হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ ' জ্বালো চিতাবাঘ ' এর কিছু নির্বচিত কবিতা


        হুমায়ুন   আজাদের   কাব্যগ্রন্থ   ‘  জ্বলো   চিতাবাঘ ’ এর  নির্বাচিত  কবিতা  :

                    আমি  অনেক  পাপ  করেছি  চুলে  চোখে  পাপের  চিহ্ন
                          বক্ষদেশ  হৃৎপিণ্ড  সকল  অঙ্গ  পাপের  রাজ্য
                     প্লাস্টিক  ও  নিওন    আলোর    অত্যাচারে    শতচ্ছিন্ন
                     তবুও  আমি   খড়ের  মতো   সব  ঋতুতে   সমান   দাহ্য
                     আমি  অনেক  পাপ  করেছি  তোমার   কাছে   পরম   প্রিয়
                     তুমি  আমায়  ক্ষমা  কোরো   ক্ষমার   আগে   শাস্তি   দিয়ো ৷
                                         হুমায়ুন  আজাদ  ( অলৌকিক  ইস্টিমার )

                                জ্বলো   চিতাবাঘ  কাব্যগ্রন্থটি  মার্চ   ১৯৮০  সালে  প্রকাশিত   হয়েছে  ৷  ১৯৭৫  সালের  বাঙলাদেশের  পটপরিবর্তনের  পরের   সামাজিক  ও  রিজনীতিক  অবস্থার  প্রেক্ষাপটে   রচিত   কবিতাগুলো  এই  গ্রন্থে  স্থান  পেয়েছে  ৷ এখান  এর  থেকে  কিছু  নির্বাচিত  কবিতার  উল্লেখ  করা  হলো  আগ্রহীদের  জন্যে  ৷
                     ( ২য়  পর্ব  )

                               শত্রুদের   মধ্যে 

আমার   অন্ধ   অন্যমনস্ক   পা   পড়তেই   রাগী   গোখরোর   মতো   ফুঁসে   উঠলো
দিগন্ত - মেঘের - দিকে - ব’য়ে - যাওয়া   লকলকে   একটা  লাউডগা  , 
শেষ - সংকেত - উদ্যত   দোলকের   মতো  ,  রক্তভরা   শিরা   লক্ষ্য   ক’রে  , 
দোলাতে   লাগলো   ভয়ঙ্কর   কারুকার্যমণ্ডিত   প্রতিশোধস্পৃহ   মারাত্নক   ফনা  ৷

একটি   প্রফুল্ল   ধানগাছ  ,  বাল্যস্বপ্ন   সরারাত   হানাদার   ডাকাত   সর্দারের
ছোরার   ঝকঝকে   ঝিলিকের   সমান   তেজে   ও   ক্ষুধায়   ও   উৎসাহে
আমূল   বসিয়ে   দিলো  ,  হৃৎপিণ্ডের   দূরতম   রক্ত - মাংস - ও   স্বপ্ন - কোষ পর্যন্ত  ,
ফসলভরাতুর   উজ্জ্বল   সোনালি   তীক্ষ্ন   সাংঘাতিক   ব্লেড  ৷

একটি   বর্ণাট্য   বাঘের   সৌন্দর্যে - স্বপ্নে - ক্রোধে   দিগন্তের   পুব   পার   থেকে
অভ্র - বন্যা   ভেদ   ক’রে   আমার   ঘাড়ের   ওপর
লাফিয়ে   পড়লো   টকটকে   লাল   একটা   হিংস্র   গোলাপ  ৷

দিগন্তের   পশ্চিম   প্রান্তে  ,  শির   লক্ষ্য   ক’রে   বিজ্ঞানমনস্ক   শত্রু
ছুঁড়ে   দিলো   তার   স্বয়ংক্রিয়   পারমাণবিক   ক্ষেপনাস্ত্র  -  সূর্যাস্ত  ৷
বাল্যপ্রেমিকার   মারাত্নক   ওষ্ঠের   মতো   কেঁপে    উঠলো   পদ্মদিঘি ৷

পাতাবাহার  বুকের  ভীষণ  কাছে  নিঃশব্দে  বাড়িয়ে  ধরলো  সবুজ  পিস্তল  ৷
শেষ   নিশ্বাসের   আগে   চোখে   পড়লো   খেজুরের   ডালে
আটকে   আছে   চাঁদ  :   বাল্যে   খেলা - শেষে - ভুলে - ফেলে - আসা
                               মেলা - থেকে - কেনা - শুভ্র   বেলুন   ৷  

