হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ
‘ জ্বলো চিতাবাঘ ’ এর
নির্বাচিত কবিতা :
আমি অনেক পাপ করেছি চুলে চোখে পাপের চিহ্ন
বক্ষদেশ হৃৎপিণ্ড
সকল অঙ্গ পাপের রাজ্য
প্লাস্টিক ও নিওন আলোর
অত্যাচারে শতচ্ছিন্ন
তবুও আমি খড়ের মতো সব ঋতুতে
সমান দাহ্য
আমি অনেক পাপ করেছি তোমার কাছে
পরম প্রিয়
তুমি আমায় ক্ষমা কোরো ক্ষমার আগে শাস্তি দিয়ো ৷
হুমায়ুন আজাদ (
অলৌকিক ইস্টিমার )
জ্বলো চিতাবাঘ
কাব্যগ্রন্থটি মার্চ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত
হয়েছে ৷ ১৯৭৫ সালের বাঙলাদেশের
পটপরিবর্তনের পরের সামাজিক
ও রিজনীতিক অবস্থার
প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতাগুলো
এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে ৷ এখান
এর থেকে কিছু নির্বাচিত কবিতার
উল্লেখ করা হলো আগ্রহীদের জন্যে ৷
( ২য় পর্ব )
শত্রুদের মধ্যে
আমার অন্ধ
অন্যমনস্ক পা পড়তেই
রাগী গোখরোর মতো ফুঁসে উঠলো
দিগন্ত
- মেঘের - দিকে - ব’য়ে - যাওয়া লকলকে একটা লাউডগা ,
শেষ
- সংকেত - উদ্যত দোলকের মতো
, রক্তভরা শিরা
লক্ষ্য ক’রে ,
দোলাতে লাগলো
ভয়ঙ্কর কারুকার্যমণ্ডিত প্রতিশোধস্পৃহ মারাত্নক
ফনা ৷
একটি প্রফুল্ল
ধানগাছ , বাল্যস্বপ্ন
সরারাত হানাদার ডাকাত
সর্দারের
ছোরার ঝকঝকে
ঝিলিকের সমান তেজে
ও ক্ষুধায় ও উৎসাহে
আমূল বসিয়ে
দিলো , হৃৎপিণ্ডের
দূরতম রক্ত - মাংস - ও স্বপ্ন - কোষ পর্যন্ত ,
ফসলভরাতুর উজ্জ্বল
সোনালি তীক্ষ্ন সাংঘাতিক
ব্লেড ৷
একটি বর্ণাট্য
বাঘের সৌন্দর্যে - স্বপ্নে - ক্রোধে দিগন্তের
পুব পার থেকে
অভ্র
- বন্যা ভেদ ক’রে
আমার ঘাড়ের ওপর
লাফিয়ে পড়লো
টকটকে লাল একটা
হিংস্র গোলাপ ৷
দিগন্তের পশ্চিম
প্রান্তে , শির লক্ষ্য ক’রে
বিজ্ঞানমনস্ক শত্রু
ছুঁড়ে দিলো
তার স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক
ক্ষেপনাস্ত্র - সূর্যাস্ত
৷
বাল্যপ্রেমিকার মারাত্নক
ওষ্ঠের মতো কেঁপে
উঠলো পদ্মদিঘি ৷
পাতাবাহার বুকের ভীষণ কাছে নিঃশব্দে বাড়িয়ে
ধরলো সবুজ পিস্তল
৷
শেষ নিশ্বাসের
আগে চোখে পড়লো
খেজুরের ডালে
আটকে আছে চাঁদ : বাল্যে খেলা - শেষে - ভুলে - ফেলে - আসা
মেলা - থেকে - কেনা
- শুভ্র বেলুন ৷
সান্ধ্য আইন
কী আর করতে পারতে তুমি
, কী - বা করতে পারতাম আমিই তখন ?
চারদকে ছড়ানো সন্ধ্যা আর তার হিংস্র
নীতিমালা ;
একটা মুমূর্ষ
পাকি থেকে থেকে চিৎকার করছিলো
তীক্ষ্ন সাইরেনে ৷
নিষেধ রাস্তায়
নামা , বাইরে চোখ ফেলা
; তুমি - আমি , সে -
সন্ধায় ,
কী আর করতে পারতাম
পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া ?
কিছুই ধরতে না
- পেরে ,
কাঁপছিলো সমস্ত শহর
, প’ড়ে যাচ্ছিলে
তুমি
মাটির বাড়ির মতো , আমি ধ’সে পড়ছিলাম শহিদ মিনারে ৷
বাইরে ছড়ানো সন্ধ্যা আর তার হিংস্র
নীতিমালা ; কী আর করতে
পারতাম আমরা পরস্পরকে দৃঢ় - তীব্র
আলিঙ্গনে ধ’রে রাখা ছাড়া ?
তখন শরাইখানা
বন্ধ , অপেক্ষাগারে
জলের একটা ফোঁটাও
ছিলো না ৷
তোমার পায়ের পাতা থেকে উঠে আসছিলো
ঝকঝকে লাল তৃষ্ণা
,
আমার মগজের নালি বেয়ে নেমে আসছিলো
সুদীর্ঘ বোশেখি পিপাসা
৷
কী আর করতে পারতাম
আমরা , সাইরেন
ঘেরা - নির্জন সন্ধ্যায় ,
পরস্পরের ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে রক্তের গভীরতম
কুয়ো থেকে
মেদিনীর সবচেয়ে
ঠাণ্ডা জল অবিরাম
পান করা ছাড়া ?
শয্যা দূরের কথা , দশদিগন্তে নড়োবড়ো
একখানা বেষ্ণও ছিলো না ৷
চারদিকে ছড়ানো
রাত্রি , সান্ধ্য
আইন , রাইফেল , হিংস্র নীতিমালা
৷
স্যাঁৎসেঁতে মেঝে একনায়কের মতোই পায়াণ্ড ; কী আর করতে পারতাম
আমরা পরস্পরের
শরীরকে জাজিম ক’রে সারাঘর তাপে ভ’রে
সারারাত প্রথমবারের
মতো সত্যিকার অবিচ্ছেদ্য
ঘুম যাওয়া ছাড়া ?
শ্লোগান
ফিরছে সবাই
, ধারাজলে সুখী খড়কুটো , ফিরছে সবাই ৷
তৃপ্ত উজ্জ্বল
মুখ , সিল্কের
নরম ঢেউ , মসৃন বিহ্বল
চুল
ঠেকিয়ে প্রফুল্ল
মেঘে , বেহালার
সুর ঢেলে ধাতুতে
কংক্রিটে
ব্যর্থতার স্পর্শহীন
বিশাল ব্যাপক জনমণ্ডলি
ফিরে যাচ্ছে ঘরে ৷
পতাকাখচিত সুখ দোলে চারপাশে
, বাতাসে ঝলকে ওঠে সেতারের
সোনা তান
যা কিছু চেয়েছে তারা
: ঘুম , কুসুম , দু -
চোখে নদীর রেখা ,
উজ্জ্বল ধানের গুচ্ছ , ওষ্ঠে পাখির মাংশ , পুলকিত স্ত্রীসঙ্গম
সবই পেয়েছে ৷
মেঘ ফিরে যাচ্ছে , কলসি বোঝাই
তার পাললিক জল ;
জ্যোৎস্নাভরাতুর চাঁদ যায় , নীল থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে মাখন আঁচল ;
পাখি ফেরে
, ঠোঁট থেকে গ’লে পড়ে সুরের শ্রাবণজল
রিকশার বনেটে ;
বাস্তব তরুণ ফিরছে অবাস্তব
তরুণীর হাত ধ’রে ;
জলরাশি , যাচ্ছে আপন শহরে
, শহর , আপন পল্লীতে ; বৃদ্ধ , ফিরে যাচ্ছে যৌবনে ,
বর্ণমালা
, জলতরঙ্গের মতো মৌলিক ধ্বনিতে
;
জনমগুলি ফিরে যাচ্ছে আপন কুলায় সমায়াস্তের
দুর্ভাবনা ভুলে ৷
ক্ষেত , ফিরে যাচ্ছে
ফলন্ত তরঙ্গরাশি শ্রোণিভারে
দোলাতে দোলাতে ;
নৌকা
, তন্বীস্তনের মতো পাল কাঁপে মৌসুমি বাতাসে
;
সবাই ফিরছে ঘরে সুখী তৃপ্ত সুন্দর
মায়াবী ৷
আমি একা , শূন্য বৃক্ষ ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠাণ্ডা
শূন্যতার মুখোমুখি ,
শূন্যতা পেরিয়ে
মূল পৌঁছে শূন্যে
, ডাল নড়ে শূন্যের প্রহারে
;
আমার উত্তরে
কাঁপে শূন্যলোক , দক্ষিনে শূন্যের
ভূভাগ ,
পশ্চিমে ডুবছে লাল শূন্য
, পুবে উঠে আসে ধবধবে ভয়াল শূন্যতা
৷
আমি একা শ্লোগানমুখর , কম্পমান সর্বলোক
, অর্থাৎ শূন্যতা
৷
উথ্থান
জাগলো বীরেরা
! হ’য়ে ছিলো যারা প্রতারিত
পর্যুদস্ত পরাজিত
ক্রীতদাস , সেই স্বতোজ্জ্বল
শক্তিমান রূপোচ্ছল বস্ত্তপুঞ্জ -
সরালো আঙুলে কালো পর্দা চোখ থেকে
, ছিঁড়ে বাহু - জংঘা - গ্রীবা
ও কোমর থেকে ঝকঝকে সোনালি শেকল জাগলো সূর্যাস্তের
চেয়ে সুন্দর ,
সূর্যোদয়ের চেয়ে ভয়াবহ বলিষ্ঠ
বীরেরা ! দেখলো
,
বাঁ
- পাশে চাবুক হাতে সারিসারি অসুস্থ
মানুষ , ডানপাশে
নষ্ট রুগ্ন
মুমূর্ষ প্রকৃতি
৷ সপ্রতিভ স্বাস্থবান
স্বপ্নভারাতুর অমর মেধাবী
বস্তুপুঞ্জ -
মানুষ ও নিসর্গের মিলিত চক্রান্তে পরাভূত
, নিন্দিত শোষিত -
উঠলো
স্বপ্নে - মাংসে বাস্তব - অবাস্তব ক্ষুধাসহ
,
দেখলো চারপাশে
প্রফুল্ল মাংসশব্জি রক্তিম
দ্রাক্ষা ও অঢেল পানীয় ৷
মাইক্রোফোন সমবেত শ্রোতার সামনে সুখে সবুজ শব্জির মতো
মুখে পুড়লো সুস্বাদু বক্তাকে
; ক্যামেরা জিহ্বায়
নিলো তাজা পনিরের
মতো মডেলের
নির্বস্ত্র শরীর ; জাজিম হা - খুলে
লাল - ভেজা মুখে ;
দগ্ধ কাবাবের
মতো , রাখলো সঙ্গমসংযুক্ত দম্পতিকে
;
টেলিভিশন গোগ্রাসে
গিলে ফেললো পুলকিত
দর্শকমণ্ডলি ;
চেয়ার চুয়িংগামের
মতো খসখসে জিবে চুষতে লাগলো শিক্ষক ও রূপসী ছাত্রীকে ৷
শহর পল্লী ও অরণ্যের
সব ফ্ল্যাট গৃহ ও কুটির
স্বপ্নখোর পেটের ভেতর নিঃশেষে
জীর্ণ করতে লাগলো অধিবাসীদের ;
উড়ে
চ’লে গেলো প্লেন শাড়ি
- স্যুট - ওষ্ঠ - ত্বক - গাউন - শোভিত
যাত্রীদের উল্লাসে
হজম ক’রে গাঢ় নীলিমার মাংস খেতে
- খেতে
এক হাজার মাইল বেগে স্বপ্নের উদ্দেশে
৷
টাওয়ার লাল ওষ্ঠ মেলে সূক্ষ্ন সৌন্দর্য
ছড়িয়ে বস্ত্ততে - বাতসে
খেতে লাগলো পৌরসভার সবুজশোভিত
পার্ক , পুস্তক হীরের
দাঁতে আস্তে কাটতে লাগলো তার প্রেমতপ্ত
লাল পাঠিকাকে ;
একটি মহান উজ্জ্বল ট্রাক সুন্দরবনের বর্ণাঢ়্য
বাঘের মতো
গোধুলিকে সৌন্দর্যে
সাজিয়ে লাফিয়ে পড়লো হরিণের মতো
ভীরু বাঙলাদেশর
সবচে সুন্দর কৃষ্ণচূড়া
