসবেন ৷ এই আশা নিয়ে লেখাটা
শেষ করছি ৷
( সূত্র: অধ্যাপক মেসবাহ
কামালের একটি লেখার
আলোকে এ লেখাটি
তৈরি করা হয়েছে ৷ )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন