‘
সব কিছু নষ্টদের
অধিকারে যাবে ’ নামক হুমায়ুন আজাদের
কাব্য গ্রন্থের কিছু নির্বাচিত কবিতা :
এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল ( এই কাব্য গ্রন্থের প্রকাশ
সাল ১৯৮৫ সাল ) পর্যন্ত
বাঙলাদেশের সামাজিক ও রাজনীতিক ঘটনা প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে ৷
রূপকের
আড়ালে তখনকার সামাজিক
ও রাজনীতিক অবস্থার
বর্ণনা কবিতার মাধ্যমে
বর্ণিত হয়েছে এই কবতাগুলোতে
৷ নিম্নে এ গ্রন্থের কিছু কবিতা উল্লেখ
করা হলো পাঠকদের
জন্যে
৷
“ এক বড়ো অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে , যারা অন্ধ তারা চোখে সবচেয়ে দেখতে তো পাচ্ছেই
, তারা অত্যন্ত
বেশি বিশ্বাস করছে
, এবং পৃথিবী
জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে
বিশ্বাসের মহামারী ৷ ……বিজ্ঞানের
এই অসাধারণ যুগে যখন কিছু অবিশ্বাসী সৌরলোক
পেরিয়ে ঢুকতে চাচ্ছে
মহাজগতে , তখন বিশ্ব মেতে উঠেছে মধ্যযুগীয়
বিশ্বাসে ; শক্তিলোভী
ভ্রষ্ট রাজনীতিকেরা মানুষকে
আক্রান্ত ক’রে তুলেছে
বিশ্বাসের রোগে ; …..
বাঙলাদেশে আজ সবাই বিশ্বাসী ; রাজনীতিক , আমলা , ব্যবসায়ী , সেনাপতি , অধ্যাপকেরা বিশ্বাসী
তো বটেই , এমনকি লেখকেরাও
বিশ্বাসী ; তাঁরা বিধাতায় বিশ্বাস
করেন , প্রথায়
বিশ্বাস করেন , একনায়কে বিশ্বাস
করেন , ক্ষমতায়
বিশ্বাস করেন , পদে ও অর্থে বিশ্বাস
করেন ,
কেননা , কোনো কিছুই অবিশ্বাস করার মতো প্রতিভা
ধারণ করেন না , তাঁরা ”
( হুমায়ুন
আজাদের একটা লেখা থেকে নেয়া )
সব
কিছু নষ্টদের অধিকারে
যাবে
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের
অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চ'লে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ'লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে
চ'লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে ৷
চ'লে যাবে শহর বন্দর ধানখেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা
চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ
পবিত্র প্যাগোডা ।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ'লে গেছে, জনতাও যাবে ;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন
আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল
পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি
খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না
আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন
গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার
মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের
অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথা ; সৌন্দর্য-প্রতিভা-
মেধা; -এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের
ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে
টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী । চ'লে যাবে ,
কিশোরীরা চ'লে যাবে , আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক'রে চ'লে যাবে , নষ্টদের
উপপত্নী হবে । এই সব গ্রন্থ শ্লোক
মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি
দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত
ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন ,
আর বাঙলার বনের মত আমার
শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট
সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের
অধিকারে যাবে ।
ব্যাধিকে রূপান্তরিত
করেছি মুক্তোয়
একপাশে শূন্যতার খোলা
, অন্যপাশে মৃত্যুর
ঢাকনা ,
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থ
ঝিনুক ৷
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়
আপাদমস্তক বন্দি ব্যাধিবীজ
৷ তাৎপর্য নেই কোনোদিকে
-
না জলে না দেয়ালে
- তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি ৷ কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গারকুমিরসহ
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ , ছুটে আসে মরা রক্তের
তুফান ৷
আকস্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত
৷
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে
বেড়ে ওঠা ছাড়া
নিজকে - ব্যাধিকে - যাদুরসায়নে রূপান্তরিত
করেছি শিল্পে -
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়
৷
কবিতা - কাফনে - মোড়া অশ্রুবিন্দু
পংক্তির প্রথম শব্দ
, ডানা - মেলা জেট ,
দাঁড়িয়ে রয়েছে টার্মিনালে
৷ শব্দের গতির চেয়ে দ্রুতবেগে
বায়ু - মেঘ - নীল ফেড়ে উড়াল মাছের মতো নামে
পংক্তির শেষ শব্দের
বন্দরে ৷ অতল সমুদ্রপারে , দ্বিতীয় পংক্তির
সম্মুখ জুড়ে , ভিড়ে আছে সাবমেরিন , ডুবে যায়
কালো তিমি , প্রবাল তুষার ভেঙে অসংখ্য
সূর্যাস্ত দেখে
ভুশভুশ ক’রে ভেসে ওঠে দ্বিতীয়
স্তবকের দিকচিহ্নহীন
মধ্যসাগরে ৷ তৃতীয় স্তবকে আচমকা
জ্যোৎস্না ঠেলে ঝনঝনাৎ
বেজে ওঠে নর্তকীনূপুর -
দশদিগন্তে মঞ্চেমঞ্চে ডানা মেলে
বর্ণাঢ্য
ময়ুর !
ব্লাউজ - উপচে - পড়া
কিশোরীর ব্যাপ্ত বুক
রোধ করে পঞ্চম স্তবকের পথঘাট
, উত্তেজিত ক্ষিপ্ত
ট্রাক রাস্তার মোড়ে মোড়ে পাল দেয় লাল
টয়োটাকে ৷ একনায়কের
কামান মর্টার স্টেনগানে
বধ্যভূমি হ’য়ে ওঠে দ্বাদশ পংক্তির
উপান্তে অবস্থিত বিদ্রোহী
শহর ,
লাল গড়িয়ে গড়িয়ে স্বয়ং রচিত হ’য়ে ওঠে
ত্রয়োদশ - চতুর্দশ - পঞ্চদশ পংক্তি
, এবং
টলমল করতে থাকে সমগ্র কবিতা -
কাফনে - মোড়া একবিন্দু
অশ্রু !
নাসিরুল ইসলাম
বাচ্চু
বাহাত্তরে , স্বাধীনতা
অব্যবহিত- পরবর্তী কয়েক মাস ,
একটি প্রতীকী চিত্রকল্প- রাইফেলের নলের শীর্ষে রক্তিম
গোলাপ -
আমাকে দখল ক’রে থাকে ৷ সেই চিত্রকল্পরঞ্জিত কোনো এক মাসে ,
মধ্য- বাহাত্তরে ,
এখন আবছা মনে পড়ে
, আমি
প্রথম দেখেছিলাম নাসিরুল
ইসলাম বাচ্চুকে ৷ সদ্য গাম থেকে আসা
ওই ঝলমলে সবুজ তরুণকে দেখে আমার স্বাধীনতালব্ধ
চিত্রকল্প আরো জ্বলজ্বল
ক’রে উঠেছিলো , এবং এখন ব্যাপক
স্মৃতিবিনাশের পরেও আমার মনে পড়ে সংক্রামক আশাবাদের
বাহাত্তরে আমিও কিছুটা আশাবাদি
হ’য়ে উঠেছিলাম ৷
স্বপ্ন দেখেছিলাম রাজিয়ার
নখের মতো উজ্জ্বল
লাল দিন .
সব ভুল সংশোধিত
হবে , সংশোধিত
হবে , সংশোধিত
হবে
ব’লে আমিও অন্তর্লোকে
জপেছিলাম অত্যন্ত অসম্ভব
মন্ত্র ৷
কিন্তু আশা - অন্ধ আর নির্বোধের দুঃস্বপ্ন - টেকে নি
; আরেক ড়িসেম্বর
আসতে - না - আসতেই
আমার স্বাধীনতালব্ধ প্রতিকী
চিত্রকল্প
নষ্ট হ’য়ে যায় ৷ আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে যাই , আরো তিন বছরে
বাঙলাদেশ অনাহার
, হাহাকার , অসুস্থতা , পরাবাস্তব
খুনখারাবিতে
ভ’রে ওঠে এলান পোর গল্পের
মতোই ৷ ফিরে এসে দেখি
বাঙলাদেশ বিদ্রোহ-
বিপ্লব- স্বপ্ন ও আশার যুগের পর গভীর ব্যাপক
এক অপ্রকৃতিস্থতার যুগ শুরু হ’য়ে গেছে ৷ এবং তখনি
এক দিন রাস্তায় আবার দেখা হয় নাসিরুল ইসলাম বাচ্চুর সাথে ;
দেখি সেও নষ্ট হ’য়ে গেছে আমার স্বাধীনতালব্ধ
চিত্রকল্পের
মতোই- সূক্ষ্ন তন্তুর এপারের
বাস্তবতা পার হ’য়ে বাচ্চু অনেক দূরে
চ’লে গেছে তন্তুর
ওপারে ৷ এরপর তার ক্রমপরিনতি , অনেকের
মতো , আমিও দেখেছি ৷ সে আবর্তিত
হ’তে থাকে রোকেয়া
হলের
স্বপ্নদরোজা থেকে নীলখেতের
দুঃস্বপ্ন পর্যন্ত- বিড়বিড়
করতে করতে হাঁটে আর ভাঙা দেয়ালের ওপরে ব’সে
‘প্রেম , প্রেম ,
বিপ্লব , বিপ্লব’ ব’লে চিৎকার
ক’রে থুতু ছুঁড়ে দেয় শহর- স্বদেশ-
সভ্যতা- স্বাধীনতা
প্রভৃতি বস্তুর মুখে ৷ কয়েক বছরে
যৌবন জীর্ণ হ’য়ে নাসিরুল ইসলাম বুড়ো হ’য়ে যায় ,
( এ- সময়ে , আমি লক্ষ্য করেছি ,
যুবকেরাই যৌবন হারিয়েছে
দ্রুতবেগে , আর বাতিল বুড়োরা সে - যৌবন সংগ্রহ
ক’রে
বেশ টসটসে হ’য়ে উঠেছে দিন দিন ) তার চোয়াল দিকে দিকে
ভেঙে পড়ে , মাথায় জন্ম নেয় বাঙলাদেশের
মতো এক ভয়ংকর জট
,
আর সে বাঁ- হাতে আস্তিনের
তলে বইতে থাকে একখণ্ড ইট ৷
পাঁচ বছরে আমার বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প-
রাইফেলের নলের শীর্যে
রক্তিম গোলাপ- রূপান্তরিত হয় একমাথা ভয়ংকর জট আর
আস্তিনের তলে একখণ্ড
ইটে ৷ স্বাভাবিক বাস্তবতা
পেরিয়ে যারা
অস্বাভাবক বাস্তবতায় ঢুকে পড়ে
, তারা
নতুন বাস্তবতায় ঢোকার
আশ্চর্য মাসগুলোতে সবখানে
দেখতে পায় নিজের প্রভাব ৷ নাসিরুলও তার দ্বিতীয় বাস্তবায়
ঢোকার প্রথম পর্যায়ে
বাঙলা ভাষার সমস্ত গদ্যেপদ্যে দেখতে পেতো নিজের প্রভাব ৷ কলাভবনে
একদিন
সে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে , এবং টেবিল থেকে সঞ্চয়িতা
তুলে ওই অমর গ্রন্থের প্রত্যেকটি
ছত্রে সে নিজের সুস্পষ্ট প্রভাব
দেখে চিৎকার ক’রে ওঠে ৷ বুদ্ধদেব
, সুধীনদ্রনাথ , জীবনানন্দের
সমস্ত কবিতা ওর কবিতার অক্ষম নকল ব’লে দাবি করে ৷ আমি
ওর দিকে আমার একটি কবিতা বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাই
কবিতাটি ওর কোনো কবিতা নকল ক’রে লেখা কি
- না ?
নাসিরুল কবিতাটি মনোযোগ
দিয়ে পড়ে , দ্বিতীয়
স্তবকে
‘ ভালোবাসি’ শব্দটি পেয়েই শোরগোল ক’রে বলে
, ‘ এইটা
আমার শব্দ .
আমার কবিতা থেকে মেরে দিয়েছেন’ ৷
খলখল ক’র হাসে নাসিরুল ৷
আমি জানি নাসিরুল
ইসলাম বাচ্চুর কবিতার
কোনো প্রভাব পড়ে নি কারো ওপরেই
- কিন্তু আজকাল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই , রাস্তায়
হাঁটি , ক্লাবের আড্ডায়
বসি , বন্ধুর সংসর্গে
আসি , খবরের কাগজ
পড়ি , টেলিভিশনের বাক্স খুলি
, তখন
বুঝতে পারি চারদিকে
কী গভীর
তীব্রভাবে পড়েছে নাসিরুল
ইসলাম বাচ্চুর ব্যক্তিগত
প্রভাব ৷
নাসিরুলকে অনুসরণ ক’রে দলে দলে লোকজন চ’লে যাচ্ছে তন্তুর ওপারে ৷
একুশের উৎসবে বাঙলা একাডেমিতে এক স্টলের সামনে
দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা কয়েকজন
, দেখলাম
রিকশা থেকে নামছেন
এক অর্ধপল্লী অর্ধআধুনিক
কবি ,- লাল টাই অদ্ভুত
জাকেট
গায়ে তাঁর , সব কিছু অবহেলা
ক’রে আমাদের কাছাকাছি
এসে
কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে
রইলেন যেনো বাঙলা একাডেমির
বুড়ো বটের শাখায় দেখতে পাচ্ছিলেন
গোটি দুই ফেরেশতার
ডানা ৷
তিনি কথা শুরু করতেই আমি দেখলাম সরু সুতো পেরিয়ে
যাচ্ছেন তিনি ,
রূপান্তরিত হচ্ছেন
- তাঁর বিকট মাথায় জড়ো হ’য়ে উঠছে জট , জামা
ছিঁড়ে যাচ্ছে
, দড়িতে
রূপান্তরিত হচ্ছে টাই , এবং
বাঁ - হাতে আস্তিনের কাছাকাছি
ধ’রে আছেন একখণ্ড
হলদে ইট ৷ কলাভবনের বারান্দায়
প্রিয় কবিতার খণ্ড খণ্ড
পংক্তি বিড়বিড় করতে করতে
আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন এক তরুণ অধ্যাপক ,
কুশলবিনিময় ছাড়াই
বললেন , ‘আমার যে
- লেখাটিতে আমি এক নতুন তত্ত্ব …আপনি
কি …
সেটা’ …অমনি দেখতে পেলাম তরুণ অধ্যাপক
রূপান্তরিত
হচ্ছেন জট - ছেঁড়া শার্ট - ইটখণ্ডের সমষ্টিতে
৷ অত্যন্ত আতংকে
দৌড়ে আমি ঘরে ঢুকে হাঁপাতে
লাগলাম ৷ বেইলি রোডে এক আমলার
সাথে দেখা হলো , দীর্ঘ সিগারেট
বের ক’রে যেই তিনি আত্মপ্রকাশ
আরম্ভ করলেন
, অমনি
তাঁর অভ্যন্তর থেকে এক মাথা জট
, বাঁ -হাতে
হলদে ইট নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নাসিরল ইসলাম বাচ্চু ৷
এক জনতাজাগানো রাজনীতিকের
সাথে দেখা হলো পানশালায়
৷
‘নাসিরুল এখানেও আসে’ ?
আমি বিস্মিত হ’য়ে যেই স’রে পড়ছিলাম
,
তিনি চিৎকার করতে লাগলেন
, ‘ হেই
ডক্টর আজাদ , আমাকে কি
চিনতে পারছেন না’
? আমি দেখলাম
নাসিরুল আমার পেছনে ছুটছে
,
আর বাঁ - হাতের ইট তুলে আমাকে ডাকছে ৷ পানটান ভুলে আমি
লাফিয়ে রাস্তয় নামলাম
৷ আমার একটি ছাত্রী
, ‘ আসি
স্যার’
বলতেই দরজা জুড়ে দেখলাম এক স্ত্রীলিঙ্গ নাসিরুল
;
আমার ক্লাশের বিনম্র
ছেলেটি একদিন এমনভাবে
তাকায় আমার
দিকে যে আমি তার জট আর ইট দেখে দৌড়ে বেরিয়ে
আসি , সাত দিন আমি আর ক্লাশে যাই না ৷
এখন যখনি রাস্তায়
হাঁটি , খবরের কাগজ উল্টোই
, টেলিভিশনের
চব্বিশ ইঞ্চি বাক্সটা
খুলি , ক্লাবে বা বাজারে যাই ,
সচিবলয়ে ঢুকি
, আলোচনা
কক্ষে বা সবায় গিয়ে বসি , দেখতে পাই
আমাকে ঘিরে ফেলেছে
অসংখ্য নাসরুল ইসলাম বাচ্চু -
মাথায় বাঙলাদেশের মতো জট
, ছেঁড়া
শার্ট , বাঁ -হাতে হলদে ইটের খণ্ড ৷
সেদিন সন্ধ্যায় তিনটা আধাশিক্ষিত কবি , দুটি দ্বান্দ্বিক
প্রবন্ধকার ,
একটা দালাল , তিনটি লুম্পেন
, দুটি
এনজিও , পাঁচটি আমলার
সাথে সমাজ ও শিল্পের সম্পর্ক ,
শিল্প আর জীবনের
বৈপরীত্য ,
অর্থের মূলতত্ত্ব
, তৃতীয়
বিশ্বের রাজনীতির নোংরা ব্যাকরণ
,
গণতন্ত্র , জলপাইরঙের
উথ্থান ইত্যাদি বিষয়ে আজস্র বাক্য ছুঁড়ে
যখন রাস্তায় একা হেঁটে ফিরছিলাম ,
তখন চমকে উঠে টের পাই :
আমার মাথায় শক্ত হ’য়ে উঠছে জট
, শার্ট
ছিঁড়ে যাচ্ছে , গাল ভাঙা ,
বাঁ-হাতে অত্যন্ত যত্নে আমি ধ’রে আছি একখণ্ড
হলদে প্রিয় ইট ৷
পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের উপদ্দেশ
ক্রাচে- ভর-দেয়া স্টেনগান , হুইলচেয়ারে
ধ’সে-পড়া বিধ্বস্ত মর্টার
ফুটপাতে প’ড়ে-থাকা বাতিল গ্রনেড
, নষ্ট বোমা থাবাহীন রয়লবেঙ্গল
যখন খুঁড়িয়ে চলো পা-আর-ডানা-
ভাঙা আলবট্রসের মতো
শেরেবাঙলা নগরের বাস ট্রাক পুলিশিগাড়ির বিবেকহীন সন্ত্রাসের
মধ্য দিয়ে
হামাগুড়ি দিয়ে কাৎ হ’য়ে প’ড়ে থাকো নাবাবপুরর ড্রেন কিংবা আবর্জনস্তূপের
পাশে
আলুর বস্তার মতো প’ড়ে থাকো হৃদস্পন্দনহীন বঙ্গভবনের দেয়াল আর
সান্ত্রীদের পদতলে
যখন প্রচণ্ড ক্রোধে
চিৎকার করতে গিয়ে ব্যাকফায়ার করা
রাইফেলের মতো আর্তনাদ
ক’রে ওঠে তোমাদের
কণ্ঠস্বর
বিকল মেশিনগানের নলের মতো একেকবার
ঝিলিক দিতে গিয়ে অসহয়ভাবে ঢ’লে পড়ে একদা উদ্ধত
মাটি থেকে আকাশে ছড়ানো বাহু
তোমাদের হাজার হাজার চোখের দুপাশে
যখন
ভয়ঙ্কর বিস্ফোরকের মতো বিস্ফোরিত হ’তে গিয়ে
ভেজা বারুদের মতো গ’লে পড়ে এক একটি বিশাল অশ্রুবিন্দু
তখন মনে হয় তোমরা আর যুদ্ধাহত নও
তোমরা সবাই পঙ্গু ,
আভিধানিক অর্থেই পঙ্গু !