গাছের ওপর ৷
ফাল্গুনের কুয়াসা - নেশা - লাল রঙ - তীব্র
তরুণীর স্পর্শে জ্ব’লে
ধ্যানী শহিদ মিনার পান করলো রঙিন পুষ্পস্তবক ,
ভোরভারাতুর পুষ্পদাতাদের, - শহরের প্রতিটি
রাস্তার মোড়ে
দ্বীপপুঞ্জে ব’সে স্বপ্নিল পেশল ট্রাম ভীষণ উল্লাসে ছিঁড়েফেড়ে
খেতে লাগলো নির্জন নিসর্গদাস
কবির সবুজ মাংস ,
হলুদ মস্তিষ্ক ,
ধুসর হৃদয় ৷ অবিসারে যাবে ব’লে নগরীর
সর্বোচ্চ চাওয়ার
বুকে গাঁথলো মতিঝিলের
প্রখ্যাত শাপলা ,
এবং প্রবেশ
করলো তার ইস্কুলগামিনী
পঞ্চদশী প্রেমিকার
দিগ্বলয়ের মতো জিন ঠেলে স্বপ্নের সুড়ঙ্গ - পথে
; এভেনিউ হীরণ
অঙ্গের মতো স্ফীত প্রসারিত
দীর্ঘ হ’তে হ’তে দুই হাতে
সরিয়ে সোনালি
পাড় অন্তর্বাস প্রবেশ
করলো তার চন্দ্রাস্তের
মতো
লাস্যময়ি
, চৌরাস্তায় অপেক্ষমান
, ষোড়শী প্রেমিকার
উষ্ণ তীব্র ত্রিকোন মন্দিরে ৷
স্বপ্ন - পরা বাতিস্তম্ভ
দুরে দোলায়িত চাঁদকে
তার উদ্ভিন্নযৌবনা
বাল্যপ্রেমিকার ব্লাউজ - উপচে - পড়া স্তন ভেবে
বাড়ালো দক্ষিন
হাত দিগ্বলয়ে , বাঁ - হাত
বাড়িয়ে দিলো পুব দিকে
দ্বিতীয় স্তনের
আশায় ৷ মোহন প্রেমিক ট্রাক প্রেমিকার দেহ ভেবে ব্রিজ
থেকে মৃত্যু - ভয় - ব্যথা অবহেলা
ক’রে ঝাপিয়ে পড়লো পদ্মায় ;
নৈশ রেলগাড়ি
স্টেশনে অপেক্ষমান তরুণীর
উজ্জ্বল উরুকে তার
স্বপ্নে
-হারিয়ে - যাওয়া রেল ভেবে ঝেঁকেঝেঁকে কেঁপেকেঁপে
নীলে মেঘে
বাঁশি বাজাতে
বাজাতে ছুটে গেলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য
প্রান্তের উদ্দেশে
৷ পাথর -টুকরো হীরকের
গালে ঠোঁট রেখে
ঘুমিয়ে পড়লো ৷ তখন বাঁ
-দিকে কাঁপে সারিসারি
অসুস্থ মানুষ ,
ডানে কাঁপে
, মৃত্যুর ভীতিতে
নীল , রুগ্ন নষ্ট মুমূর্ষু
প্রকৃতি ৷
একাকী কোরাস
কেবল কবিই বেরুতে পারে নিরুদ্দেশে ;
নীতিমামাতাল লাল নৌকা নিয়ে অধীর উন্মাদ
সব চিরনিরুদ্দেশ
নাবিকের মতো
, ছুঁড়ে ফেলে নকশাকম্পাশকাঁটা , বেরিয়েছি
গন্তব্যবিহীন ৷ যদিও সময় আজ উপযুক্ত
নয় সমদ্রযাত্রার ৷
নাবিকেরা দলেদলে
সমুদ্রভীতিতে ভোগে ; সৈকত
- নীলিমা - ঢেউ
সবই শুনেছে
তারা লোকজশ্রুতিতে ৷ স্বপ্নেও তাদের
সমুদ্রে রূপান্তরিত
হয় সুশান্ত ডোবায় - নরম
শয্যার কথা মড়ে পড়ে ;
আর্ত চিৎকারের
মতো সর্বাঙ্গ জড়িয়ে ধরে সামুদ্রিক
অসুস্থতা ৷
সহচর নৌকো
, উদ্দেশ্যশূন্যতার মহাকবি
, আর আমি