                
                     সান্ধ্য   আইন

কী  আর  করতে  পারতে  তুমি ,  কী - বা  করতে  পারতাম  আমিই   তখন  ?
চারদকে  ছড়ানো  সন্ধ্যা  আর  তার  হিংস্র   নীতিমালা  ;
একটা  মুমূর্ষ  পাকি  থেকে  থেকে  চিৎকার  করছিলো  তীক্ষ্ন  সাইরেনে  ৷
নিষেধ  রাস্তায়  নামা  ,  বাইরে  চোখ  ফেলা  ;  তুমি - আমি  ,  সে - সন্ধায়  ,
কী  আর  করতে  পারতাম  পরস্পরের  দিকে  চেয়ে  থাকা  ছাড়া  ?

কিছুই  ধরতে  না - পেরে  ,  কাঁপছিলো  সমস্ত  শহর  ,  প’ড়ে  যাচ্ছিলে  তুমি
মাটির  বাড়ির  মতো  ,  আমি  ধ’সে  পড়ছিলাম  শহিদ  মিনারে  ৷
বাইরে  ছড়ানো  সন্ধ্যা  আর  তার  হিংস্র  নীতিমালা  ;  কী  আর  করতে
পারতাম  আমরা  পরস্পরকে  দৃঢ় - তীব্র  আলিঙ্গনে  ধ’রে  রাখা  ছাড়া  ?

তখন  শরাইখানা  বন্ধ  ,  অপেক্ষাগারে  জলের  একটা  ফোঁটাও  ছিলো  না  ৷
তোমার  পায়ের  পাতা  থেকে  উঠে  আসছিলো  ঝকঝকে  লাল  তৃষ্ণা  ,
আমার  মগজের  নালি  বেয়ে  নেমে  আসছিলো  সুদীর্ঘ  বোশেখি  পিপাসা  ৷
কী  আর  করতে  পারতাম  আমরা  ,  সাইরেন  ঘেরা - নির্জন  সন্ধ্যায়  ,
পরস্পরের  ঠোঁটে  ঠোঁট  দিয়ে  রক্তের  গভীরতম  কুয়ো  থেকে
মেদিনীর  সবচেয়ে  ঠাণ্ডা  জল  অবিরাম  পান  করা  ছাড়া  ?

শয্যা  দূরের  কথা  ,  দশদিগন্তে  নড়োবড়ো  একখানা  বেষ্ণও  ছিলো  না  ৷
চারদিকে  ছড়ানো   রাত্রি  ,  সান্ধ্য  আইন ,  রাইফেল  ,  হিংস্র  নীতিমালা  ৷
স্যাঁৎসেঁতে  মেঝে  একনায়কের  মতোই  পায়াণ্ড  ;  কী  আর  করতে  পারতাম
আমরা  পরস্পরের  শরীরকে  জাজিম  ক’রে  সারাঘর  তাপে  ভ’রে
সারারাত  প্রথমবারের  মতো  সত্যিকার  অবিচ্ছেদ্য  ঘুম  যাওয়া  ছাড়া  ?

