ইসলামের ইতিহাসের আলোকে শিয়া ও সুন্নি ধারার বিকাশের কাহিনি : ( ১ম পর্বের ১ম অংশ )


   
                             ইসলামে  শিয়া  ও  সুন্নি   ধারার  বিকাশের  কাহিনি :  ( প্রথম  পর্ব  )

             নবীজী(সঃ) এর ইসলাম , খলিফাহ্ দের শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার 
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে 

          সূচনা :   খ্রিস্টিয়  ৫৭০  সালে মক্কায়  জন্মগ্রহনকারি  মুহাম্মদ  ইবনে  আবদাল্লাহ্  (  পয়গম্বর  মুহাম্মদ  সঃ  ৫৭০ - ৬৩২ )  আল্লাহ্ র  ইচ্ছায়  ৬১০  সালে  কোরানের  প্রথম  প্রত্যাদেশ  বা  ওহী  লাভ  করেন  ৷  ওহী  লাভের  প্রায়  দু’বছর  পর  ইসলাম  ধর্ম  প্রচার  শুরু  করেন  ৷ তাঁর  প্রচারিত  ধর্মকে  ইসলাম  ( আল্লাহ্ র  ইচ্ছার  প্রতি  “   আত্মসমর্পণ    ” )  নামে  অভিহিত  হয়  ৷  একজন  মুসলিম  নারী  বা  পুরুষ   ,  যে  তার  সমগ্র  সত্তা  আল্লাহ্  এবং  তাঁর  ইচ্ছা  অনুসারে  , যে  মানুষ  পরস্পরের  সঙ্গে  ন্যায়সঙ্গত ও  সাম্য  আর  সহানুভুতির  সঙ্গে  ব্যবহার  করবে ,  তার  প্রতি আত্ম সমর্পণ  করাই  ইসলামের  মূল  আদর্শ  ৷  ৬২২  সালে  আল্লাহ্ র  হুকুমে  পয়গম্বর  মুহাম্মদ ( সঃ ) মদীনায়  হিজরত  করেন  ৷  হিজরতের  সময়  থেকে  মুসলিম  বছর  গণনার  সূচনা  ঘটে  ৷

          ৬৩০  সালে  মক্কাবাসীরা  হুদাইবিয়ার  সন্দি  লঙ্ঘন  করে  ৷  তখন  পয়গম্বর  মুহাম্মদ  ( সঃ ) তাঁর  অনুসারী   মুসলিম  এবং  মিত্রদের  নিয়ে  মক্কা  অভিমুখে  যাত্রা  করেন  ৷  পরাজয়  টের  পেয়ে  মক্কাবাসীরা  স্বেচ্ছায়  মুহাম্মদ ( সঃ ) এবং  তাঁর   অনুসারিদের  জন্যে  মক্কার  পথ  খুলে  দেয়  এবং   তিনি  বিনারক্তপাতে  ও  কাউকে  ধর্মান্তরিতকরণে  বাধ্য  না  করেই  মক্কা  নগরী  অধিকার  করে  নেন  ৷

         ৬৩২  সালে  পয়গম্বর  মুহাম্মদ ( সঃ )  তাঁর  কোনো  উত্তরাধিকার  নিযুক্ত  করার  আগেই  পরলোক  গমন  করেন  ৷  ৬৩২  সালে  আবুবকর  ( রা )  তাঁর  খলিফাহ্  বা  প্রতিনিধি  নির্বাচিত  হন  ৷
         
        সুন্নি  ইসলাম :  ইসলামের  সংখ্যাগরিষ্ঠরা  যারা   পয়গম্বর   মুহাম্মদের ( সঃ ) স্বভাব  ও  ধর্মীয়  অনুশীলনের  রীতি  বা  সুন্নাহ্   মেনে  চলে  তারাই  সুন্নি  মুসলিম  বা  সুন্নি  নামে  পরিচিত  ৷  সুন্নিরা  শিয়াদরকেও  মুসলিম  হিসেবে  মানে  কিন্তু  মুসলিম  শাসকদের  পয়গম্বর  মুহাম্মদ ( সঃ) ও  তাঁর  মেয়ের  জামাই  আলী  ইবনে  আবি  তালিবের  বংশধরদের  থেকেই  যে  মুসলিম  সম্প্রদায়ের  শাসক  নিযুক্ত  হতে  হবে  সুন্নিরা  সেটা   বিশ্বাস  করে  না  ৷ যেমন  শিয়ারা  বিশ্বাস  করে  ৷

          শিয়া  ইসলাম :   ইসলামের  সংখ্যালঘু  গোষ্ঠি  যারা  সুন্নি  থেকে  ধর্মতত্তীয়  ভাবে  ভিন্ন ,  কিন্তু  আন্তরিক  ভাবে  বিশ্বাস  করে  যে  পয়গম্বর  মুহাম্মদের ( সঃ ) একমাত্র  বংশধরদেরই  মুসলিম  সম্প্রদায়ের  নেতূত্ব  দেয়া  উচিত  ৷  এই  চিন্তাধারার  অনুসারীদেরকে  শিয়া   বা   শিয়ামুসলিম  নামে  অভিহিত  করা  হয়  ৷  শিয়ারা  বিশ্বাস  করে  যে  খলিফাদের  নির্বাচনে  পয়গম্বরের  নিকট  পুরুষ  আত্মীয়  আলীকে  নির্বাচন  করা  উচিত  ছিল  ৷  শিয়ারা  বেশ  কয়েকজন ( ৬জন   বা  ১২  জন  ) ঈমামকে  মানে ,  যারা  আলী  বা  ফাতেমার  প্রত্যক্ষ  পুরুষ  বংশধর  বা  তাদের  মনোনিত  কোনো  ইমাম  ৷  তবে  সুন্নি  ও  শিয়াদের  মত  পার্থক্য  সম্পূর্ণ   রাজনৈতিক  , ধর্মীয়  বিশ্বাসে   কোনো  পার্থক্য  নাই  ৷


          পয়গম্বরের (সঃ) এর  পরলোকগমনের  পর  মুসলিম  উম্মাহ্  অর্থাৎ  মুসলমানদের  নিয়ন্ত্রিত  এলাকাকে  ঐক্যবদ্ধ  সমাজ  হিসেবে ধরে  রাখতে  সংখ্যাগরিষ্ঠ  ভোটে  আবুবকরকে (রা) পয়গম্বরের  পর  প্রথম  ইসলামের  খলিফাহ্  নির্বাচিত  করা  হয়  ৷ তবে  অনেকের  বিশ্বাস  ছিল  যে  মুহাম্মদের  (সঃ)  নিকট   আত্মীয়  ও  ঘনিষ্ঠ  পুরুষ  আলী  ইবনে  আবি  তালিবকে (রা)  উত্তরাধিকারী  হিসেবে  প্রথম  ইসলামের  খলিফাহ্  নিযুক্ত  করা  হবে  ৷ কিন্তু  আলী  তখনও   তরুণ  এবং  অনভিজ্ঞ  থাকায়  এবং  ভোটে  আবুবকরকেই  খলিফাহ্  নির্বাচিত  করা  হয়  মুসলিম  উম্মাহ্ র  বৃহত্তর  স্বার্থে  ৷  তখনই  রাজনীতির  স্থান    ধর্মের  উপরে  নির্ধারিত  হতে  শুরু  হয়ে  যায়  !
তবে  আবুবকরের  শাসনকাল  ( ৬৩২ -৩৪ ) খুবই  সংক্ষিপ্ত  ও  সংঙ্কটময়  ছিল  ৷

          তখন  বিভিন্ন  গোত্র  মুসলিম  উম্মাহ্  থেকে  বিচ্ছিন্ন  হয়ে  তাদের  সাবেক  স্বাধীনতা  ফিরে  পাওয়ার  চেষ্টা  আরম্ভ  করে  ৷  অন্যদিকে  মিথ্যা   বা  ফলস্  নবীর  আবির্ভাব   হওয়া  শুরু  হয়  বিভিন্ন  স্থানে  ৷  ইসলামী  কনফেডারেসিতে  যোগ  দেয়া  বেশীরভাগ  বেদুঈন  গোত্রেরই  ইসলাম   ধর্মের  বিস্তারিত  আদর্শ  ও  নিয়ম  কানুনে  আগ্রহী  ছিল  না  ৷  তারা   তাদের  নিজেদের  গোত্রের  অর্থনৈতিক  স্বার্থে  ইসলামী  কনফেডারেশনে  যোগ  দিয়ে  ছিল  ৷  তাই  তারা  রাজনৈতিক  ও  অর্থনৈতিক  কারণে   বিদ্রোহের  সূচনা  করে  ছিল  ৷  ফলে  আবুবকরকে  প্রথমেই  রিদ্দাহ্  বা  এই  ধরণের  উম্মাহ্  ত্যাগীদের  তথা   ধর্মত্যাগীদের  বিরুদ্ধে  মোকাবেলা  করতে  হয়েছে  ৷  তবে  আবুবকর  তাঁর  প্রজ্ঞা  ও রাজনৈতিক  বিবেচনা  প্রশূত  ক্ষমা  প্রদর্শনের  মাধ্যমে  এসব  বিদ্রোহ  প্রশমিত  করতে  পেরেছেন  ৷  অন্যদিকে  বিদ্রোহীদের  অভিযোগ  রাজনৈতিক  ও  ধর্মীয়  সৃজনশীলতার  সঙ্গে  সমাধান  করেছেন  কোনো  রকম  প্রতিশোধমূলক  ব্যবস্থা  ছাডাই  ৷ তবে  বিদ্রোহীদের  অনেকে  লোভনীয়  গাযু  হামলায়  অংশ  নেয়ার  সম্ভাবনা  দেখেও   দল  ত্যাগের  পর  ফিরে  আসে  ৷  (  প্রাক- ইসলামী  যুগে  আরবরা অন্য  গোত্রের  মলামাল  লণ্ঠিত  করার  উদ্দেশ্যে  গাযু  হামলা  পরিচালিত  করত ; পরে  ইসলাম  ধর্মের  প্রসারের  যুদ্ধে  এই  গাযুকে  ব্যবহার  করা  হত  সামরিক  আক্রমন  বা  অভিযান  নাম  দিয়ে  ৷  আর  লুণ্ঠিত  মালামাল  অংশগ্রহনকারীদের  মধ্যে  ভাগাভাগীর  মাধ্যমে  বিতরণ  কারার  পদ্ধতি  চালু  ছিল  ,  তখনও  ৷