ভেসে যাই স্বপ্নজলে ; দূর তীর ঘিরে আছে ১৯৭৯
টি স্বপ্নের অভাব ৷
সদ্ভাব হয় নি কারো সাথে , মাটির ভেতর গেছি
সরল শিকড় হ’য়ে গোপন রসের ধারা মুখে ;
ওই পাললিক
মাটি বাড়িয়েছে মড়ার হাড়ের মতো শুষ্ক ড়াল ,
নিস্প্রাণ ছোবার মতোন সব কিমাকার ফুল ৷
আমি গূঢ় মহাদেশে জলধারা
খুঁজে ব্যথিত স্বরের
মতো
সাজিয়েছি আমার রোদন ৷
সমগ্র ভূতাগব্যাপী
মলবাহ , পুনরাবৃত্ত
মল , আর মলের শোধন ৷
তোমার স্বরের
চাপে কাঁপে যবনিকা
বিশাল প্রদীপ
জ্বলে সীমাশূন্যতায়
তোমার শাণিত হাসি আগুনের শিখা
দাউদাউ জ্ব’লে
উঠে ইশারা জানায়
একটি বিষাক্ত
ক্ষত ক্রমশ বাড়ছে দ্রুত , ঢেলে দিচ্ছে
নিসর্গনীলিমা ;
গোপন অঙ্গের
ক্ষত যে - রকম ক্রমে বাড়ে গ্রাস করে সমস্ত শরীর ৷
হলদে ময়লা পুঁজ করেছে দখল শরীর - ভুভাগ
৷
বান্ধবেরা , দয়িত ও দয়িতরা , সন্তান , স্বপ্নেরা , পুলক , বৃক্ষরা ,
ছাত্ররা , রাষ্ট্রপতি , বিচারপতিরা , মূল
- ও উপ - পতি ও - পত্নিরা
, অধ্যাপক , সচিবেরা , কেরানি , আচার্য ও উপাচার্যরা , দালাল , জনতা , নেতারা , কবিতা , পাঠ্য
- ও অপাঠ্য - পুস্তক
, যাদু ও বিজ্ঞন , শ্রমিকেরা
,
কৃষকেরা , একটি বিশাল ক্ষতে ঢুকে যাচ্ছে , পুঁজ হ’য়ে গলিত মাংসের
থেকে ঝরছে প্রত্যহ ৷ ভিখিরি যেমন বিশুদ্ধির প্রত্যাশায়
রৌদ্রে তুলে ধরে সংগোপন ক্ষত
, জিহ্বায় শোষণ
করে ক্ষতস্থল , প্রয়োজন
স্বপ্ন - রৌদ্রের শোষণ ৷
এদেশ
বদলে যাবে , বদলে দেবে শ্রমিকেরা , অতীন্দ্রীয় ছাপ্পান্নো
হাজার
বর্গমাইল শুদ্ধতা
পাবে মিলিত মেধায়
৷ পরিশুদ্ধি পাবে সব কিছু ,
পদ্যপুঞ্জ পুনরায়
উঠবে কবিতা হ’য়ে
, পরিশুদ্ধ পাঁচটি
স্তবকে
শুদ্ধি পাবে
সমগ্র রবীন্দ্রকাব্য , একটি ধ্বনিতে
ছেঁকে তোলা হবে ঐশী
গীতবিতানের স্বরমালা
৷ যেতে হবে অপেক্ষামান যেখানে
ভয়াল মৃত্যু ,
নয়তবা বিশাল বিজয় ৷ জ’মে যাই তীব্র শীতে জ্ব’লে উঠি তীক্ষ্ন
উত্তাপে
- আমার সামনে কোনো মধ্যপথ ছিলো না
- থাকবে না ৷
উত্তাল উদ্দাম
জল , জলরেখা
; বিশাল পদ্মের
মতো দিগ্বলয় ;
ক্ষয় হ’য়ে
গেছে তীর দৃষ্টি
থেকে ,
রহস্যপ্রসবা টেনে
নেয় আমাদের ৷
একটি অদৃশ্য
পাখি সঙ্গ দেয়
, ডানায় বহন ক’রে
সামুদ্রিক ঢেউ ৷ শরীর - সমুদ্র - ঢেউ এভাবে মিলিত আজ
রক্তে গেঁথে নিচ্ছি সমুদ্রসাগর
; চিরদিন দুলে যাবে সমগ্র শরীরে ৷
নৌকা ছুটে চলে , মহাদেশ সাড়া দেয় জলের অতলে ৷
জ্ব’লে ওঠে রহস্যপ্রদীপ ; বস্ত্তর ভেতরে দৃশ্য , স্বপ্নের নির্মাণ
;
ফোটে রহস্যকুসুম
; শত দলে নৃত্যরত পদ্মের
মতোন পদধ্বনি ; পাখা মেলে রহস্যশাবক ; ডানার পালকে কাঁপে সমুদ্রের
স্বর ৷
অবলীলায় আঙুল গাঁথে শূন্যতার
সাতে শূন্যতাকে ,
অর্ধেক শিখায় উদ্ভাসিত হ’য়ে ওঠে মহাকাল
, মহাকবি নৌকা ছোটে
,
একটি অদৃশ্য
হাত বিশাল আকাশ জুড়ে মেলে দেয় স্তরেস্তরে দিগন্তের পাল ৷
উন্মাদ ও অন্ধরা
‘হুমায়ুন আজাদ
, হতাশ ব্যর্থ
শ্রান্ত অন্ধকারমুখি ;
উৎফুল্ল হয় না কিছুতে
- প্রেমে , পুষ্পে , সঙ্গমেও সুখী
হয় না কখনো ; অপন রক্তের
গন্ধে অসুস্থ , তন্দ্রায়
ধ্বংসের চলচিত্র
দেখে , ঘ্রাণ
শুঁকে সময় কাটায়
;
ওকে বাদ দেয়া হোক
, নষ্ট বদমাশ
হতাশাসংবাদী ৷’
এ - আঁধারে উন্মাদ
ও অন্ধরাই শুধু আশাবাদী
৷
ভূতভবিষ্যৎ
সামনে এগোই , পেছনে চিৎকার
কাঁপে শূন্যতার স্তরেস্তরে -
‘ আয় , ফিরে আয় ’ ৷
এগোই সস্মুখে
: পঁচিশ কিলোমিটার
দূরে ভূমিকম্পগ্রস্থ টাওয়ারের
মতো হেলে আছে জরাজীর্ণ
ব্রোঞ্জের দিগ্বলয় , কাত হ’য়ে আছে
ভয়াবহ ফাটল - ধরা
সূর্যাস্ত ; কয়েক মাইল দূরে পশ্চিম আকাশের
অন্ধ কোণে
, বারবার আন্দোলিত
হ’য়ে এদিকে - ওদিকে ,
উড়ছে সময়ের কালো ঝড়ে অসহায় শাদা সেই পাখির পালক ৷
সামনে এগোই
, পেছনে চিৎকার
বাজে শূন্যতার স্তরেস্তরে
-
‘ আয় , ফিরে আয় ’ ৷
এগোই সন্মুখে
; বিবস্ত্র দণ্ডায়মান
মধ্যপথে যোনি - ও জরায়ু - হীন ,
পাথরের সমান ক্ষুধার্ত , অন্ধ এক নারী ; অনাগত মানুষের
শোভাময় মমিপুঞ্জ
দুই পাশে গণ্ডারের
মতোই নিঃসঙ্গ এক
দুঃস্বপ্নদ্রষ্টা বিজন জলসাঘরে ঝাড়লন্ঠনের
মতো শত চোখে জ্বেলে
রাখে স্বর্ণকঙ্কালের নর্তকি - শরীর
থেকে খ’সে - পড়া ঝলকিত নাচ
৷
সামনে এগোই
, পেছনে চিৎকার
জ্বলে শূন্যতার স্তম্ভেস্তম্ভে -
‘ আয় , ফিরে আয়
’ ৷
এগোই সন্মুখে
; একনায়কের সশস্ত্র সান্ত্রীর
মতো শুল্ক স্বপ্নশূন্য
গাছপালা , মৃত্যু - ঢালা দুর্বোধ্য
নিস্তল পরিখার মতো নদনদী ,
দুর্ভেদ্য প্রাচীরের
মতো পর্বতপুঞ্জ আশ্চর্যকৌশলে
ঘিরে ফেলে চতুর্দক
,
অথচ সান্ত্রী - পরিখা - দেয়াল পেরিয়ে
অত্যন্ত সুদূরে ওড়ে
স্বপ্ন
- ও আলো - পরা গভীর গোপনবাসী একবিন্দু
আলোকিত পাখি ৷
সামনে এগোই
, পেছনে চিৎকার
রটে শূন্যতার স্তরেস্তরে -
‘ আয় , ফিরে আয় ’ ৷
ফিরবো পেছন ?
সন্মুখে তবু তো দোলে ভাঙা দিগ্বলয় , বিভগ্ন সূর্যাস্ত
,
অসহায় পখির পালক , স্বর্ণকঙ্কালের নাচ
, যোনি - ও জরায়ু - হীন
ক্ষুধার্ত ভেনাস
, দুঃস্বপ্ন - ধাতব শুষ্ক গাছপালা , সান্ত্রী
- পরিখা আর
ভয়াবহ দুর্ভেদ্য
প্রাচীর ; পেছনে একাধিপত্য করে শূন্যতা ,
আর তার স্তরেস্তরে
পুঞ্জিভূত আর্ত ,শূন্য , মুমূর্ষ
চিৎকার ৷
বন্যা
আবার এসেছে বন্যা , চারদিক জমজমাট
হ’য়ে উঠবে পুনরায়
৷
সুখপাঠ্য
হ’য়ে উঠবে অপাঠ্য
দৈনিকগুলো ,
গদশ্রান্ত
সংবাদিকদের পিচ্ছিল কলম থেকে
নিষ্ক্রান্ত হবে অভাবিত চিত্রকল্পমণ্ডিত কবিতাআক্রান্ত
গদ্য ,
সরকরি
সম্পাদকের সুখ্যাত সৌন্দর্যবোধ
অবিনশ্বর
ক’রে রাখবে অফসেটে
ছাপা চিত্রাবলি ৷
আবার
এসেছে বন্যা , বাঙলাদেশে শিল্পের
মৌসুম ৷
বিশ্ব
স্থিরচিত্র প্রতিযোগিতার যে -ছবিটি
প্রথম পদক পাবে
আগামি
বছর , আশাহি পেন্টাক্সে সেটি
তুলে
আনবেন শিল্পপ্রাণিত কোনো বাঙালি ফটোগ্রাফার
,
শহরের
সবচে অপাঠ্য দৈনিকটি
, আগামী মাসেই
,
টেলেক্সে
লণ্ডনে দেবে লাইনো মেশিন অর্ডার
৷
টেলিভিশন
পুনরায় বোধ করবে কবিতার প্রয়োজন
,
ক্যামেরার
মুখোমুখি বসবে আসর
, হয়তো আমিই হবো
বন্যা
ও কবিতার পারস্পরিক
সম্পর্ক বিশ্লেষণকারী
দুর্দান্ত
পাণ্ডিত্যপূর্ণ গম্ভীর উপস্থাপক
,
এবার
কেবলমাত্র ক্যামেরামুখ কবিদেরই
আমন্ত্রণ
জানাবে প্রযোজক ৷
আবার এসেছে বন্যা , আবার দেখতে পাবো পথেপথে
শোকভরাতুর সেবিকাপুঞ্জের
ক্ষুধাহর , আশ্রয় - ইশারাভরা
পদ্মার
ঢেউয়ের মতো ঢেউভরা
মেদ ,
আনন্দমুখর হবে সন্ধ্যাগুলো
- দয়াবতী প্রধান বেশ্যার
নাচ
ওয়েসিসে
, আন্তর্জাতিক কাঁপবে
লাস্যময়ী গায়িকার তীব্র শ্রোণিভারে ৷
আবার এসেছে বন্যা , ইতর গ্রাম্যলোক
কাছ থেকে দেখতে পাবে
সুবেশ
, সভ্যতা , কপ্টার , লাল ওষ্ঠ
, বিলিতি কম্বল
,
সেবাময়ীদের উদ্ধত বক্ষ ও জংঘার নিপুন আর তীক্ষ্ন
আন্দোলন ৷
আবার এসেছে বন্যা , ক্ষমতর উৎস যারা তারা খুব কাছ থেকে
দেখতে
পাবে ক্ষমতার পরিণতিদের
, এবং বুঝতে পারবে
ক্ষমতার
পরিণতি কী - রকম শোকাবহ
করুণ ব্যাপর ৷
আবার
এসেছে বন্যা , গৃহবন্দী রাজনীতিবিদদের গনতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার
এইতো
সুযোগ ৷ এবং সুযোগ তার - হ্যান্ডশেক , পচা গম
,
আণ্ডার
সমান অশ্রুবিন্দু , দ্রোহীদের বিরুদ্ধে
হুশিয়ারি -
পাকা
সিংহাসন ৷
আবার এসেছে বন্যা , বাঙলার সোনালি
মৌসুম ৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন