আজকালের বহুল প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের “ চেতনা
” শব্দটার একটা ঐতিহাসিক
প্রেক্ষাপট আছে ৷ লেখাটার মূল অংশে প্রবেশের
পূর্বে নিম্নে এর একটা
প্রাথমিক বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করা হলো ৷
৪৭- এ
পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তখনকার
পূর্ব বঙ্গের বাঙালীদের
মন থেকে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের
মোহ-মুক্তি ঘটতে শুরু হয়ে যায় ৷ ঢাকার রাস্তায় তখন ভূখা
- মিছিলে জনগণের অংশ গ্রহন বাড়তে থাকে ৷ এই স্বাধীনতা
ঝুঁটা হায় , লাখও মানুষ ভূখা হায় , এই
ধরনের শ্লোগানে ঢাকার রাস্তাঘাট
মূখরিত হয়ে উঠে তখন ৷ আর তখন থেকেই শিক্ষিত
বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নতুন চিন্তা ও চেতনার উদ্ভব ঘটা শুরু হয়ে
যায় ,এবং এর বিকাশ লাভ করতে
ও বেশি
সময়ের প্রয়োজন হয় নি ৷
পাকিস্তানি দ্বীজাতিতত্তে
বিশ্বাসী কিছু মুসলিম
লীগ ঘরাণার লোক ও জামাতী
ও ইসলামী ব্রাদারহুডের
অনুসারী কিছু লোক ছাড়া বাকি সবাই তখন ভিন্ন
মত পোষণ করে দ্বীজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করেছিলো ৷ আর ইহা প্রচুর জনপ্রিয়তা
লাভ করতে আরম্ভ করলে কিছু গোপন রাজনৈতিক
দল সহ অন্যান্য
রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই আন্দোলনের ব্যাপার উৎসাহের সঞ্চার
হয় ৷ ফলে এই ঘরাণার রাজনৈতিক দলগুলোও
এই আন্দোলনে সক্রিয়
ভূমিকা পালন করতে শুরু করে ৷ গ্রাম-বাংলায়
পূর্ব থেকেই একটা অসাম্প্রদায়িক ধারা চালু হয়েছিলো
৷ গ্রামগণ্জে বিভিন্ন মেলা , বারনি , ঘোড়দৌড়
, ঘেঁটুনাচ , যাত্রানুষ্টান এবং পালাগান ইত্যাদিতে
অসাম্প্রদায়িক ভাবে হিন্দু
ও মুসলমানদের অংশ গ্রহন ছিলো অবাধে ৷
এই দুই সম্প্রদায়ের
মধ্যে বিয়েশাদী সহ অন্যান্য পূজা পার্বণ
ও অন্যান্য ধর্মীয়
অনুষ্ঠানেও একে অন্যকে
নিমন্ত্রন করতে দেখা গেছে ৷ মুসলিম লীগ , কংগ্রেস
ও ব্রিটিশদের সৃষ্ট
৪৬-এর এতবড় সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গার পরও এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থেকে গিয়েছিলো
৷ আর এরই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে বাঙালী
জনগণের একটাঅংশ সহ প্রগতিশীল
, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের
বিরুদ্ধে একটা ব্যাপক
আন্দোলনের সূচনা করেছিলো
, রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনের
ধারাবাহিকতায় ৷ আর এই আন্দোলনের ফল স্বরূপ বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চিন্তার
ক্ষেত্রে এক বড় ধরণের পরিবর্তনের
সূত্রপাত ঘটে ৷ সমাজের
ঐ চিন্তা ও চেতনার প্রভাবে
রাজনৈতিকদের চিন্তার মধ্যে এক পরিবর্তন
আসে ৷ আর ঐ পরিবর্তন , বাঙলাদেশের
জনগণের জীবন যাপন সহ
দেশের
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে
বড়ো রকমের এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো ৷ তাই পর্যায়ক্রমে
জনগণের ও শিক্ষিত
বুদ্ধিজীবীদের এই প্রগতিশীল
চিন্তা ও চেতনা , রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগর মধ্যে একটা বিরাট প্রভাব
বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলো
৷ তাই আওয়ামী
লীগের প্রগতিশীল অংশ জনগণের এই চিন্তা চেতনাকে
আরো এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা
পালনে সমর্থ হয়েছিলো
৷ তাই এক পর্যায়ে পুরাতন
মূল আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের
নেতৃত্বে নতুন ছয়দফা ভিত্তিক নতুন এক আওয়ামী
লীগের জন্ম হয়েছিলো
পূর্ব- বাংলার জনগণের আশা আকাঙ্কার প্রতীক
হিসেবে ৷
তাই
৭১- এ মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই
বাঙালীদের মনে যে চিন্তা ও চেতনার সৃষ্টি
হয়েছিলো , সে চিন্তা
চেতনাই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের
মূল সূত্র অর্থাৎ
মূল ধারার ধারাবাহিকতা
মাত্র ৷ আর সেই চিন্তা
চেতনার মূল উদ্দেশ্য
ছিলো , বাঙলাদেশে এমন এক মুক্ত ও স্বাধীন মনুষ্য জাতির জন্ম দেয়া ,
যেখানে মানুষ তার চাহিদা অনুসারে
শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস , যেমন খাদ্য
, বস্ত্র , বাসস্থান , চিকিৎসা
ও শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না ৷ তাদের
মনোজগতে
আরো ছিলো যে এই মুক্তিযুদ্ধ তাদেরকে
অর্থাৎ বাঙালীদেরকে সব ধরনের পশ্চাৎপদতা
, রক্ষণশীলতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে মুক্ত করে এক সুন্দর
এক সুস্থ ও কুসংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক
সাংস্কৃতিক জগতে প্রবেশ
করতে সহায়তা করবে ,
আর
বৈষম্যহীন এক মুক্ত সমাজের সৃষ্টি
করে তাদের পরবর্তী
প্রজন্মের জন্যে এক নতুন আধুনিক
রাষ্ট্র রেখে যেতে পারবে ৷ কিন্তু এই সব অধিকার
অর্জন করতে হলে ধর্মকে রাজনীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ
গ্রহন করা ছিলো এক অনিবার্য শর্ত ৷ তাই ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে
শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ না বলে মুক্তিযুদ্ধ বলা হয় ৷
কিন্তু ৭১- এর
পর বাঙলাদেশের জনগণের
সে আকাঙ্কা আজো পূরণ হয় নাই ৷ অবশ্য তার অনেক কারণ আছে ৷
( আমার অন্য একটা লেখার অংশ থেকে )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন