" যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী "

  
    
                           “  যে  সব  বঙ্গেতে  জন্মি  হিংসে  বঙ্গবাণী ”


                " যে  নিজে  এবং  নিজের  সময়  সর্ম্পকে  লেখে , 
                   সে  আসলে  সব  মানুষ  এবং  এবং  সব
                     সময়ের  জন্যেই  লেখে  ৷ 
                                    -  জর্জ  বার্নার্ড' শ
আবদুল হাকিম
বঙ্গবাণী

কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ।।
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন।।
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ।।
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত।।
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।।
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী।।
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবের গণ।।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।

    

          গত  কয়েক  শতকের  বাংলাদেশের  সামাজিক  রাজনৈতিক  এবং  অর্থনৈতিক  ইতিহাস  পর্যালোচনা  করলে  দেখা  যায়  যে  ,  এ  অঞ্চলে  বসবাসকারী  বাংলাভাষীদের  অনেকেই  এদেশের  কৃষ্টি- সাংস্কৃতিকে  তেমন  পছন্দ  করতেন  না  ৷  সমাজে  তাদের  আভিজাত্য  ও  ধর্মীয়  ভাবধারা  প্রকাশের  জন্যে  মক্কা ,  মদিনা  ছাড়াও  তারা  ইরান  তুরান  ও  বাগদাদের  দিকে  চেয়ে  থাকতেন  ৷ কারণটা  অবশ্য  শুধু   ধর্মীয়  দৃষ্টিভঙ্গীর  জন্যে  ছিল  না  ,   রাজনীতির    প্রভাব  ছিল  ,  প্রভাব  ছিল  আসরাফ  ,  আতরাফের  ও শ্রেণী  বিন্যাসেরও আর  সমাজে  নিজদের  অবস্থান  জানান  দেয়ার  ৷

               তাই  বৃহত্তর  বাংলায়  সাংস্কৃতি   , অর্থনীতি   এবং  সমাজে  একটি  মতাদর্শ  গত  পার্থক্য  বিদ্যমান  ছিল অনেক  আগ  থেকেই ৷ তবে  গত   চল্লিশের  দশক  থেকে  এর  কিছু  পরিবর্তন  লক্ষ্য  করা  গেছে  ৷  কারণ  তখন  পশ্চিমা  ধর্মনিরপেক্ষ  শিক্ষার  বিস্তার  আরম্ভ  হয়েছিল  সমাজের  প্রায়  সর্বস্তরে  ৷  আর  বাংলাভাষা  যখন  রাজনৈতিক  প্রক্রিয়ায়  বিকাশ  লাভের  সুযোগ  পায় , তখন  থেকে  বাংলাভাষাকে  কেন্দ্র  করে  এই মতাদর্শের  আলাদা  একটা   নির্দিষ্ট  প্রকাশ  পেয়ে  যায়  সমাজে ৷
 
              তাই  ষাটের  দশককে  ড়. হুমায়ুন  আজাদ  বলেছেন  মক্তচিন্তার  দশক  আর  লেখক  বদরউদ্দিন  ওমর  বলেছেন  বাংলাদেশী  মুসলমানদের  স্বদেশ  প্রত্যাবর্তনের   কাল  ৷ কিন্তু  স্বাধীনতার  ৩  বছর  যেতে  না  যেতেই  রাজনীতি  এবং  রাষ্ট্র  ক্ষমতার  পটপরিবর্তন  হয়ে  যায়  ৷  রাষ্ট্রক্ষমতা  চলে  যায়  দেশের  স্বাধীনতা  বিরোধীদের  হাতে  ৷  তারা  দেশে  তখন  প্রথমে  আরবী  কালচারের  বিকাশের  চেষ্টা  করেন  ৷  কিন্তু  রুটি  রুজির   আশায়  যারা  মুসলিম  ভাইদের  দেশে  গিয়েছিলেন এবং তারা  যখন  মানবেতর  জীবনযাপন  করে  অর্থশূন্য  হাতে  দেশে  ফিরতে  বাধ্য  হন  ,  তখন  থেকে  এই  ধারা  পরিবর্তীত  হয়ে  ইউরোপ  ও  আমেরিকা  যাত্রার  ধারায়   রূপান্তরিত  হয়ে  যায়  ৷  পরধনে  মত্ত্  হতে  আগ্রহী  বাঙালীরা  এবার  ইংরেজি  শিক্ষার  দিকে  জোঁকে  পড়েন  ৷  ইংলিশ  মিডিয়াম  ইস্কুলের  বন্যা  বয়ে  যায়  দেশে  ৷  বর্তমানে  সুদূর  গ্রাম  অঞ্চলে  ও  ইংরেজি  মিডিয়াম  শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান দেখা  যায়  ৷

               আর এর  কিছুদিন পরে  আই , এল , টি ,  এস  এবং  জে , আর , ডি , টুফেল  ইত্যাদি তে  ট্রেইনিং  দিতে  ও  নিতে  আগ্রহীরা  শহরের  অধিকাংশ  ফ্লাট  বাড়ি  দখলে  নিয়ে  যায়  ৷  কিন্তু  এক  পর্যায়ে  বিদেশে  ছাত্র  নেয়া  সীমিত  হয়ে  যায়  কিছু  অতি  লোভীদের  তৎপরতার  কারণে  ৷  বর্তমানে  আবার  পাড়ায়  পাড়ায়  সার্টিফিকেট  বিতরণকারী  প্রাইভেট  শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে  ভর্তি   হয়ে   গেছে  ৷  কিন্তু  শিক্ষার  মানের  ব্যাপারে  কিছু  বলা  না  বলা  সমান  ৷  কারণ   এ  সব  প্রতাষ্ঠানে  যারা  শিক্ষা  গ্রহণে  গমন  করেন  তাদের  কাছে  শধু  একটি  সনদই  বড়  ৷ যা  বিয়ে  শাদী  বা  সামাজিক  কারণে  দরকার  পড়ে  ,  জ্ঞান  অর্জনে  এসব  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের  কোনো  ভূমিকা     নেই  ৷   তাই  এসব  শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান এখন  বানিজ্যিক  প্রতিষ্ঠান  হিসেবে  পরিচিতি  পেয়েছে  সমাজে  ৷

                 অন্যদিকে  দেশে  বর্তমানে  শিক্ষা  ব্যবস্থায় ,   সাধারণ  শিক্ষা  এবং  মাদ্রাসা  শিক্ষা  ব্যবস্থা  নামে  দু’ভাগে  বিভক্ত  হয়ে  আছে  দেশের  শিক্ষা  ব্যবস্থা  ৷  কিন্তু   জ্ঞান  অর্জনের  জন্যে  কোনো  শিক্ষাই  যথেষ্ট  নয়  ৷  সাধারণ  শিক্ষায়  শুধু  সনদ  প্রাপ্তি  ঘটে ,প্রকৃত  কোনো জ্ঞান  অর্জন  হয়  না  ৷  মাদ্রাসা  শিক্ষা  আবার  আলীয়া  ও  কওমি  দু’ধারায়  বিভক্ত  , তবে  কোনো  ধারাতেই  না  হয়  সঠিক  ধর্মশিক্ষা  না  হয়  সাধারণ  শিক্ষার  জ্ঞান  ৷

                 অভিজাত ও  ধনবান  শ্রেণীরা  আর  এক  শিক্ষা ব্যবস্থা ও  দেশে  চালু  করেছেন ৷ সেসব  শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানে  ইংলেন্ড  বা  আমেরিকার  শিক্ষাকার্যক্রম  অনুসরণ  করা  হয়  ৷  এসবের  শিক্ষার্থিরা   ও  এবং  এ  লেভেল  ও  জিসিইসি  বা  সমপর্যায়ের  শিক্ষাকোর্স  সমাপ্তের  পর  উচ্চ-শিক্ষার্থে  বিদেশে  চলে  গিয়ে  বিদেশের  মাটিতে  বসবাসের  ব্যবস্থা  করেন ৷ স্বভাবতই  দেশের প্রতি  এদের কোনো  টান  থাকে  না  ৷  তারা  দেশের  বা  দশের  কোনো  উপকারে  আসেন  না  ৷  কিন্তু  তাদের  মাধ্যমে  দেশে  অন্য  দেশের  কালচারের  বিস্তার  ঘটে  থাকে , যা  দেশের  জন্য  অনেক  সময়ে  বিরূপ  প্রতিক্রিয়ার  সৃষ্টি  করে  থাকে  ৷  আর  যারা  বিদেশে  যেতে  পারেন  না ,  তাদেরকেও  নিরাশ  করা  হয়  নাই  ,  দেশে  ঐসব  কোর্সের  বিশ্ববিদ্যালয়  পর্যায়ের  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের  ও  প্রতিষ্ঠা  করা  হয়েছে  ৷ 
            এসব  অশিক্ষা  কুশিক্ষার  এবং  অপশিক্ষার  সঙ্গে  বর্তমানে  যোগ  হয়েছে  ধর্মীয় ও রাজনীতিক  আর  এক  হিজাবী শিক্ষা  ব্যবস্থা  ৷  দেশে  ধর্মীয়  রাজনীতির  একট  ক্যাডার  ভিত্তিক  গোষ্ঠীর  সৃষ্টি  সম্পূর্ণ  হয়ে  গেছে  এরই  মধ্যে  ৷  তারা  ইসলাম  পন্থী  জঙ্গী  সংগঠন  তৈরি  করে  তাদের  প্রয়োজনীয়  ট্রেইনিং  এর  ব্যবস্থা  করে  ফেলেছেন  ৷  সময়  ও  সুযোগে  তারা  দেশে  যে  কোনো  মুহূর্তে  ইসলামী  বিপ্লবে  ঝাপিয়ে  পড়তে  প্রস্তুত ৷  অন্যদিকে  দেশে  অবাধ  ও  মুক্ত  বাজার  অর্থনীতির  কারণে  এবং  সরকারের  প্রত্যক্ষ্য  এবং  পরোক্ষ্য  সহযোগীতায়  একটি  আর্দশবিহীন  এবং  পরগাছা  ফাও  খাওয়া  শ্রেণীর  আবির্ভাব  ঘটেছে ৷   অবার  অদূরদর্শী  সরকার  আইনকরে  দেশে  মুক্তচিন্তা  বন্ধ  করে  দিয়েছে  ৷ ব্লগের  মাধ্যমে  ইনটারনেটে  কিছু  মুক্ত  চিন্তাধারা  বিস্তারের  প্রচেষ্টায়  নিয়োজিতদের  কার্যক্রম  বন্ধ করতে  এই  আইন  করা  হয়েছে ,  যা  করে  ধর্মব্যবসায়ীদরকেও  খূসি  করা  গেছে,  সাময়িক  ভাবে  হলেও  ৷  তাই   এসবের  ফলোশ্রুততে  গত  কয়েক  দশকের  পূর্বে  সমাজে   বিদ্যমান  জাতিয়  মতাদর্শগত পার্থক্যের   আদর্শ  আবার   সমাজে ফিরে  আসতে  শুরু  হয়ে  গেছে  ৷

             এই  মতাদর্শের   পার্থক্যকে  ইসলামী  ঈমানী  বিশ্বাসে রূপান্তরিত করে  এবং  ইহাকে  ধর্মীয়  ভাবধারায়   পুঁজি    করে  একটি  জাতি  বিদ্ধেষী  শ্রেণীর    আবির্ভাব  সম্পূর্ণ  হয়ে  গেছে  এরই  মধ্যে  দেশের  ভেতরে এবং  বাহিরে  অর্থাৎ  প্রবাসে ৷  এখন  তারা  সময় ও সুযোগের  এবং  একটি   কার্যকর    আদেশের  অপেক্ষায়  আছে  ৷

             এখন  যারা  অন্ততঃ  এই  ব্যাপারটি  উপলব্দি  করতে  পারছেন  তারা  সধ্যমত  তাদের  যার  যার  অবস্থান  থেকে  প্রতিরোধের  ব্যবস্থা  করবেন,  এই  বিশ্বাসে  এবং  সতেরো  শতকের  পূর্ববঙ্গের  কবি  আব্দুল  হাকিমের  নুরনামা  নামক  গ্রন্থের  একটি  কবিতার  কয়েক  লাইন  উল্লেখ  করে  এই  লেখাটা  শেষ  করছি  ৷
     
  “  যে  সব  বঙ্গেতে  জন্মে  হিংসে  বঙ্গবাণী 
     সে  সব  কাহার  জন্ম  নির্ণয়  না  জানি
      দেশী  ভাষা  বিদ্যা  যার  মনে  না  জুগায়
     নিজ  দেশ  ত্যাগী  কেন বিদেশ  না  যায়  ” ৷

মন্তব্যসমূহ