          ৬৩৪  সালে  প্রথম  খলিফাহ্  আবুবকর (রা) এর   স্বাভাবিক  ইন্তাকাল  হয়  ৷  তখন  ইসলামের  দ্বিতীয়  খলিফাহ্  নিবার্চিত  হন  উমর  ইবনে  আল-খাত্তাব ( ৬৩৪-৪৪ ) ৷  তিনি  প্রায়  ১০  বছর  শাসনকার্য   পরিচালনা  করেন  মুসলিম  উম্মাহ্ র  ৷ এই  সময়ে  সামরিক  অভিযানে  নতুন  গতি  পায়  ৷  শত  শত  বছর  ধরে  আরবরা  তাদের  সম্পদের  প্রয়োজন  মিটিয়ে  এসে  ছিল  অন্যের  সম্পদের  ওপর  গাযু   বা  হামলা  করে  আনা   লুণ্ঠনের   মালামাল  দ্বারা  ৷  তখন  বিভিন্ন  গোত্রের  ও  সম্প্রদায়ের  মধ্যে  হানাহানি  ও  বিবাদে  এবং  যুদ্ধে  নিজেদের  যে  শক্তি  ও  সময়  ও  সম্পদ  ক্ষয়  বা  ব্যয়  হত  তা  তখন  কেন্দ্রীয়ভাবে  প্রতিবেশী  দেশসমূহের  অমুসলিম  গোষ্ঠীগুলোর  ওপর  আক্রমনে  ব্যয়  করা  আরম্ভ  করা  হয়  ৷  ফলে  মুসলিম   উম্মাহ্  ,  অর্থাৎ  তখনকার  পেনিনসুলায়  এক  নয়া  ইসলামী  শক্তির  আবির্ভাব     ঘটে  ৷  খলিফাহ্  উমর  (রা) ধীরে  ধীরে  উম্মাহ্ র  আইন ও শৃঙ্ঘলা  নিয়ন্ত্রন  করতে  সমর্থ  হন ,  যা  সম্ভব  ছিলনা  পূর্বে  গোত্রে  গোত্রে  যুদ্ধ  ও  বিবাদের  জন্যে  ৷  তাই  উম্মাহ্ র  ঐক্যের  সঙ্গে  সঙ্গে  খলিফাহ্  উমরের  কর্তৃত্বও  বৃদ্ধি  পায়  ৷  উমর  তখন  নিজকে  আমির  আল -মুমিনিন  বা  বিশ্বাসীদের  নেতারূপে  প্রতিষ্ঠা   করতে  সক্ষম  হন  ৷  কিছু   ব্যক্তিগত  ব্যতিক্রম  ছাড়া  উম্মাহ্ র  সবাই  উমরের  কমান্ড  মেনে    নিত  ৷  তাঁর  নেতৃত্বে  আরবরা  এই  সময়ে  ইরাক ,  সিরিয়া  ও  মিশরে  হাজির  হয়েছিল  ৷  ৬৩৭  সালে  কাদিসিয়াহ্ র  যুদ্ধে  পারসিয়ানদের  পরাজিত  করে  স্যাসানিয়  রাজধানী  সেসিফন  দখল  করে  নেয়  তারা  ৷  পর্যাপ্ত   লোকবল  সংগ্রহ  হওয়া মাত্রই  মুসলিমরা  এভাবে  গোটা  পারসিয়ান  সাম্রাজ্য  অধিকার  করে  ফেলে  ৷  এভাবে  তারা  প্যালেস্টাইন  ,  জেরুজালেম,   মিশর  ও  সিরিয়া  দখল  করতে  সক্ষম  হয়  ৷  বদরের  যুদ্ধের  মাত্র  ২০  বছর  পর  আরবরা  নিজদেরকে  এক  বড়ো  সাম্রাজ্যের  মালিক  হিসাবে  দেখতে  পায়  ৷  একে  আরবরা   ইসলামের   ও  আল্লাহ্ র  এক  অলৌকিক  ঘটনা  বলে  ধরে  নিয়ে  পবিত্র  কোরানের  বাণীকে  অত্যাধিক   গুরুত্ব  দিয়ে তা সত্য  বলে  দেখতে  আরম্ভ  করে  ৷  তখন  তাদের  ধারণা  জন্মে  যে  সঠিক  পথে  পরিচালিত  সমাজ  অবশ্যই  সমৃদ্ধি  অর্জন  করবে ,  যা   কোরানের  আইনের  সঙ্গে  সঙ্গিতপূর্ণ  এবং  আল্লাহ্ র  কাছে  তাদের   আত্মসমর্পনের  ফল  সরূপই  তা  তারা  অর্জনে  সক্ষম  হয়েছে ৷  পরবর্তী  সময়ে  মুসলিমরা    এক  সুবিশাল  সাম্রাজ্যের  প্রতিষ্ঠা  করে  ৷  তখন  তারা  এই  বিজয়ের  ধর্মীয়  ব্যাখ্যা  দিয়ে  বলেছে  যে  গোটা  বিশ্ব  দার  আল-ইসলাম  বা  ইসলামের  ঘর  এবং  দার  আল-হার্ব  বা  যুদ্ধের  ঘর  হিসেবে  বিভক্ত  হয়ে  গেছে ,  ইসলাম  প্রতিষ্ঠার  ফলে  ৷  আর  মুসলিমরা  এর  সঙ্গে  চিরন্তন  যুদ্ধে    লিপ্ত  ৷  কিন্তু  বাস্তব  ক্ষেত্রে  মুসলিমরা  এক  পর্যায়ে  এসে  মেনে  নিয়েছে  যে  এতদিন  তারা  তাদের  সম্প্রসারণের  শেষ  সীমায়  পৌঁছে  গেছে  , এখন  থেকে  অমুসলিম  বিশ্বের সঙ্গে আন্তরিকভাবেই  সহাবস্থান  করতে  হবে  ৷  কোরানও  যুদ্ধ-বিগ্রহকে  সবক্ষেত্রে  পছন্দ  করেনি   এটা  শুধু  আত্মরক্ষার  ক্ষেত্র  এবং  ন্যায়  যুদ্ধে  প্রযোজ্য   ৷ ইসলাম  হত্যা  আর  আগ্রাসনের  নিন্দা  করে  থাকে  ৷  তখন  আরবরা  মনে  করতো  ঐশীগ্রন্থধারী  জাতি  সবাই  আহল  আল-কিতাবের  অন্তর্ভুক্ত  ৷  তাই  তাদের  জোর  করে  ইসলাম  ধর্মে  দীক্ষিত  করা  উচিত  নয়  ৷  প্রকৃতপক্ষে  অষ্টম  শতাব্দীর  মাঝামাঝি  সময়ের  আগ  পর্যন্ত  ধর্মান্তরকরণকে  উৎসাহিত  করা  হয়নি  ৷  সামরিক  নিরাপত্তার  বিনিময়ে  জিম্মিরা  পোল  ট্যাক্স  প্রদান  করত  এবং  কোরানের  নির্দেশনা  অনুযায়ী  তাদের  নিজস্ব  ধর্ম  বিশ্বাসের  অনুশীলন  করার  অনুমতি  পেত  ৷

          উমর  ছিলেন  কঠোর  শৃঙ্খলা  বজায়  রাখার  ব্যাপারে  বদ্ধপরিকর  ৷  আরব  সৈন্যদের  বিজয়ের   ফল  ভোগ  করার  সাধ্য  ছিল  না  : অধিকৃত  সকল  এলাকা  পূর্বের  মত   সেনা  প্রধানদের  মাঝে  বণ্টিত  হত  না , বরং  বর্তমান  আবাদীদের  হাতেই  রাখা  হত  মুসলিম  রাষ্ট্রকে  খাজনা  প্রদানের  বিনিময়ে  ৷  মুসলিমদের  নগরে  বসতি  স্থাপনের  অনুমতি  দেয়া  হত  না  ৷  কৌশলগত  স্থানে  তাদের  জন্যে  গ্যারিসন  শহর  নির্মান  করে  তাদের  সেখানে থাকতে  দেয়া  হত  ৷  পুরনো  শহরের  মধ্যে  একমাত্র  দামাস্কাসই  মুসলিম  কেন্দ্রে  পরিনত  হয়েছিল  ৷  প্রত্যেক  গ্যারিসনে  মসজিদ  নির্মান  করে  সৈন্যদের  ইসলামী  জীবনযাপনের  শিক্ষা  দেয়া  হত  ৷  উমর  ইসলামী  মূল্যবোধের  গুরুত্বের  ওপর  জোর  দিয়েছেন  এবং  নিজে  পয়গম্বরের  মত  সধাসিধে  জীবনযাপন  করে  গেছেন  ৷  তবে  ইসলাম  আবশ্যিকভাবেই  আরবীয়  ধর্ম  ছিল  ৷  কোনো  জিম্মি  ধর্মান্তরিত  হলে  তাকে  বাধ্যতামূলকভাবে  যে  কোনো  একটি  গ্রত্রের  আশ্রিত  বা  ক্লায়েন্ট  হতে  হত  এবং  সে  একসময়  আরবীয়  ব্যবস্থায়  অঙ্গীভূত  হয়ে  যেত  ৷  কিন্তু  ৬৪৪  সালের  নভেম্বরে  মদীনার  মসজিদে  ব্যক্তিগতভাবে  ক্ষুব্ধ  এক  পারসিয়ান  যুদ্ধ  বন্দীর  হাতে  উমর  ছুরিকাহত  হয়ে  ইন্তেকাল  করেন  এবং তাঁর  সময়ের    বিজয়ের  এই  ধারা  হঠাৎ  রুদ্ধ  হয়ে  যায়  ৷ 

          ইসলামের   তৃতীয়  খলিফাহ্  উসমান  ইবনে  আফফান ( ৬৪৪-৫৬ )  মুহাম্মদ(সঃ) এর  মেয়ে  জামাই  এবং  ধর্মগ্রহণকারীদের  অন্যতম  ছিলেন  ৷  তাঁর  হত্যাকাণ্ডের  ফলে  ইসলামী  উম্মাহয়  প্রথম  ফিৎনাহ্  যুদ্ধের  সূচিত  হয়েছিল  ৷ 

          উসমান  ইবনে  আফফান  পয়গম্বরের  সহচরদের  ৬  জন  দ্বারা  খলিফাহ্  নির্বাচিত  হয়েছিলেন  ৷  প্রথম  দু’জনের  তুলনায়  তাকে  অনেকে  দুর্বল  ব্যক্তিত্বের  অধিকারী  মনে  করতেন  ৷  কিন্তু  তাঁর  আমলের  প্রথম  ছ’টি  বছর  উম্মাহ্ র  সমৃদ্ধি  অব্যাহত  ছিল  ৷  তিনি  চমৎকার  শাসনকাজ  পরিচালনা  করছেন  এবং  তাঁর  সময়েও  মুসলিমরা  নিত্য  নতুন  অঞ্চল  দখল  করেছে  ৷   তখন  তারা  সাইপ্রাস , ত্রিপোলি  ও   আর্মেনিয়ার  অনেক  অংশ  দখলের  পর  ককেশাস  এবং  ইরানের  ওক্সাস  নদী  অবধি  এবং  আফগানিস্তানের  হেরাত  আর  ভারতীয়  উপমহাদেশের  সিন্দে  মুসলিম  শাসন  প্রতিষ্ঠা  করে  ৷

          এসব  বিজয়  সত্তেও  সৈন্যরা  অসন্ত্তষ্ট  হয়ে   উঠতে  শুরু  করেছিল  ৷  সৈন্যদের  মধ্যে  ব্যাপক  পরিবর্তন  ঘটতে  আরম্ভ  করেছিল  এই  সময়ে  ৷  কারণ  মাত্র  এক  দশক  সময়কালের  মধ্যে  তারা  একটি  কঠিন  যাযাবর  জীবনধারার  বিনিময়ে  এক  পেশাদার  সেনাবাহিনীর  একেবারে  ভিন্ন  জীবন  ধারা  বেছে  নিতে  হয়েছিল  ৷  গ্রীস্মকাল  যুদ্ধ  করে  আর  শীতকালে  বাড়ি  থেকে  দূরে  গ্যারিসন  শহরে  তাদের  দিন  কাটাতে  হচ্ছিল  ৷  অভিযান  স্থানের  দূরত্ব  ও  ব্যাপক  হয়ে  যাওয়ায়  এ  সব  অভিযানগুলো  অনেকের  কাছে  ক্লান্তিকর  হয়ে  উঠেছিল  ,  আর  আগের  তুলনায়  লুণ্ঠিত  মালের  পরিমাণও  কমে  গিয়েছিল  ৷  অন্যদিকে  সেনাপ্রধান  ও  ধনী  মক্কাবাসীকে  ইরাকের  মত  দেশগুলোয়  ব্যক্তিগত  এস্টেট  স্থাপনে  বাধা  দিচ্ছিলেন খলিফাহ্ ,  ফলে  কুফাহ্  এবং  ফুস্ট্যাস্টে  তাঁর  জনপ্রিয়তা  কমে  যায়  ৷  মুয়াবিয়াহ্ কে  সিরিয়ার  গভর্নের  নিয়োগ ও মদীনাবাসী  ভালভাবে  গ্রহণ  করেনি   ৷  কোরান  যারা     মুখস্থ  করে  রেখেছিল  তাদেরকে  কেবল  একটি  পাঠ  ব্যবহারে  উসমানের  জোর  প্রযোগকে  ও  অনেকে    না  মেনে  তাঁর  ওপর  ক্ষুব্ধ  হয়ে  ওঠে  ৷  আলী ,  উমর  এবং  উসমান  উভয়ের  নীতির  বিরোধী  ছিলেন  ৷  তাই  তাঁর  প্রতি  অসন্ত্তষ্ট  গোষ্ঠীটি  আলীর  মুখাপেক্ষী  হতে  শুরু  করে  :   আলী  আবার  রাষ্ট্রের  কেন্দ্রীয়  কর্তৃত্বের  বিরুদ্ধে  এবং  সেনাদলের  অধিকারের  পক্ষে  অবস্থান  নিয়েছিলেন  ৷