ক্রাচে-ভর-দেয়া স্টেনগান
, এখন তোমরা পঙ্গু
তোমাদের ট্রিগারের
সাথে কোনো ম্যাগাজিন সংযুক্ত
নয় ৷
হুইলচেয়ারে ধ’সে-পড়া
বিধ্বস্ত মর্টার ৷ এখন পঙ্গু তোমরা
তোমাদের ভেতরে এখন আর বারুদ আর ইস্পাতের সংমিশ্রণ নেই ৷
ফুটপাতে প’ড়ে থাকা বাতিল গ্রেনেড , এখন পঙ্গু তোমরা
তোমাদের ছুঁড়ে দিলে
এখন সামান্য শব্দও হবে না ৷
নষ্ট বোমা , এখন পঙ্গু
তোমরা , দশবছরের প্রতিক্রিয়াশীল বর্ষণে
তোমাদের ভয়ঙ্কর হৃৎপিণ্ড
নষ্ট হ’য়ে গেছে ৷
থাবাহীন রয়েলবেঙ্গল
, এখন
পঙ্গু তোমরা
তোমাদর থাবা আর ভয়াবহভাবে
ঝকঝক ক’রে উঠবে না ৷
এক দশকেই যুদ্ধাহত
তোমরা সব পঙ্গু হ’য়ে গেছো ৷
এখন বাঙলাদেশে
সব বাঙালিই পঙ্গু
৷
যে - বাঙালিকেই কুশল জিজ্ঞেস
করি
সে - ই জানায় সে আপাদমস্তক পঙ্গু
হ’য়ে গেছে ৷
নদীর ঘোলাটে জলকে জিজ্ঞেস করি : কেমন
আছো ?
ছলছল করে জল
: আমরা পঙ্গু ৷
পাখির ঝাঁককে জিজ্ঞেস
করি : কেমন আছো ?
চর জুড়ে উত্তর আসে
: আমরা
পঙ্গু ৷
বিমর্ষ জোনাকিকে জিজ্ঞেস
করি : কেমন আছো ?
নিবে যেতে যেতে জবাব দেয়
: আমরা পঙ্গু
৷
ধানের হলদে শিষকে জিজ্ঞেস করি
: কেমন আছো ?
আর্তনাদ ক’রে ওঠে ধানখেত : আমরা
পঙ্গু ৷
আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করি
: কেমন আছেন ?
উত্তর পাই : আমি পঙ্গু ৷
স্ত্রীকে কাছে টানলে কান্না শুনি
: আমি পঙ্গু ৷
আমার যে-কন্যা সমস্ত প্রতিরোধ সত্ত্বে
জন্মাতে পেরেছে
তাকে জিজ্ঞেস করি : আম্মু
, তুমি কেমন আছো
?
তার স্বর শুনি : আমি
পঙ্গু ৷
আমার যে-সন্তান ভ্রণ হ’য়ে মায়ের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত
তাকে জিজ্ঞেস করি : অনাগত
, কেমন
রয়েছো ?
তার কণ্ঠ শুনি
: আমি পঙ্গু ৷
ছাত্রকে জিজ্ঞেস করি
: কেমন আছো ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
তার প্রেমিকাকে জিজ্ঞেস
করি : কেমন আছো ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
চাষীকে জিজ্ঞেস করি : কেমন আছেন ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
শ্রমিককে জিজ্ঞেস করি
: কেমন আছেন ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
রিকশাঅলাকে জিজ্ঞেস করি : কেমন আছেন ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
ঠেলাঅলাকে জিজ্ঞেস করি
: কেমন আছো ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস
করি : কেমন আছেন ?
উত্তর : পঙ্গু ৷
আমার স্বপ্নকে আলিঙ্গনে
বেঁধে ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে
নিঃশব্দে জানতে চাই : কেমন রয়েছো প্রিয়তমা ?
নিঃশব্দে জানায় সে
: পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
পঙ্গু
এখন বাঙলাদেশে সব বাঙালিই আপাদমস্তক
পঙ্গু ৷
ক্রাচে-ভর-দেয়া
স্টেনগান
এখন বাঙলাদেশ তোমাদের
মতো পঙ্গু
হুইলচেয়ারে ধ’সে-পড়া বিধ্বস্ত
মর্টার
এখন বাঙলাদেশ তোমাদের
মতোই পঙ্গু
এক দশকেই মুক্তিযোদ্ধা
বাঙালি
আর বাঙলাদেশ
মাথা থেকে হৃৎপিণ্ড থেকে পা পর্যন্ত
পঙ্গু হ’য়ে গেছে ৷
পৃথিবীতে একটিও
বন্দুক থাকবে না
নিত্য নতুন ছোরা ,
ভোজালি , বল্লম উদ্ভাবনের
নাম এ- সভ্যতা ৷
আমি যে- সভ্যতায় বাস করি
যার বিষ ঢোকে ঢোকে গিলে নীল হ’য়ে যাচ্ছে এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা
তার সরকথা হত্যা ,
পুনরায় হত্যা , আর হত্যা ৷
যেদিন আদিম গুহায় পাথর ঘ’ষে ঘ’ষে লাল চোখের এক মানুষ
প্রস্ত্তত করে ঝকঝকে ছুরিকা
, সে
দিন উন্মেষ ঘটে এ-
সভ্যতর
সে যখন ওই ছুরিকা আমূল ঢুকিয়ে দেয়
প্রতিবেশীর লালরঙ হৃৎপিণ্ডে
তখনি বিকাশ শুরু হয়
আমাদের আততায়ী সভ্যতার
৷
এ- সভ্যতা বাঁক নেয় একটা নতুন অস্ত্র আবিষ্কারের
মুহূর্তে-
ভোজালি ছেড়ে বল্লমে
উত্তরণ সূচনা করে নতুন যুগের ,
বারুদের উদ্ভাবনে এ-সভ্যতা
হ’য়ে ওঠে আপাদমস্তক
আধুনিক ৷
এ-সভ্যতার যে-পর্যায়ে
মানুষকে খুবই পরিচ্ছন্ন
সুচারুরূপে নিশ্চিহ্ন করা যায়
,
সে-পর্যায়ই এ- সভ্যতার স্বর্ণযুগ -
আমাদের গৌরব আমরা আজ সভ্যতার
অমানবিক স্বর্ণযুগে উপনীত হয়েছি
৷
আমাদের সৌভাগ্য আমরা খুনি সভ্যতার
চরম বিকাশ দেখতে দেখতে বিকলাঙ্গ , অন্ধ , বিকৃত
হ’য়ে চিহ্নহীন গোরে মিশে যাবো ,
কিন্তু চমৎকার অক্ষত থাকবে নগর , আসবাবপত্র , পুঁজি , অর্থনীতি ৷
আমার শ্যামল কন্যা জন্ম নিয়ে দোলনায় উঠতেই দ্যাখে
তাকে ঘিরে ফেলেছে
লাখলাখ সশস্ত্রবাহিনী ৷
আমার শ্যামল পুত্র জন্ম নিয়ে দোলনায় উঠতেই দ্যাখে
তার দিকে উদ্যত হ’য়ে আছে দশ কোটি জঘন্য রাইফেল
৷
আমার কন্যা তার জননীর স্তনের দিকে তাকাতেই দ্যখে
তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার
জন্যে দশ হাজার ডিভিশন
পদাতিক বাহিনী কুচকাওয়াজ
শুরু করেছে আমেরিকয়
;
আমার পুত্র কোলে ওঠার জন্যে বাহু বাড়াতেই
দ্যাখে
তিন শো বিমানবাহিনীর
দশ হাজার বিমান
ছুঁটে আসছে তারই মাথা লক্ষ্য
ক’রে ;
আমার কন্যার বুক লক্ষ্য ক’রে সমুদ্রে সমুদ্রে
ছোটে আণবিক সাবমেরিন ,
আমার পুত্রের মাথা লক্ষ্য ক’রে দশ দিক থেকে
নির্বিচারে নিক্ষিপ্ত হয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালাস্টিক
মিসাইল ৷
কিন্তু না
, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক
থাকবে না
মানি কি না মানি
পাঁচ হাজার বছর ধ’রে পৃথিবীর
সমস্ত
হোয়াইট হাউজ , ক্রেমলিন
, দশ নম্বর ডাউনিং
স্ট্রট , আর বঙ্গভবন
দখল ক’রে আছে মাফিয়ার সদস্যরাই -
পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান
মাফিয়ার সক্রিয় সদস্য ৷
শিশুর হসির থেকে
বুলেটের খলখল শব্দ ওদের বহু গুণে প্রিয় ,
গোলাপের গন্ধের চেয়ে লাশের গন্ধ ওদের কাছে বেশি প্রীতিকর
৷
শয়তান ওদের আত্মা গন্ধক
-বারুদ -লোহা দিয়ে প্রস্ত্তত
করেছে ৷
কিন্তু না , পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক
থাকবে না ৷
যখন পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়ার
চেয়েও মারাত্মক এক তেজষ্ক্রিয়ায়
,
যার নাম ক্ষুধা ,
বিকলাঙ্গ হ’য়ে যাচ্ছে
আফ্রিকা
অন্ধ হ’য়ে যাচ্ছে এশিয়া
বিকৃত
হ’য়ে যাচ্ছে আমেরিকা
পঙ্গু হ’য়ে যাচ্ছে ইউরোপ
তখনো মাফিয়ার সদস্যরা
পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়ার দুঃস্বপ্নে
উন্মাদ ৷
মানুষের দুর্ভোগ্য মানুষ একটি মিশ্র প্রজাতি
চিরকাল গাধার গর্ভে আর ঔরসে জন্ম নেয় গাধা
,
গরুর গর্ভে ও ঔরসে জন্ম নেয় সরল শান্ত গরু ,
বাঘের ঔরসে আর গর্ভে কখনো কালকেউটে জন্মে না
,
যেমন কালকেউটে কোনো দিন কালকেউটে
ছাড়া
প্রসব করে না হরিণ বা রাজহাঁস বা স্বপ্নের মতো কবুতর ৷
কিন্তু মানুষের ঔরসে আর গর্ভে আমি জন্ম নিতে
দেখেছি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড
গাধা , নর ও নারীর সঙ্গমে
আমি ভূমিষ্ঠ হ’তে দেখেছি আফ্রিকার
নেকড়ের চেয়েও
ভয়াবহ হিংস্র নেকড়ে ৷ ওই নেকড়েরাই
চিরদিন
পৃথিবী চালায় ৷
কিন্তু না , পৃথিবীতে আর কোনো নেকড়ে থাকবে না ৷
কিন্তু না , পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক
থাকবে না ৷
পৃথিবীতে আর কোনো শিরস্ত্রাণ থাকবে না
পৃথিবীতে আর কোনো বুট থাকবে না
পৃথিবীতে থোকায় থোকায় জলপাই থাকবে
কিন্তু কোনো জলপাইরঙের
পোশাক থাকবে না
আকাশভরা তারা থাকবে কিন্তু কারো বুকভরা তারা থাকবে না
পৃথিবীতে একটিও বন্দুক
থাকবে না ৷
এখন নতুন সভ্যতায়
উঠে যেতে হবে পৃথিবীকে
যাতে জন্মেই শিশু শিউরে না ওঠে
তিন বাহিনীর সম্মিলিত
কুচকাওয়াজ দেখে ,
ট্যাংকের অন্ধ ঘড়ঘড় আর বিমানের
কোলাহল শুনে ৷
জন্ম নেয়ার পর তার দিকে দুলে উঠবে ধান আর গমের গুচ্ছ
তাকে কোলে নেয়ার জন্যে দু- বাহু
বাড়াবে আফ্রিকা
দোলনা দুলে উঠবে ইউরোপে
এশিয়ার সমস্ত আকাশে উড়বে লাল নীল রঙিন বেলুন
ঘুমপাড়ানিয়া গান ভেসে আসবে দুই আমেরিকা থেকে
মানুষ্যমণ্ডল থেকে তার জীবনের মাঠে মাঠে অঝোর ধারায়
ঝরবে মানবিকতার উর্বর মেঘদল ৷
না , পৃথিবীতে
আর একটিও বন্দুক
থাকবে না ৷
আশির দশকের
মানুষেরা
এই দশকের মানুষেরা সব গাধা ও গরুর খাদ্য- বিমর্ষ
মলিন ,
মাথা থেকে ফাঁড়া দোমড়ানো ভাঙাচোরা
আত্মা আর অণ্ডকোষহীন
৷
নৈর্ব্যক্তিক
: রেডিমেইড জামা পরে , শয়তানের বাক্য আর বাজারি
বুলিতে
ঠাণ্ডা রাখে দেহমন
: দ্রুতবেগে মল জমে দশকোটি মগজখুলিতে
৷
পিছমুখো গাড়ি চড়ে
, হৃৎপিণ্ড খুঁড়ে ফেলে দুই হাতে ভরে আবর্জনা ,
রমণীসন্ত্রস্ত ব’লে ঘরে মধ্যদিনে স্বহস্তে
মেটায় উত্তেজনা ৷
আলো নেই কোনো দিকে , ঘেন্না করে চাঁদ তারা জোনাকির দ্যুতি ,
লাউডস্পিকারে গায় দিনরাত