                              শ্লোগান


ফিরছে  সবাই  ,  ধারাজলে  সুখী  খড়কুটো  ,  ফিরছে  সবাই  ৷
তৃপ্ত  উজ্জ্বল  মুখ  ,  সিল্কের  নরম  ঢেউ  ,  মসৃন  বিহ্বল  চুল
ঠেকিয়ে  প্রফুল্ল  মেঘে  ,  বেহালার  সুর  ঢেলে  ধাতুতে  কংক্রিটে
ব্যর্থতার  স্পর্শহীন  বিশাল  ব্যাপক  জনমণ্ডলি  ফিরে  যাচ্ছে  ঘরে  ৷
পতাকাখচিত  সুখ  দোলে  চারপাশে  ,  বাতাসে  ঝলকে  ওঠে  সেতারের  সোনা  তান
যা  কিছু  চেয়েছে  তারা  :  ঘুম  ,  কুসুম  ,  দু - চোখে  নদীর  রেখা  ,
উজ্জ্বল  ধানের  গুচ্ছ  ,  ওষ্ঠে  পাখির  মাংশ  ,  পুলকিত  স্ত্রীসঙ্গম  সবই  পেয়েছে  ৷
মেঘ  ফিরে  যাচ্ছে  ,   কলসি   বোঝাই   তার  পাললিক   জল  ;
জ্যোৎস্নাভরাতুর  চাঁদ  যায়  ,  নীল  থেকে  মাটিতে  গড়িয়ে  পড়ে  মাখন  আঁচল  ;
পাখি  ফেরে  ,  ঠোঁট  থেকে  গ’লে  পড়ে  সুরের  শ্রাবণজল  রিকশার  বনেটে  ;
বাস্তব  তরুণ  ফিরছে  অবাস্তব  তরুণীর  হাত  ধ’রে  ;
জলরাশি  ,  যাচ্ছে  আপন  শহরে , শহর , আপন পল্লীতে ; বৃদ্ধ , ফিরে যাচ্ছে যৌবনে ,
বর্ণমালা ,  জলতরঙ্গের  মতো  মৌলিক  ধ্বনিতে  ;
জনমগুলি  ফিরে  যাচ্ছে  আপন  কুলায়  সমায়াস্তের  দুর্ভাবনা  ভুলে  ৷
ক্ষেত  ,  ফিরে  যাচ্ছে  ফলন্ত  তরঙ্গরাশি  শ্রোণিভারে  দোলাতে  দোলাতে  ;
নৌকা ,  তন্বীস্তনের  মতো  পাল  কাঁপে  মৌসুমি  বাতাসে  ;
সবাই  ফিরছে  ঘরে  সুখী  তৃপ্ত  সুন্দর  মায়াবী  ৷

আমি  একা ,  শূন্য  বৃক্ষ ,  দাঁড়িয়ে  রয়েছি  ঠাণ্ডা  শূন্যতার  মুখোমুখি  ,
শূন্যতা  পেরিয়ে  মূল  পৌঁছে  শূন্যে  ,  ডাল  নড়ে  শূন্যের  প্রহারে  ;
আমার  উত্তরে  কাঁপে  শূন্যলোক  ,  দক্ষিনে  শূন্যের  ভূভাগ  ,
পশ্চিমে  ডুবছে  লাল  শূন্য  ,  পুবে  উঠে  আসে  ধবধবে  ভয়াল  শূন্যতা  ৷
আমি  একা  শ্লোগানমুখর  ,  কম্পমান   সর্বলোক  ,  অর্থাৎ   শূন্যতা  ৷

                                উথ্থান

জাগলো  বীরেরা  !  হ’য়ে  ছিলো  যারা  প্রতারিত  পর্যুদস্ত  পরাজিত 
ক্রীতদাস  ,  সেই  স্বতোজ্জ্বল  শক্তিমান  রূপোচ্ছল  বস্ত্তপুঞ্জ -
সরালো  আঙুলে  কালো  পর্দা  চোখ  থেকে  ,  ছিঁড়ে  বাহু - জংঘা - গ্রীবা
ও  কোমর  থেকে  ঝকঝকে  সোনালি  শেকল  জাগলো  সূর্যাস্তের  চেয়ে সুন্দর  ,
সূর্যোদয়ের  চেয়ে  ভয়াবহ  বলিষ্ঠ  বীরেরা  !  দেখলো  , 
বাঁ - পাশে  চাবুক  হাতে  সারিসারি  অসুস্থ  মানুষ  ,  ডানপাশে  নষ্ট  রুগ্ন
মুমূর্ষ  প্রকৃতি  ৷  সপ্রতিভ  স্বাস্থবান  স্বপ্নভারাতুর  অমর  মেধাবী  বস্তুপুঞ্জ -
মানুষ  ও  নিসর্গের  মিলিত  চক্রান্তে  পরাভূত  ,  নিন্দিত  শোষিত -
         উঠলো  স্বপ্নে - মাংসে  বাস্তব - অবাস্তব  ক্ষুধাসহ  ,  
দেখলো  চারপাশে  প্রফুল্ল  মাংসশব্জি  রক্তিম  দ্রাক্ষা  ও  অঢেল  পানীয়  ৷
মাইক্রোফোন  সমবেত  শ্রোতার  সামনে  সুখে  সবুজ  শব্জির   মতো
মুখে  পুড়লো  সুস্বাদু  বক্তাকে  ;  ক্যামেরা  জিহ্বায়  নিলো  তাজা  পনিরের
মতো  মডেলের  নির্বস্ত্র  শরীর  ;  জাজিম  হা - খুলে  লাল - ভেজা  মুখে  ;
দগ্ধ  কাবাবের  মতো  ,  রাখলো  সঙ্গমসংযুক্ত   দম্পতিকে  ;
টেলিভিশন  গোগ্রাসে  গিলে  ফেললো  পুলকিত   দর্শকমণ্ডলি  ; 
চেয়ার  চুয়িংগামের  মতো  খসখসে  জিবে  চুষতে  লাগলো  শিক্ষক  ও রূপসী ছাত্রীকে ৷
                শহর  পল্লী  ও  অরণ্যের  সব  ফ্ল্যাট  গৃহ  ও  কুটির 
স্বপ্নখোর  পেটের  ভেতর  নিঃশেষে  জীর্ণ  করতে  লাগলো  অধিবাসীদের  ; 
               উড়ে  চ’লে  গেলো  প্লেন  শাড়ি - স্যুট - ওষ্ঠ - ত্বক - গাউন - শোভিত
                যাত্রীদের  উল্লাসে  হজম  ক’রে  গাঢ়  নীলিমার  মাংস  খেতে - খেতে 
                             এক  হাজার  মাইল  বেগে  স্বপ্নের  উদ্দেশে  ৷
টাওয়ার  লাল  ওষ্ঠ  মেলে  সূক্ষ্ন  সৌন্দর্য  ছড়িয়ে  বস্ত্ততে - বাতসে
খেতে  লাগলো  পৌরসভার  সবুজশোভিত  পার্ক ,  পুস্তক  হীরের 
দাঁতে  আস্তে  কাটতে  লাগলো  তার  প্রেমতপ্ত  লাল  পাঠিকাকে  ;
একটি  মহান  উজ্জ্বল  ট্রাক  সুন্দরবনের  বর্ণাঢ়্য  বাঘের  মতো 
গোধুলিকে  সৌন্দর্যে  সাজিয়ে  লাফিয়ে  পড়লো  হরিণের  মতো
ভীরু  বাঙলাদেশর  সবচে  সুন্দর  কৃষ্ণচূড়া  গাছের  ওপর  ৷
ফাল্গুনের  কুয়াসা - নেশা - লাল  রঙ - তীব্র  তরুণীর  স্পর্শে  জ্ব’লে
ধ্যানী  শহিদ  মিনার  পান  করলো  রঙিন  পুষ্পস্তবক  ,
ভোরভারাতুর  পুষ্পদাতাদের, - শহরের  প্রতিটি  রাস্তার  মোড়ে
দ্বীপপুঞ্জে  ব’সে  স্বপ্নিল  পেশল  ট্রাম  ভীষণ  উল্লাসে  ছিঁড়েফেড়ে
খেতে  লাগলো  নির্জন  নিসর্গদাস  কবির  সবুজ  মাংস  ,
হলুদ  মস্তিষ্ক ,  ধুসর  হৃদয়  ৷  অবিসারে  যাবে  ব’লে  নগরীর
সর্বোচ্চ  চাওয়ার  বুকে  গাঁথলো  মতিঝিলের  প্রখ্যাত  শাপলা  , 
এবং  প্রবেশ  করলো  তার  ইস্কুলগামিনী  পঞ্চদশী  প্রেমিকার
দিগ্বলয়ের  মতো  জিন  ঠেলে  স্বপ্নের  সুড়ঙ্গ - পথে  ; এভেনিউ  হীরণ
অঙ্গের  মতো  স্ফীত  প্রসারিত  দীর্ঘ  হ’তে  হ’তে  দুই  হাতে
সরিয়ে  সোনালি  পাড়  অন্তর্বাস  প্রবেশ  করলো  তার  চন্দ্রাস্তের  মতো
লাস্যময়ি ,  চৌরাস্তায়  অপেক্ষমান  ,  ষোড়শী  প্রেমিকার  উষ্ণ  তীব্র ত্রিকোন মন্দিরে ৷
                  স্বপ্ন - পরা  বাতিস্তম্ভ  দুরে  দোলায়িত  চাঁদকে
তার  উদ্ভিন্নযৌবনা  বাল্যপ্রেমিকার  ব্লাউজ - উপচে - পড়া  স্তন  ভেবে
বাড়ালো  দক্ষিন  হাত  দিগ্বলয়ে ,  বাঁ - হাত  বাড়িয়ে  দিলো  পুব  দিকে
দ্বিতীয়  স্তনের  আশায়  ৷  মোহন  প্রেমিক  ট্রাক  প্রেমিকার  দেহ  ভেবে  ব্রিজ
থেকে  মৃত্যু - ভয় - ব্যথা  অবহেলা  ক’রে  ঝাপিয়ে  পড়লো  পদ্মায়  ;
নৈশ  রেলগাড়ি  স্টেশনে  অপেক্ষমান  তরুণীর  উজ্জ্বল  উরুকে  তার
স্বপ্নে -হারিয়ে - যাওয়া  রেল  ভেবে  ঝেঁকেঝেঁকে  কেঁপেকেঁপে  নীলে  মেঘে
বাঁশি  বাজাতে  বাজাতে  ছুটে  গেলো  পৃথিবীর  এক  প্রান্ত  থেকে  অন্য 
প্রান্তের  উদ্দেশে  ৷  পাথর -টুকরো  হীরকের  গালে  ঠোঁট  রেখে
ঘুমিয়ে  পড়লো  ৷  তখন  বাঁ -দিকে  কাঁপে  সারিসারি  অসুস্থ  মানুষ ,
ডানে  কাঁপে  ,  মৃত্যুর  ভীতিতে  নীল  ,  রুগ্ন  নষ্ট  মুমূর্ষু   প্রকৃতি  ৷ 