          ফলে  ৬৫৬  সালে  এসব  অসন্তোষ  স্পষ্ট  বিদ্রোহের  রূপ  নেয়  ৷  তখন  আরব  সেনাদের  একটি  দল  তাদের  মতে  তাদের  ন্যায্য  প্রাপ্য  বুঝে  নিতে  ফুস্ট্যাট  থেকে  মদীনায়  ফিরে  এসেছিল  ৷  উসমান  তাদরকে  খালিহাতে  ফিরিয়ে  দিলে তারা  জোর  করে  ভেতরে  প্রবেশ  করে  উসমানকে  হত্যা  করে  এবং  পরে  বিদ্রোহীরা  আলীকে  নতুন  খলিফাহ্  হিসেবে  ঘোষণা  করে  ৷ 
শান্তির  ধর্ম   ও  আল্লাহ্ র  কাছে  আত্মসমর্থনের  ধর্ম   ইসলাম  এক  নতুন  রাজনৈতিক ধর্ম  রূপে   আবির্ভূত  হওয়া  শুরু   হয়ে  যায়  পয়গম্বর (সঃ) ইন্তেকালের  মাত্র  ২৪ / ২৫  বছর  পূর্ণ  হতে  না  হতেই  ৷  ইসলাম  ধর্ম  গ্রহণকারীদের  মধ্যে  অনেকেই  যে   তাদের  সম্পদ  ও  ক্ষমতা  বৃদ্ধির  একটা  নতুন  উপায়  হিসেবে  এটি  গ্রহণ  করেছিল , তা  ক্রমেই  স্পষ্ট  হতে   শুরু  হয়ে  পড়ে  নবীজীর  ইন্তেকালের  ২০  বছরের  মধ্যেই  ৷

          আলী  ইবনে  আবি  তালিব : পয়গম্বর  মুহাম্মদের  (সঃ )  চাচাত  ভাই , রক্ষী ,  এবং  মেয়ে-জামাই   আর  তাঁর  নিকটতম  পুরুষ  আত্মীয়  ৷  ৬৫৬  সালে  তাঁকে  অগণতান্ত্রিক  ভাবে  ইসলামের  চতুর্থ  খলিফাহ্  নিযুক্ত  করা  হয়  ৷  শিয়ারা  বিশ্বাস  করে যে আলীই  পয়গম্বরের  পরবর্তী  উত্তরাধিকারী  হওয়া  উচিত  ছিল  তাই  শিয়ারা  আলীকে  ইসলামী  সমাজের  প্রথম  ইমাম  হিসেবে  শ্রদ্ধা  করে  ৷  ইরাকের  নাজাফে  তার  সমাধি  রয়েছে  যা  শিয়া  তীর্থযাত্রীদের    অন্যতম  প্রধান  স্থান  ৷  কিন্তু  ৬৬১  সালে  জনৈক  খারেজি  চরমপন্থীর  হাতে তিনি নিহত  হন  ৷ আলী  খলিফাহ্  হিসেবে  যোগতম  ছিলেন  এবং  দক্ষ  সৈনিকও  ছিলেন  ৷  সৈন্যদের  উৎসাহ  দিয়ে  আলী  যে  সব  পত্র  লিখেছিলেন  তা  আজও  ধ্রুপদী  মুসলিম  বিবরণ  হিসেবে  টিকে  আছে  ৷  তিনি  ন্যায়  বিচার  এবং  প্রজা  সাধারণকে  ভালোবাসার  শিক্ষা  মুসলিম  সমাজে  প্রতিষ্ঠার  চেষ্টা     করেছেন  ৷  এরপরও  তাঁর  শাসন  সর্বজনীনভাবে  গৃহীত  হয়নি  ৷ তখন  থেকেই  ইসলামী  বিশ্বাস  ও  মূল্যবোধ  থেকে   ব্যক্তি  স্বার্থ  ,  সম্পদ  আহোরণ  এবং  ক্ষমতা  দখলের  রাজনীতি  অনেকের  কাছে  আকর্ষণীয়  হয়   উঠে  ৷  মদীনার  আনসার  এবং  উমাইয়াহ্ দের  উথ্থানে  মক্কার  অসন্ত্তষ্ট  গোষ্ঠীর  সমর্থন  সহ  ঐতিহ্যবাহী  যাযাবর  জীবনযাপনকারী  ইরাকের  মুসলিমরাও  তাঁকে  সমর্থন  দিয়েছিল  ,  তাই  কুফাস্থ  গ্যারিসন  শহর  ছিল  আলীর  শক্তঘাঁটি  ৷  অন্যদিকে  উসমানের  বর্বর  হত্যাকাণ্ড  মুসলিম  উম্মাহ্য়  ৫  বছর  মেয়াদী  গৃহযুদ্ধের  সূচনা  করেছিল ,  যাকে  ইসলামের  প্রথম  ফিৎনাহ্  হিসেবে  গণ্য  করা  হয়  ৷

          সংক্ষিপ্ত  সময়  দিয়ে  আলীর  কাছে  উসমানের  হত্যাকারীদের  বিচার  না  পেয়ে  বিবি  আয়েশা  এবং  সাহাবী  যুবায়ের  আলীর  ওপর  হামলা  চালান  ৷  আলী  নিজেও  এই  হত্যার  বিচার  করতে  চেয়েছিলেন  ৷  কিন্তু  তাঁর  সমর্থকরা  উসমান  কোরানের  আদর্শ  অনুযায়ী  ন্যায়সঙ্গতভাবে  শাসন  করতে  ব্যর্থ  হয়েছেন  , তাই  মৃত্যু  তাঁর  প্রাপ্য  ছিল  এই  মতবাদে  বিশ্বাসী   ছিল  ৷  আলী  তাঁর  পক্ষাবলম্বনকারীদের  এই  দাবী  অগ্রায্য  করতে  না  পেরে  বিচার  বিলম্বিত    করছিলেন  ৷  আলীর  ওপর  হামলার  সময়ে  সেনাবাহিনী  বিভিন্ন  প্রদেশে  ছড়িয়ে  ছিল  , আর  বিদ্রোহীরা বিবি আয়েশার  পক্ষহয়ে  মদীনা  থেকে  বসরাহ্ র  দিকে  এগোতে  থাকলে  আলী  কুফাহ্য়  আশ্রয়  নিয়ে  সেখানে  রাজধানী  স্থাপন  করেন  ৷  পরে  সেনাবাহিনী  নিয়ে  এগিয়ে  যান  বসরাহ্ র  উদ্দেশ্যে  এবং  অতি  সহজে  উটের  যুদ্ধে  বিবি  আয়েশা  সহ  বিদ্রোহীদের  পরাজিত  করেন  ৷  এই  যুদ্ধে  বিবি  আয়েশা  সেনাদলের  সঙ্গে  উটের  পিঠে  বসে  যুদ্ধ  অবলোকন  করেছিলেন  বলে  একে  উটের  যুদ্ধ  বলা  হয়  ৷ বিজয়  অর্জনের  পর  আলী  তাঁর  সমর্থকদের  উচ্চপদে  আসীন  করেন  এবং  সম্পদ  ও  তাদের  মাঝে  ভাগ  করে  দেন  ৷  তবে খজনা  যোগাত   কুফাহ্ র যে  কৃষি  জমি  তাতে  সৈনিকের  অধিকার  প্রদান  করেন  নি  ৷  তাই  নিজ  দলকে  যেমন  সন্ত্তষ্ট  করতে  পারছিলেন  না  , তেমনি  উসমানের  হত্যাকারীর  বিচার  না  করতে  পারায়  ঘরে  বাইরে  তাঁর  নিন্দুকের  অভাব  ছিল  না  ৷  সিরিয়াতে  ও  আলীর  শাসন  মেনে  নেয়া  হয়নি  ৷  মুয়াবিয়াহ্  ছিলেন  উসমানের  আত্মীয়  এবং  উমাঈয়াহ্  গোত্রের  , তাই  একজন  আরব  গোত্রপ্রধান    হিসেবে  উসমানের  হত্যার  বদলা  নেয়ার  দায়িত্ব  ছিল  তাঁর  ৷  মুয়াবিয়াহ্ , দামাস্কাসের  তাঁর  রাজধানী  থেকে  আলীর  বিরোধী  পক্ষের  নেতৃত্ব  দিচ্ছিলেন  ৷  কিন্তু  ইসলামের  শিক্ষা  ছিল  মুসলিমদের  মাঝে  একতাবোধের  বিস্তার  করে  উম্মাহকে  সংগঠিত  করে  আল্লাহ্ র  একত্ব  প্রতিষ্ঠা  করা  ৷  কিন্তু  ক্ষমতার  যুদ্ধে  তা  অল্পদিনের  মধ্যেই  নষ্ট  হয়ে  যাচ্ছে  দেখে  কিছু  নিরপেক্ষ  লোক  আলী  ও  মুয়াবিয়াহ্  উভয়  পক্ষকে  নিয়ে  একটি  ফয়সালা  করার  ব্যবস্থা  করেন   ৷     এই  লক্ষ্যে  ৬৫৭  সালে  ইউফ্রেটিসের  সিফফিনের  এক  বসতিতে  আপস  আলোচনায়   মিলিত  হয়ে  যখন  কোনো  সিদ্ধান্ত  ছাড়াই  বৈঠক  শেষ  হয়ে  যায়  ৷   তখন  চতুর  ও  রাজনীতিক  মুয়াবিয়হ্    ও  তাঁর  সমর্থকরা  এই  সময়  বর্শার  শীর্ষে  কোরানের  কপি  বিঁধিয়ে  উপস্থিত  মুসলিমদের  প্রতি  আল্লাহ্ র  বাণী  মোতাবেক  প্রতিদ্বন্দ্বীদের  মাঝে  একটা  ফয়সালা  করার  আহ্বান  জানায়  ৷  ইহাই  বোধহয়  ইসলামর  ইতিহাসে  ধর্মের  প্রথম  রাজনৈতিক  ও  ক্ষমতা  দখলের  সফল  ব্যবহার  ৷ হঠাৎ  এ  ঘোষণায়  সবাই  যখন  নিরব  হয়ে  যায়  তখন সুকৌশলে  প্রচার  করা  হয়  যে  ,  সালিশের  ফলাফল    আলীর  বিপক্ষে  গিয়েছে,   মুয়াবিয়াহ্ র  জয়  হয়েছে  ৷  আর  তখনই   মুয়াবিয়াহ্  কাল  বিলম্ব  না  করে খলিফাহ্  আলীকে   পদচ্যুত  করেন  ও  ইরাকে  সেনা  প্রেরণ  করেন  এবং  জেরুজালেমে  নিজকে  খলিফাহ্  হিসেবে  ঘোষণা  দেন  ৷  ইসলাম  ও  কোরানের  রাজনৈতিকভাবে  ব্যবহার  করে   অন্যায়করীরাও  যে  সফল  হতে  পারে  ,  এ  ঘটনা  তারই  স্পষ্ট  প্রমান  ৷

          আলী  এ অন্যায়   রায়  মেনে  নিতে  সম্মত  হয়ে   যাচ্ছেন   দেখে  আলীর  কিছু  চরমপন্থী  সমর্থক  সালিশের  রায়  মেনে  নিতে  অস্বীকৃতি  জানায় ৷  কারণ  তাদের  দৃষ্টিতে  উসমান  কোরানের  নির্দিষ্ট  মান  অনুযায়ী  চলতে  ব্যর্থ  হয়েছিলেন  ৷  আলী  ও  উসমানের  ভুল  শোধরানোতে  ব্যর্থ  হয়ে  অন্যায়ের  সমর্থকদের  সঙ্গে  আপোস  করেছেন  , সুতরাং  আলীও  উসমানের  মত  এখন  আর  প্রকৃত  মুসলিম  নন  ৷  তাদের  মতে  আল্লাহ্  মানবজাতিকে  স্বাধীন  ইচ্ছা  দান  করেছেন  ৷  তারা  তখন  মুসলিমদের  ভাবতে বাধ্য  করেছিল  যে  কে  প্রকৃত  মুসলিম  আর  কে  নয়  সেটা  বিবেচনা  করতে  ৷  এই  পর্যায়ে  তারা  উম্মাহ্  থেকে  নিজদের  বিচ্ছিন্ন  করে  নেয়  এই  যুক্তিতে  যে  , যারা  কোরানের  চেতনার  সঙ্গে  বিশ্বাসঘাতকতা  করতেছে  তাদের  সাথে  তারা  কিছুতেই  একত্রে  থাকতে  পারে  না  ৷  তাই  তারা  একজন  স্বাধীন  কমান্ডারের  অধীনে  নিজস্ব  শিবির  স্থাপন  করে  আলাদা  হয়ে  যায়  ৷  যাদেরকে পরে  খারেজি  বা  বিচ্ছিন্নতাবাদী  বলা  হয়ে  থাকে  ৷ খারেজিরা  আগাগোড়া  সংখ্যালঘু  দল  , কিন্তু  ইসলামের   ইতিহাসে  শিয়া  ও  সুন্নি  ধারার  পূর্বেই  খারেজিরা  একটি  উপ-ধারার  সৃষ্টি  করেছিল  ৷  তাদের  মতে  ইসলামী  গোষ্ঠীর  শাসককে  সবচেয়ে  শক্তিশালী  শাসক  না  হয়ে  সবচেয়ে  নিবেদিত  মুসলিম  হতে  হবে  ৷  খলিফাহ্ দের  মুয়াবিয়াহ্ র  মত  রাজনৈতিক  ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী  হওয়া  উচিত  নয়  ৷ 

          আলী  এসব  চরমপন্থীদের  দমন  করলেও  গোটা  সাম্রাজ্যে  আন্দোলন  বেগবান  হয়ে  উঠে  ৷  খারেজিদের  প্রতি  আলীর  কঠোর  আচরণে   কুফাহ্  সহ   তাঁর  বহু  সমর্থক  তাঁর  প্রতি  সমর্থন  প্রত্যাহার  করায়  মুয়াবিয়াহ্  ক্রমশঃ  শক্তিশালী  হয়ে  ওঠেন  ৷  এই  সময়ে  বহু  আরবরা   নিরপেক্ষতা  বজায়  রেখে  সালিশের  দ্বিতীয়  প্রয়াস  চালান  ৷  তাঁরা  তৃতীয়  পক্ষ  থেকে  একজন  নতুন  খলিফাহ্  নির্বাচন  করতে  গিয়েও  ব্যর্থ  হন  ৷  ফলে  মুয়াবিয়াহ্ র  সেনাবাহিনী  আরবে  তাঁর  শাসনের  বিরোধিতাকারীদের  পরস্ত  করতে  সমর্থ  হওয়ায়  পর   ৬৬১  সলে  জনৈক  খারেজির  হাতে  প্রাণ  হারান  আলী  ৷  কিন্তু  তখনও  কুফাহ্য়  যারা  আলীর  আদর্শের  প্রতি  বিশ্বস্ত  রয়ে  গিয়েছিল  তারা  আলীর  পুত্র  হাসানকে  খলিফাহ্  হিসেবে  ঘোষণা     দেয়  ৷  তবে  হাসান  রাজনৈতিক  ব্যক্তিত্য  মুয়াবিয়াহ্ র  সঙ্গে  এক  চুক্তিতে  উপনীত  হন  এবং  অর্থের  বিনিময়ে  মদীনায়  ফিরে  গিয়ে  রজনীতি  নিরপেক্ষ  জীবনযাপন  করে  ৬৬৯  সালে  পরলোকগমন  করেন  ৷

         আলী  একজন  ভদ্র  ,  ধার্মিক  , এবং  ইসলাম  ধর্ম  গ্রহণকারী  প্রথম  পুরুষ  এবং  পয়গম্বরের  ব্যতিক্রমী  গুণাবলীর   কিছুটা  ধারণ  করতেন  বলে  সমাজে  একটা  ধারনা  ছিল  ৷  আলী  তাঁর  কিছু  মিত্রসহ  প্রতিপক্ষের  বিশ্বাসঘাতকতার  শিকার হয়েছিলেন  বলে  অনেকের  কাছে  তাঁর  জীবন  দর্শন  ও  আদর্শ  একটি  প্রতিকে  পরিণত  হয়ে  য়ায়  ৷  অন্যদিকে  এককালের  ইসলামের  শত্রুপরিবারের   সদস্য  শাসক  ও  রাজনৈতিক  কুট-কৌশলে  নিয়োগপ্রাপ্ত  খলিফাহ্  মুয়াবিয়াহ্ র  অন্যায়  অচরণের  বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ  জ্ঞাপনকারী  মুসলিমরা  খারেজিদের  মত  নিজদের  উম্মাহ্  থেকে  বিচ্ছিন্ন  করে  ফেলে  এবং  প্রকৃত  মুসলিমদের  তারা  এই  বলে  আহ্বান  করে  যে   যারা    আরো  উন্নতর  ইসলামী  আদর্শে  নিজদের  উৎসর্গ  করতে  আগ্রহী    তারা  যেন  তাদের  আন্দোলনে  ( জিহাদে )  যোগদান  করে   এবং  তারা  নিজদেরকে  শিয়াহ-ই-আলী’র  অংশ  এবং  আলীর  পক্ষাবলম্বনকারী  হিসেবে  দাবী  করে  বসে  ৷

              এই  পর্যায়ে  যারা  আলীর  প্রতি  অসন্তুষ্ঠ    ছিলেন  তারাও  বুঝতে  পারেন  যে  মুয়াবিয়াহ্  মোটেই  ইসলামী  আদর্শের  উপযুক্ত  শাসক  নন  ৷  তিনি   এক  ক্ষমতা  লোভী  রাজনৈতিক  ব্যক্তি  ৷  আর  মুয়াবিয়াহ্ র  দামাস্কাসে  রাজধানী  স্থাপন  করাকে  অন্য  কিছুর  ইঙ্গিত  বলে  ধরে  নেন  ৷  তাই  তারা  অর্থাৎ  যারা  অধিকতর   ধার্মিক  এবং  ইসলামের  ব্যাপারে  উদ্বিগ্ন  ছিলেন ,  তারা  মুসলিম  উম্মাহ্য়   আবার  ইসলামী  শাসন  ফিরিয়ে  আনার  সংকল্প  গ্রহণ  করেন  ৷

          কিন্তু  খলিফাহ্  মুয়াবিয়াহ্  (৬৬১-৮০  )তাঁর  প্রায়  ২০  বছরের  শাসন  আমলে  সাম্রাজ্রের  ঐক্য  পূনঃপ্রতিষ্ঠায়  সক্ষম  হন  ৷  তিনি  ওমরের  মত  অধিকৃত  এলাকাতে  বিজয়ী  আরবদের  জমিদারি  স্থাপনে  বাধা  দেন  এবং  ধর্মান্তরকরণ  ও  নিরুৎসাহিত  করেন  ৷  কিন্তু ক্ষমতাশীনরা  নিজেদের  মধ্যে  এক  উন্নত  সংস্কৃতি  এবং  বিলাসবহুল  জীবনধারা  গড়ে  তুলতে  শুরু  করায়  এই  শাসন  ব্যবস্থাকে  প্রক-ইসলামী  যুগের  শাসন  ব্যবস্থা  থেকে  আলাদা  করা  কঠিন  হয়ে  পড়ে  ৷  পরবর্তী  পর্যায়ে  ইসলাম  ধর্ম   মুসলিম  বিজয়  অর্জনকারী  আরব  অভিজাতদের  ধর্মে  পরিণত  হয়  এবং  ক্রমেই  তা  প্রাক-ইসলামী  যুগের  রাজতন্ত্রের  দিকে  মোড়  নিতে  আরম্ভ  করে  ৷  রাজতন্ত্র  আরব  ঐতিহ্যের  ও  কোরানের  চরম  সাম্যবাদী  নীতির  সঙ্গে  কোনো  ভাবেই  খাপ  খায়  না  ৷  তবু  মুয়াবিয়াহ্  সে  দিকেই    অগ্রসর  হন  ৷
তবে    বাহিরে  বাহিরে  মুয়াবিয়াহ্  অনেকটা  সেক্যুলার  নীতি  গ্রহণ  করে  উম্মাহ্ র  ঐক্য  বজায়  রাখার  চেষ্টা  করেন  এবং  প্রচার  করেন  যে  তাঁর   শাসনের  ভিত্তি  কোরানের  আদর্শ  এবং  সে  অনুযায়ী  মুসলিমরা  পরস্পরের  ভাই  ভাই  ৷ তিনি  জিম্মিদের  ধর্মীয়  স্বাধীনতা  ও  ব্যক্তিগত  অধিকার  দিয়েছেন  ৷  এসবের  পরও  অনেক  মুসলিম  মনে  করতে  থাকে  যে  রাষ্ট্রিয়  ও  ব্যক্তি  পর্যায়ে  ইসলামের  নীতি  আরো  ব্যাপকভাবে  অনুস্মরন  হওয়া  উচিত   যা  মুয়াবিয়াহ্ র  শাসনে  পরিলক্ষিত  হচ্ছে    না  ৷  মুয়াবিয়াহ্  অধিকাংশের  ও  অধিক  মুসলিমদের  এ  মনোভাব  বুঝতে  পেরে  এবং  রাষ্ট্রীয়  ক্ষমতা  তাঁর  পরিবারের  ভেতর  ধরে  রাখতে  আরব  ঐতিহ্য  থেকে  সরে  এসে  তাঁর  ইন্তেকালের  আগেই  তাঁর  পুত্র  প্রথম  ইয়াযিদের ( ৬৮০-৮৬ ) ক্ষমতারোহনের  ব্যবস্থা  সম্পূর্ণ  করেন  ৷  ফলে  প্রবল  গোলমাল  শুরু  হয়ে  যায়  ৷ কুফাহ্য়  আলীর  অনুগতরা  আলীর  দ্বিতীয়  পুত্র  হুসেনের  শাসন  দাবী  করে  বসে  ৷  হুসেন  তখন  পবিবারবর্গ  সহ  কিছু  অনুসারী  নিয়ে  মদীনার  উদ্দেশ্যে  অগ্রসর  হওয়া  আরম্ভ  করেন   ৷  অন্যদিকে  কুফাহ্য়      উমাঈয়াহ্  গরর্নর  এ  অঞ্চলের  স্থানীয়  অধিবাসীদের  ভয়-ভীতি  প্রদর্শন  করে  হুসেনের  প্রতি  তাদের  সমর্থন  প্রত্যাহার  করতে  বাধ্য  করে   হুসেনকে  আত্মসমর্পণের  আদেশ  দিলে  তিনি  তাতে  অস্বীকৃতি  জানান  ৷  তাঁর  বিশ্বাস  ছিল  পয়গম্বরের  পরিবারের  এই  অভিযাত্রাকে  উম্মাহ্  সফল  করবে সকল  প্রকারের  সাহায্য  ও  সহায়তার  মাধ্যমে  ৷  কিন্তু  তাঁর    এ  বিশ্বাস     ব্যর্থ  প্রমাণিত    হয়  এবং  কুফাহ্ র  অনতিদুরে  কারবালার  প্রান্তরে  সসৈন্য  উমাঈয়াসৈন্যদের  দ্বারা  অবরূদ্ধ  হয়ে  পরিবার  পরিজন  সহ  সবাই  প্রাণ  হারান  ৷

                   আলীর  হত্যাকাণ্ডের  মত  কারবালার  করুণ  হত্যাকাণ্ড  ও  শিয়া  মুসলিমদের  চোখে  মানবজাতিকে  ঘিরে  ফেলা  অবিরাম অন্যায়  ও অবিচারের  প্রতিকে  পরিণত  হয়  ৷  তাই  শিয়া -ই- আলী  বলে  পরিচিতদের  ভেতর  এক  বিরাট  প্রতিক্রিয়ার  সৃষ্টি  হয়  তখনকার  প্রচলিত  শাসনের এবং  ইসলামী  ধারার  বিরুদ্ধে  ,  যা  আজও  শিয়াদের  মধ্যে  বিদ্যমান  আছে  ৷ 

                  এ  ঘটনার  মাধ্যমে  ইসলামের  রাজনৈতিকরণ  সম্পূর্ণ  হয়ে  যায়  ,  যা  আজও  অব্যাহত  আছে  ৷  তখন  থেকেই  পয়গম্বরের  প্রচারিত  ইসলামী  চিন্তা  চেতনার  পরিবর্তনের  সূচনা  হয়ে  যায়  আর  ইসলামে  শিয়া  ও  সুন্নি  দু’ধারার  সৃষ্টি  হয়ে  যায়  ৷

 ( প্রথম  পর্বের  প্রথমাংশ  সমাপ্ত  )
    ( সূত্র; ইসলাম ; সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস  :
  লেখক-ক্যারেন  আর্মস্ট্রং ,  অনুবাদ  : শওকত  হোসেন  )
           

মন্তব্যসমূহ