পুচকে ছিটকে একনায়কের
স্তুতি ৷
স্বপ্ন নেই বুকে ও বগলে
: কবিতার চেয়ে পদ্য ভালোবাসে
,
প্রেমিকাকে ধর্যকের ঘরে ঠেলে তারা পতিতার ঘরে চ’লে আসে ৷
চুরি করে ছুরি মারে , হঠাৎ পেছনে ছোরা গেঁথে ভাসে ড্রেনে
নর্দমায় ,
তারা নায়কের রক্তে হোলি খেলে আর ভিলেনের
শোকে মূর্ছা যায় ৷
যতোবার জন্ম
নিই
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক
-
ঠিক করি শক্র হবো মানুয়ের
, হবো শয়তানের
চেয়েও চক্রান্তকুশল ৷
গণতন্ত্রের শক্র হবো
, প্রগতি - সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে
থাকবো চিরকাল ৷
প্রকাশ্যে করবো স্তব জনতার
, গোপনে তাদের পিঠে
অতর্কিতে ঢোকাবো ছোরা
; উল্লাসে হেসে উঠবো প্রগতির সমস্ত পতনে ৷
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠক
-
ঠিক করি জুতো হবো স্বৈরাচারী - চেঙ্গিশ বা অন্য কোনো -
একনায়কের ৷
তার পায়ে সেঁটে থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠবো ওপরে
,
বলবো , ‘ স্বৈরতন্ত্র
ছাড়া মানুষ আর সভ্যতার কোনো বর্তমান
- ভবিষ্যৎ নেই’ ৷
বলবো
, ‘ চিরকাল অস্ত্রই
ঈশ্বর’ ৷
প্রতিক্রিয়াশীল হবো হাড়েহাড়ে
, হৃৎপিণ্ড বেজে যাবে , ‘ আমি প্রতিক্রিয়াশীল আমি প্রতিক্রিয়াশীল ’ ৷
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক -
ঠিক করি অত্যন্ত
বিনীত হবো , মাথাটাকে
তুলতেও শিখবো না ৷
মেরুদণ্ড খুলে ছুঁড়ে দেবো আঁস্তাকুড়ে
, ওই বিপজ্জনক
অস্থি
অসাবধান মুহূর্তে উদ্ধতভাবে
তুলে ধরতে পারে বিনীত মস্তক ৷
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠক
-
ঠিক করি হবো ধর্মান্ধ জঘন্যতম
, পারলৌকিক ব্যবসা
ফেঁদে
রঙিন বেহেশ্ ত্ তুলবো দুনিয়ায় ৷ বলবো
, ‘ বিধাতাই পুঁজিবাদী’
৷
বলবো , ‘ তিনি স্বৈরাচারী
; গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তাঁ বিধানে নিষিদ্ধ
’ ৷
শোষণে হবো পরাক্রম
; বলবো , ‘ শোষণই
স্রষ্টার শাশ্বাত বিধান ’ ৷
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠাক
-
ঠিক করি হবো রাজনীতিবিদ : জনতার নামে জমাবো সম্পদ ৷
জাতির দুর্যোগে পালাবো
নিরাপদ স্থানে , সুসময়ে ফিরে এসে
পায়রার মতো খুঁটে খাবো পাকা ধান ৷ কোন্দলে ভাঙবো দল , হবো
বিদেশি এজেন্ট - সারা দেশ বেচে দেবো শস্তায় বিদেশি
বাজারে
যতোবার জন্ম নিই ঠিক কর থাকবো ঠিকঠাক
-
ঠিক করি আমলা হবো , ঝকঝকে জীবন কাটাবো ! বনানীতে বাড়ি করবো
৷
গাড়ি চড়বো চিরকাল
৷ মাসিক বেতন ,
ঘুষ , কালোবাজারিতে
কাটবে জীবন ৷ কোনো পাকা প্রতিক্রিয়াশীলের রূপসী কন্যকে স্ত্রী
ক’রে
ঘরে রাখবো , বাইরে ফষ্টিনষ্টি ক’রে যাবো বন্ধুপত্নীদের
সাথে ৷
স্ত্রী চল্লিশ পেরিয়ে
গেলে আমলাদের ঐতিহ্য
অনুসারে অধস্তন
কোনো আমলার যুবতী বউকে ভাগিয়ে
তুলবো ঘরে
শুরু করবো জ্বলজ্ব’লে রঙিন উৎসব ৷
যতোবার জন্ম নিই ঠিক করি থাকবো ঠিকঠক
কিন্তু প্রত্যেক জন্মে আমার জন্যে থাকে রূঢ রাস্তা আর ফাঁসিকাঠ ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন