সমাজ গঠনে কবি সাহিত্যিক ও দার্শনিকের ভূমকা :

  

                          সমাজ   গঠনে   কবি   ও   দার্শনিকের   ভূমিকা ;  

                   শিরোনামঃ
 মোদের গরব, মোদের আশা

গীতিকারঃ অতুলপ্রসাদ সেন

সুরকারঃ অতুলপ্রসাদ সেন

——————————————–

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা।

(মাগো) তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।।

কি যাদু বাংলা গানে, গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,

গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।।

বিদ্যাপতি, চণ্ডী, গোবিন্‌, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন-

ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা।।

বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আনলো মালা জগৎ জিনে
।।
তোমার চরণ-তীর্থে (মাগো) জগৎ করে যাওয়া-আসা।।

ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা,

আছে কৈ এমন ভাষা এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা।।

ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাকনু মায়ে ‘মা, মা’ বলে;

ঐ ভাষাতেই বলবো হরি, সাঙ্গ হলে কাঁদা হাসা।। 


     এই   বিখ্যাত   গানটির   কথা    দিয়ে   এই   লেখাটা    আরম্ভ   করছি   ;-

                        কারণ   মাতৃভাষার    পটভূমি   যারা   রচনা   করে  গেছেন   তাদেরকে    স্মরণ  করতে   আজকে   এই   মাতৃভাষা   দিবসে   তাদের   কিছু   রচনার   উল্লেখ   করা   হলো  মাত্র  ৷

            কয়েক  শতক   বছর   আগ  থেকেই   বাঙলা   দেশে    যারা   বাংলাভাষার  আন্দোলনের  ,   বিশেষকরে    একুশের   ভাষা   আন্দোলনের    পটভূমি   ও   পেক্ষাপট   তৈরিতে    অগ্রগামী    ভূমিকা   পালন    করেছিলেন   ,  আর  যারা   বাংলাদেশে  একটি   যুক্তিবাদী   ও   উদার   এবং    গণতান্ত্রিক    চিন্তাধারায়   বিশ্বাসী  একটি  শিক্ষিত শ্রেণী  সৃষ্টিতে     অগ্রগামী    ভূমিকা   পালন   করেছিলেন  ,    এখানে  তাদের   মাত্র   দু -  চার    জনের   কিছু  ঐতিহাসিক     উক্তির   উল্লেখ   করছি  নতুন  প্রজন্মকে  অবগত  করতে  এবং  তারা  যেন  দেশের  ও  জাতির  কল্যাণে  কিছু   কাজ  করেন  যেমন  আমাদের  পূর্বসূরিরা  আমাদের জন্যে  কিছু  করে  গেছিলেন   বলেই  আমরা  একটি  স্বাধীন  দেশ  প্রতিষ্ঠা  করতে  পেরেছি ৷

            চতুর্দশ   ও   পঞ্চদশ   কতকের   কবি   মোঃ   সগীর   তার   রচিত   ইউসুফ   জুলেখা   কাব্যের   এক   মন্তব্যে   লিখেছিলেন যে ,  লেখকগন   পবিত্র   ধর্মগ্রন্থের   বাণী   অনুবাদ  করতে  ভয়   পান  ,   তবে   তিনি   মনে   করতেন ,  এই   ভূল   সম্পূর্ণ   অমুলক  ,  কারণ   তার   মতে  ,   ভাষান্তরের   কারণে    ব্যক্তব্যের   পরিবর্তন   হয়   না   ,  এবং  ধর্মগ্রন্থ   মাতৃভাষায়   ভাবান্তর   করলে   স্বর্গচুত্যির  ভয়  নাই  ৷  তাই     তিনি সাহস  করে   লিখেছেন  ;-

           “  শুনিয়া   দেখিনু   আমি   হই   ভয়   মিছা  
              না   হয়   ভাষার   কিছু   হয়   কথা   সাঁচা 
              শুনিয়াছি   মহাজনে   কহিতে   কথন 
              রতন    ভান্ডার    বচন   যে   ধন  ” ৷
        

         ষোড়শ   শতকের   কবি   মুজাম্মিল  ও   আরবি   ভাষাকে   অন্য   ভাষায়  অনুবাদে  কোনো   দোষ   দেখেন   নাই  ,  তাই   তিনি   ও  লিখেছেন  ;-

               “  আরবি   ভাষায়   লোকে    না   বুঝে   কারণ  
                   সভানে  বুঝিতে   কৈ   পারার   বচন  , 
                   যে   বলে   বলোক   লোকে   করিনু   লিখন ,
                  ভালে   ভাল  ,  মন্দে   মন্দ , না   যাত্রা   খন্ড ”   ৷ 

        ষোড়ক    শতকের   কবি   সৈয়দ   সুলতান   মনে   করতেন   বিধাতা    ইচ্ছা   করেই    বিভিন্ন    জণগোষ্ঠীর   জন্যে    বিভিন্ন   ভাষার   সৃষ্টি    করেছেন   ৷ অর্থাৎ   ভৌগলিক  অবস্থানের  কারণে   বিভিন্ন   জণগোষ্ঠির   ভাষা   ভিন্ন   হতেই   পারে ৷ তাই  তিনি  হয়ত   প্রাকৃতিক   কারণে    বিভিন্ন   জণগোষ্ঠির   ভাষা  যে  কারণে   আলাদা   আলাদা   হয়েছে   তাকে   তিনি গুরুত্ব  দিতে  দিয়ে  ভাষাকে  বিধাতার   সৃষ্টির   বলে   পরিচয়   দিয়ে    লিখেছেন   ;-
                    “  মারে   যেই   ভাষে   প্রভু    করিল   সৃজন
                সেই   ভাষা    তাহার     অমূল্য   রতন  ”  ৷

          সপ্তদশ   শতকের   কবি   আব্দুল   হাকিম   দাবি   করেছেন   যে   আল্লাহ্   সব   ভাষাই   বুঝেন  ,   তাই   বাংলা   লেখার   জন্যে   মাপ   চাওয়ার   কারণ     নেই  ৷ অর্থাৎ  এখানে  ও   ধর্মবিশ্বাসীদর       তিনি   সরাসরি কোনো   আঘাত  না   দিয়ে   তার  বক্তব্যকে   প্রতিষ্ঠা  করতে   চেয়েছেন   আল্লাহ্ র  নামে  ৷ অর্থাৎ  বাংলা  ভাষা  চর্চাকে  তিনি  দোষের  বা  ধর্ম  বিরোধী  মনে  করেন  না  ৷  মাতৃভাষকে  সম্মান    করে  তাই     তিনি   গর্ব  করে       লিখেছেন   ;-
              
               “  যে   সব   বঙ্গেতে   জন্মে   হিংসে   বঙ্গবাণী  ,
                  সে   সব   কাহার   জন্ম   নির্ণয়   না   জানি  ৷
                  দেশী   ভাষা   বিদ্যা     যার   মনে   না   জুয়ায়  , 
                  নিজ    দেশ   ত্যাগী   কেনো   বিদেশে   না   যায়   ” ৷

          বাংলাদেশে   সব   কালেই   দূর্নীতিবাজ    ও  আমার    আরো    চাই   ও   খাঁই   খাঁই   স্বভাবের   লোকের  কমতি   ছিলো   না   ৷   অবশ্য আমার  সোনার   হরিণ   চাই  ওয়ালাদের   সংখ্যা   বর্তমানে   বৃদ্ধি   পেলে ও  সে   কালেও  নিশ্চয়  এদের    অস্থিত্ব্   ছিলো  প্রকটভাবে     ৷  তাই  বোধহয়   সপ্তদশ   শতকের   কবি   ও   চিন্তাবিদ   শাহ   নিয়ামত   ফিরোজপুরী মনের   দুংখে  লিখে  গেছেন  ;-

          “   Bengal   is   a   ruined   doleful   land  ,   go  offer   the   prayers   to   dead  ,  do  not   delay  ,  neither , on  land   nor   water  is   there   rest  ,  it   is  either   the   tiger’s   jaws   or   the   corcodiel’s   gulle  ”  .

অর্থাৎ  “  বাংলা   হচ্ছে   এমন   একটি   ধ্বংস   প্রাপ্ত   ও   বেদনাকল   দেশ   ,
            কাল   বিলম্ব   না   করে   যাও  ,   মৃতদের   কাছে , 
             দোয়া   চাও  ,  মাটিতে  ,   পানিতে    কোথায়    শান্তি   নেই  ,
             নেই   স্বস্তি  ,   আছে   শুধু    বাঘের    থাবা   আর  কুমিরের হাঁ “ ৷

         আর   ব্রিটিশ   শিক্ষাবিদ   ও   দার্শনিক   মেকলে ,   যে   পরাধীন   ভারতে   ব্রিটিশ   স্বার্থরক্ষাকারী   শিক্ষাকার্যক্রমের   সৃষ্টি   করে   ছিলেন  ৷  ব্রিটিশ  ঔপনিবেশিক  শাসকদের  স্বার্থরক্ষাকারী      একটি   সুবিধা ভোগী সম্প্রদায়ের   সৃষ্টি   করতে  এই  শিক্ষাকর্যক্রমের  সূচনা  করা  হয় এবং  সমাজে  ব্রিটিশ  ঔপনিবেশিক  শাসকদের   স্বার্থ  ঐসব  শিক্ষিতরা  ঠিক  ভাবেই  রক্ষা  করেছিলেন  ৷  বর্তামান  স্বাধীন  বাংলাদেশে  ও  এই  ধরণের  লোকের   অস্থিত্ব   এখনো   সমাজে   বিদ্যমান   আছে  ৷  যারা  রাষ্ট্রক্ষমতায়  থাকেন   তাদের   ন্যায়  অন্যায়  যে  কোনো  কাজে  সহায়তা  করেন   আর  সঙ্গে  সঙ্গে  নিজেদের  স্বার্থ  ও  হাসিল  করেন  ৷  মেকলে   বাংলাদেশে   বাঙালীদের  চরিত্র  নিয়ে একটি  গবেষণা  নাকি  করেছিলেন ৷   এ  কাজ   করতে  গিয়ে     তিনি  বাঙালীদের   চরিত্রের   একটি    বিশ্লেষণ   করেন   ৷  তার  গবেষণায়  যে  ফলাফল  পান  বাঙালীদের  জাতিয়  চরিত্রের  ৷  তার  একটি  মূল্যায়ন  ও  তিনি   করে  গেছেন ৷   তাই   ব্যাঙ্গ   করে   মেকলে  বলেছেন  ;-

               “  মোষের   যেমন   শিং   আছে  ,   মৌমাছির   আছে   হুল  , 
                  গ্রীক   সঙ্গীতে    যেমন   আছে   মেয়েদের   সৌন্দের্যের   প্রকাশ ,
                 তেমনি   আছে    বাঙালীদের  চরিতে  ও   একটি   আলাদা   বিশেষত্ব   , 
                  আর   তা   হচ্ছে   প্রাতারণা  ”  ৷


    তবে   জন্যে   শধু   বাঙালীরাই   দায়ী   নয়   ,  বিশ্বের   আরো   অনেক   স্থানেই   এই   শ্রেণীর    মানুষের   অস্থিত্ব   নিশ্চয়   আছে  তাই   বোধহয়      সল্পাআয়ু   কবি   জীবনান্দ  দাস   তার   অভিজ্ঞতার   আলোকে   শুধু   বাংলাদেশ   নয়  ,   সমস্ত   বিশ্বের   ব্যাপারেই   বলেছেন   ;-

                         “  অদ্ভুত   আঁধার   এক    এসেছে   এ   পৃথিবীতে  , 
                    আজ   যারা   অন্ধ    সব  চেয়ে   বেশী  আজ  চোখে  দেখে  তারা
                             যাদের   হৃদয়ে   কোনো   প্রেম   নেই   ,   প্রীতি  নেই, 
                                       করুনার    আয়োড়ন   নেই ,
                   পৃথিবী   অচল    আজ   তাদের   সুপরামর্শ     ছাড়া  ”  ৷

          তাই  বোধহয়  বর্তমান    বংলাদেশে   যে   যুক্তিবাদী  ও   উদারনৈতিক   এবং   গণতান্ত্রিক   চিন্তাধারায়   বিশ্বাসী  একটি  শ্রেণীর    আবির্ভাব    ঘটেছে ৷   উপরে    উল্লেখিতরা এবং     তাদের  পূর্বসূরিদের    কয়েক   জন    সহ     তারাই    আমাদের  জন্যে  মুক্তচিন্তার       বীজ   বপণ   করে      গিয়েছিলেন  ৷ যার  প্রেক্ষাপটে   ১৯৭১ এ  আমরা ,  বাঙালীরা  স্বাধীনতা  অর্জন  করতে  সমর্থ  হয়েছি  ৷  একটি  সফল  মুক্তিযুদ্ধ  করে  দেশের  এবং  বাঙালী  জাতির  জন্যে  একটি  স্বাধীন  ও  সার্বভৌম  রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠা  করতে  পেরেছি  ৷
               তাই    বর্তমান   মুক্তিযুদ্ধের     চেতনায়   বিশ্বাসী  ধর্মনিরপেক্ষ     যুক্তিবাদী  এবং  উদরনৈতিক  গণতান্ত্রিক  ধারায়  বিশ্বাসী  একটি   শ্রেণীর   সৃষ্টি  হয়েছে  ৷   যারা   ও  তাদের        পরবর্তী   প্রজন্মের   জন্যে  এমন   কিছু   করে   যাবেন      যেমন      আমাদের   পূর্বসূরিরা    আমাদের   জন্যে   একটি   পেক্ষাপট    রেখে   গেছেন    তাদের   কর্মের   ও  লেখার  মাধ্যমে  ৷
   
               তাই   শুধু   স্বর্গ   ও   নরক   ও  মূত্যুর    পরের   জীবন   নিয়ে    হাঁহাঁকার    না   করে    চলুন  ,  কবি    জীবনানন্দ   দাস   ও   কবিগুরু   রবীন্দ্রনাথের   কবিতায়    আমাদের বাস্তব   জীবনের   কিছু    অর্থ   খুঁজে   নেই  :  যা  আমাদের  পরবর্তী  নতুন  প্রজন্মকেও  নিশ্চয়  উৎসাহিত  করবে  ৷

                                  জীবননান্দ   দাস 

    “ আমরা  মৃত্যুর  আগে  কি  বুঝিতে  চাই  আর ? জানি না  কি  আহা  , 
      সব  রাঙা   কামনার   শিয়রে   যে   দেয়ালের  মত  এসে   জাগে  
       ধূসর   মৃত্যুর   মুখ  ;- একদিন   পৃথিবীতে  স্বপ্ন  ছিলো- সোনা  ছিল যাহা
       নিরুত্তর  শান্তি  পায় ;- যেন  কোন্  মায়াবীর   প্রয়োজনে  লাগে  ৷
        কি  বুঝিতে  চাই  আর  ? ….রৌদ্র  নিভে  গেলে  পাখি-পাখালীর  ডাক
          শুনি  নি  কি ? প্রান্তরের   কুয়াশায়   দেখি  নি   কি  উড়ে  গেছে  কাক  !
   
                                   রবীন্দ্রনাধ   ঠাকুর 

                 “  ব্রাত্য  ,  আমি   মন্ত্রহীন  , 
                          দেবতার   বন্দীশালায় 
                     আমার   নৈবেদ্য   পৌছল   না  ৷
                         আজ   আপন  মনে  ভাবি  ,
                              ‘  কে   আমার   দেবতা  ,
                               কার   করেছি   পূজা   ’ ৷
                          শুনেছি   যাঁর   নাম   মুখে   মুখে
                       পড়েছি  যাঁর  কথা  নানা  ভাষায়  নানা  শাস্ত্রে
                            কল্পনা   করেছি   তাঁকেই    বুঝি   মানি  ৷
                        তিনিই   আমার   বরণীয়  প্রমান  করব  ব’লে
                               পূজার   প্রয়াস   করেছি   নিরন্তর  ৷
                         আজ  দেখেছি   প্রমাণ  হয়  নি  আমার  জীবনে “৷

                   কবিগুরু    তার   মৃত্যর   তিন  দিন   আগে   একটি    কবিতা   লিখেছিলেন ;-    ‘প্রথম  দিনের    সূর্য  ’   নামে  ,   কবিতাটি   প্রাসঙ্গিক   হওয়ায়  এখানে   উল্লেখ   করা   হলো  ৷  
                                প্রথম   দিনের   সূর্য
                   “  প্রথম   দিনের   সূর্য 
                         প্রশ্ন   করেছিল
                      সত্তার   নতুন   আবির্ভাবে -
                              কে  তুমি   ?
                         মেলে  নি   উত্তর  ৷
                     বৎসর   বৎসর   চলে   গেল  ৷
                         দিবসের   শেষ   সূর্য 
                   শেষ   প্রশ্ন   উচ্ছারিল  
                        পশ্চিমসাগরতীরে 
                           নিস্তব্ধ   সন্ধায়
                              কে   তুমি   ?
                            পেল   না    উত্তর  !!     

        একটি  কোটেশনের   উল্লেখ  করে  লেখাটি  সমাপ্তি   করছি  ৷

                      “  I  WANT  TO  LIVE  MY  LIFE  
                   WITHOUT   STRESS   AND   WORRIES 
                             I  DON’T  NEED  TO
                          BE  RICH  AND   FOAMOUS   
                    I  JUST  WANT  TO  BE   HAPPY   ”  
                     





মন্তব্যসমূহ