                        একাকী   কোরাস 

কেবল  কবিই  বেরুতে  পারে  নিরুদ্দেশে  ;
নীতিমামাতাল  লাল  নৌকা  নিয়ে  অধীর  উন্মাদ  সব  চিরনিরুদ্দেশ
নাবিকের  মতো  ,  ছুঁড়ে  ফেলে  নকশাকম্পাশকাঁটা  ,  বেরিয়েছি
গন্তব্যবিহীন  ৷  যদিও  সময়  আজ  উপযুক্ত  নয়  সমদ্রযাত্রার  ৷
নাবিকেরা  দলেদলে  সমুদ্রভীতিতে  ভোগে  ;  সৈকত - নীলিমা - ঢেউ
সবই  শুনেছে  তারা  লোকজশ্রুতিতে  ৷  স্বপ্নেও  তাদের 
সমুদ্রে  রূপান্তরিত  হয়  সুশান্ত  ডোবায় - নরম  শয্যার  কথা  মড়ে  পড়ে  ;
আর্ত  চিৎকারের  মতো  সর্বাঙ্গ  জড়িয়ে  ধরে  সামুদ্রিক  অসুস্থতা  ৷
সহচর  নৌকো  ,  উদ্দেশ্যশূন্যতার  মহাকবি  ,  আর  আমি 
ভেসে  যাই  স্বপ্নজলে  ;  দূর  তীর  ঘিরে  আছে  ১৯৭৯ টি  স্বপ্নের  অভাব  ৷
সদ্ভাব  হয়  নি  কারো  সাথে  ,  মাটির  ভেতর  গেছি
সরল  শিকড়  হ’য়ে  গোপন  রসের  ধারা  মুখে  ;
ওই  পাললিক  মাটি  বাড়িয়েছে  মড়ার  হাড়ের  মতো  শুষ্ক  ড়াল  ,
নিস্প্রাণ  ছোবার  মতোন  সব  কিমাকার  ফুল  ৷
আমি  গূঢ়   মহাদেশে  জলধারা  খুঁজে  ব্যথিত  স্বরের  মতো
সাজিয়েছি  আমার  রোদন  ৷
সমগ্র  ভূতাগব্যাপী  মলবাহ  ,  পুনরাবৃত্ত  মল  ,  আর  মলের  শোধন  ৷

                তোমার  স্বরের  চাপে  কাঁপে  যবনিকা
                বিশাল  প্রদীপ  জ্বলে  সীমাশূন্যতায়
                তোমার  শাণিত  হাসি  আগুনের  শিখা
                 দাউদাউ  জ্ব’লে  উঠে  ইশারা  জানায়

একটি  বিষাক্ত  ক্ষত  ক্রমশ  বাড়ছে  দ্রুত  ,  ঢেলে  দিচ্ছে  নিসর্গনীলিমা  ;
গোপন  অঙ্গের  ক্ষত  যে - রকম  ক্রমে  বাড়ে  গ্রাস  করে  সমস্ত  শরীর  ৷
হলদে  ময়লা  পুঁজ  করেছে  দখল  শরীর - ভুভাগ  ৷
বান্ধবেরা  ,  দয়িত  ও  দয়িতরা  ,  সন্তান  ,  স্বপ্নেরা  ,  পুলক  ,  বৃক্ষরা  ,
ছাত্ররা  ,  রাষ্ট্রপতি  ,  বিচারপতিরা  ,  মূল - ও  উপ - পতি  ও - পত্নিরা  ,  অধ্যাপক  ,  সচিবেরা  ,  কেরানি  ,  আচার্য  ও  উপাচার্যরা  ,  দালাল  ,  জনতা  ,  নেতারা  ,  কবিতা  ,  পাঠ্য - ও  অপাঠ্য -  পুস্তক  ,  যাদু  ও  বিজ্ঞন  ,  শ্রমিকেরা ,
কৃষকেরা  ,  একটি  বিশাল  ক্ষতে  ঢুকে  যাচ্ছে  ,  পুঁজ  হ’য়ে  গলিত  মাংসের 
থেকে  ঝরছে  প্রত্যহ  ৷  ভিখিরি  যেমন  বিশুদ্ধির  প্রত্যাশায়  রৌদ্রে   তুলে   ধরে             সংগোপন  ক্ষত  ,  জিহ্বায়   শোষণ   করে  ক্ষতস্থল  ,  প্রয়োজন স্বপ্ন - রৌদ্রের শোষণ ৷

          এদেশ  বদলে  যাবে ,  বদলে  দেবে  শ্রমিকেরা , অতীন্দ্রীয়  ছাপ্পান্নো  হাজার 
বর্গমাইল   শুদ্ধতা   পাবে   মিলিত   মেধায়  ৷  পরিশুদ্ধি   পাবে   সব   কিছু  ,
পদ্যপুঞ্জ   পুনরায়   উঠবে   কবিতা   হ’য়ে  ,  পরিশুদ্ধ   পাঁচটি   স্তবকে 
শুদ্ধি   পাবে   সমগ্র   রবীন্দ্রকাব্য  ,  একটি   ধ্বনিতে   ছেঁকে  তোলা  হবে  ঐশী
গীতবিতানের   স্বরমালা  ৷  যেতে  হবে  অপেক্ষামান  যেখানে  ভয়াল  মৃত্যু  , 
নয়তবা  বিশাল  বিজয়  ৷  জ’মে  যাই  তীব্র  শীতে  জ্ব’লে  উঠি  তীক্ষ্ন
উত্তাপে - আমার  সামনে  কোনো  মধ্যপথ  ছিলো  না - থাকবে  না  ৷

উত্তাল  উদ্দাম  জল  ,  জলরেখা  ;  বিশাল  পদ্মের  মতো  দিগ্বলয়  ;
ক্ষয়   হ’য়ে   গেছে   তীর   দৃষ্টি   থেকে  ,
রহস্যপ্রসবা   টেনে   নেয়   আমাদের  ৷
একটি  অদৃশ্য   পাখি  সঙ্গ  দেয়  ,  ডানায়  বহন  ক’রে
সামুদ্রিক  ঢেউ  ৷  শরীর - সমুদ্র - ঢেউ  এভাবে  মিলিত  আজ 
রক্তে  গেঁথে  নিচ্ছি  সমুদ্রসাগর  ;  চিরদিন  দুলে  যাবে  সমগ্র  শরীরে  ৷
নৌকা  ছুটে  চলে  ,  মহাদেশ  সাড়া  দেয়  জলের  অতলে  ৷
জ্ব’লে  ওঠে  রহস্যপ্রদীপ  ;  বস্ত্তর  ভেতরে  দৃশ্য  ,  স্বপ্নের  নির্মাণ  ;
ফোটে  রহস্যকুসুম  ;  শত  দলে  নৃত্যরত  পদ্মের  মতোন  পদধ্বনি  ;  পাখা  মেলে  রহস্যশাবক   ;  ডানার  পালকে  কাঁপে  সমুদ্রের  স্বর  ৷
অবলীলায়  আঙুল  গাঁথে  শূন্যতার  সাতে  শূন্যতাকে  , 
অর্ধেক  শিখায়  উদ্ভাসিত  হ’য়ে  ওঠে  মহাকাল  ,  মহাকবি  নৌকা  ছোটে ,
একটি  অদৃশ্য  হাত  বিশাল  আকাশ  জুড়ে  মেলে  দেয়  স্তরেস্তরে দিগন্তের পাল ৷
  

                         উন্মাদ   ও   অন্ধরা


‘হুমায়ুন   আজাদ  ,  হতাশ   ব্যর্থ   শ্রান্ত   অন্ধকারমুখি  ;
উৎফুল্ল   হয়   না   কিছুতে  -  প্রেমে  ,  পুষ্পে  ,  সঙ্গমেও   সুখী
হয়   না   কখনো  ;  অপন   রক্তের   গন্ধে   অসুস্থ  ,  তন্দ্রায়
ধ্বংসের   চলচিত্র   দেখে  ,  ঘ্রাণ   শুঁকে   সময়   কাটায়  ;
ওকে   বাদ   দেয়া   হোক  ,  নষ্ট   বদমাশ   হতাশাসংবাদী  ৷’
          এ - আঁধারে  উন্মাদ  ও  অন্ধরাই  শুধু  আশাবাদী ৷


                            ভূতভবিষ্যৎ
  সামনে  এগোই  ,  পেছনে  চিৎকার  কাঁপে  শূন্যতার  স্তরেস্তরে -
                      ‘   আয় ,  ফিরে   আয় ’     ৷

এগোই  সস্মুখে  :  পঁচিশ  কিলোমিটার  দূরে  ভূমিকম্পগ্রস্থ  টাওয়ারের
মতো  হেলে  আছে  জরাজীর্ণ  ব্রোঞ্জের  দিগ্বলয়  ,  কাত  হ’য়ে  আছে
ভয়াবহ  ফাটল - ধরা  সূর্যাস্ত  ;  কয়েক  মাইল  দূরে  পশ্চিম  আকাশের
অন্ধ  কোণে  ,  বারবার  আন্দোলিত  হ’য়ে  এদিকে - ওদিকে  ,
উড়ছে  সময়ের  কালো  ঝড়ে  অসহায়  শাদা  সেই  পাখির  পালক  ৷

সামনে  এগোই  ,  পেছনে  চিৎকার  বাজে  শূন্যতার  স্তরেস্তরে  -
                  ‘ আয় , ফিরে  আয় ’    ৷

এগোই  সন্মুখে  ;  বিবস্ত্র  দণ্ডায়মান  মধ্যপথে  যোনি - ও  জরায়ু - হীন ,
পাথরের  সমান  ক্ষুধার্ত  ,  অন্ধ  এক  নারী  ;  অনাগত  মানুষের  
শোভাময়  মমিপুঞ্জ  দুই  পাশে  গণ্ডারের  মতোই  নিঃসঙ্গ  এক 
দুঃস্বপ্নদ্রষ্টা  বিজন  জলসাঘরে  ঝাড়লন্ঠনের   মতো  শত  চোখে  জ্বেলে
রাখে  স্বর্ণকঙ্কালের  নর্তকি - শরীর  থেকে  খ’সে - পড়া  ঝলকিত  নাচ ৷

সামনে  এগোই   ,  পেছনে  চিৎকার  জ্বলে  শূন্যতার  স্তম্ভেস্তম্ভে -
                 ‘ আয় ,  ফিরে  আয় ’   ৷

এগোই  সন্মুখে  ; একনায়কের  সশস্ত্র  সান্ত্রীর  মতো  শুল্ক  স্বপ্নশূন্য
গাছপালা  , মৃত্যু - ঢালা  দুর্বোধ্য  নিস্তল  পরিখার  মতো  নদনদী  , 
দুর্ভেদ্য  প্রাচীরের  মতো  পর্বতপুঞ্জ  আশ্চর্যকৌশলে  ঘিরে  ফেলে  চতুর্দক  ,
অথচ  সান্ত্রী - পরিখা - দেয়াল  পেরিয়ে  অত্যন্ত  সুদূরে  ওড়ে
স্বপ্ন - ও  আলো - পরা  গভীর  গোপনবাসী  একবিন্দু  আলোকিত  পাখি  ৷

সামনে  এগোই  ,  পেছনে  চিৎকার  রটে  শূন্যতার  স্তরেস্তরে -
                   ‘ আয়  ,  ফিরে  আয় ’ ৷
ফিরবো  পেছন  ? সন্মুখে  তবু  তো  দোলে  ভাঙা  দিগ্বলয়  ,  বিভগ্ন  সূর্যাস্ত  ,
অসহায়  পখির  পালক  ,  স্বর্ণকঙ্কালের  নাচ  ,  যোনি - ও  জরায়ু - হীন
ক্ষুধার্ত  ভেনাস  ,  দুঃস্বপ্ন - ধাতব  শুষ্ক  গাছপালা  ,  সান্ত্রী - পরিখা  আর
ভয়াবহ  দুর্ভেদ্য  প্রাচীর  ;  পেছনে  একাধিপত্য  করে  শূন্যতা  ,
     আর  তার  স্তরেস্তরে  পুঞ্জিভূত  আর্ত  ,শূন্য ,   মুমূর্ষ  চিৎকার  ৷

                               বন্যা  

আবার  এসেছে  বন্যা  ,  চারদিক  জমজমাট  হ’য়ে  উঠবে  পুনরায়  ৷
      সুখপাঠ্য  হ’য়ে  উঠবে  অপাঠ্য  দৈনিকগুলো  ,
      গদশ্রান্ত  সংবাদিকদের  পিচ্ছিল  কলম  থেকে
      নিষ্ক্রান্ত  হবে  অভাবিত  চিত্রকল্পমণ্ডিত  কবিতাআক্রান্ত  গদ্য ,
      সরকরি  সম্পাদকের  সুখ্যাত  সৌন্দর্যবোধ
      অবিনশ্বর  ক’রে  রাখবে  অফসেটে  ছাপা  চিত্রাবলি  ৷
      আবার  এসেছে  বন্যা  ,   বাঙলাদেশে  শিল্পের  মৌসুম  ৷
      বিশ্ব  স্থিরচিত্র  প্রতিযোগিতার  যে -ছবিটি  প্রথম পদক পাবে 
      আগামি  বছর  ,  আশাহি  পেন্টাক্সে  সেটি
      তুলে  আনবেন  শিল্পপ্রাণিত  কোনো  বাঙালি  ফটোগ্রাফার  , 
      শহরের  সবচে  অপাঠ্য  দৈনিকটি  ,  আগামী  মাসেই  ,
     টেলেক্সে  লণ্ডনে  দেবে  লাইনো  মেশিন  অর্ডার  ৷
     টেলিভিশন  পুনরায়  বোধ  করবে  কবিতার  প্রয়োজন  ,
     ক্যামেরার  মুখোমুখি  বসবে  আসর  ,  হয়তো  আমিই  হবো 
     বন্যা  ও  কবিতার  পারস্পরিক  সম্পর্ক  বিশ্লেষণকারী
     দুর্দান্ত  পাণ্ডিত্যপূর্ণ  গম্ভীর  উপস্থাপক  ,
     এবার  কেবলমাত্র  ক্যামেরামুখ  কবিদেরই 
     আমন্ত্রণ  জানাবে  প্রযোজক  ৷
আবার  এসেছে  বন্যা  ,  আবার  দেখতে  পাবো  পথেপথে
       শোকভরাতুর  সেবিকাপুঞ্জের  ক্ষুধাহর  ,  আশ্রয় - ইশারাভরা
       পদ্মার  ঢেউয়ের  মতো  ঢেউভরা  মেদ  , 
       আনন্দমুখর  হবে  সন্ধ্যাগুলো - দয়াবতী  প্রধান  বেশ্যার  নাচ
        ওয়েসিসে  ,  আন্তর্জাতিক  কাঁপবে  লাস্যময়ী  গায়িকার  তীব্র  শ্রোণিভারে  ৷
আবার  এসেছে  বন্যা  ,  ইতর  গ্রাম্যলোক  কাছ  থেকে  দেখতে  পাবে
         সুবেশ  ,  সভ্যতা  ,  কপ্টার  ,  লাল  ওষ্ঠ  ,  বিলিতি  কম্বল  ,
         সেবাময়ীদের  উদ্ধত  বক্ষ  ও  জংঘার  নিপুন  আর  তীক্ষ্ন  আন্দোলন  ৷
আবার  এসেছে  বন্যা  ,  ক্ষমতর  উৎস  যারা  তারা  খুব  কাছ  থেকে
         দেখতে  পাবে  ক্ষমতার  পরিণতিদের  ,  এবং  বুঝতে  পারবে
        ক্ষমতার  পরিণতি  কী - রকম  শোকাবহ  করুণ  ব্যাপর  ৷
        আবার  এসেছে  বন্যা  ,  গৃহবন্দী  রাজনীতিবিদদের   গনতন্ত্র  প্রতিষ্ঠার
        এইতো  সুযোগ  ৷  এবং  সুযোগ  তার - হ্যান্ডশেক  ,  পচা  গম  , 
         আণ্ডার  সমান  অশ্রুবিন্দু  ,  দ্রোহীদের  বিরুদ্ধে  হুশিয়ারি -
         পাকা  সিংহাসন  ৷
আবার  এসেছে  বন্যা  ,  বাঙলার  সোনালি  মৌসুম  ৷


                                   

মন্তব্যসমূহ