যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল ;- হুমায়ুন আজাদের একটি কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা ;

  
  
                                   যতোই   গভীরে   যাই   মধু  
                         যতোই   ওপরে    যাই  নীল’ 

কাব্য  গ্রন্থটি  মার্চ   ১৯৮৭   সালে   প্রকাশিত  হয়েছে  .  ধারণা   করা  হয়  , এপ্রিল  ১৯৮৫  সাল  থেকে  মার্চ/ ৮৭  সাল  পর্যন্ত   বিভিন্ন  সম - সাময়িক  ঘটনা  প্রবাহের  সঙ্গে  ভিত্তি   করে  এই  কাব্যগ্রন্থটি  রচিত  হয়েছে  ৷  এখানে  এর  কিছু  ভালোলাগা 
কবিতার  উল্লেখ  করা  হলো  আগ্রহীদের  জন্যে  ৷ 
                           (   ৪র্থ পর্ব    )    

            ‘ চোখ  অন্ধ ,  দেহ  ভগ্ন ,  মুখমণ্ডল  ক্ষতবিক্ষত ,  তবু  হৃদয়  অক্ষত
            আছে  আজো ,  জলেস্থলে  কাঁপে  লতাগুল্ম ,  ডাল  থেকে  অবিরত
            ঝরে  বকুলের  স্নিগ্ধ  গন্ধ ,  বিকেলের  মেঘে  ভ’রে  ওঠে
            দুপুরের  নীল  ;  আশ্চর্য  কম্পন  জাগে ,  রক্ত  দিকে  দিকে  ছোটে  ৷
            অন্ধকারে  থেকেছি  অনেক  কাল ,  মূত্যুর  কামড়ে
            ঘুমিয়েছি  সব  ভুলে ,  ঘাস  নদী  মাঠ  মুখ ,  ঠাণ্ডা  তুষারের  ঝড়ে
            ডুবে  গেছি ,  যেনো  আমি  নেই , -  নেই - ছিলাম  না  কখনো , 
            আমাকে  অচ্ছন্ন  ক’রে  ছিলো  রাত্রি ,  অন্ধকার  ঘন  ৷
            জেগে  দেখি  চোখ  অন্ধ , মুখমণ্ডল  ক্ষতবিক্ষত  ;  তবু  হৃদয়  অক্ষত ,
            কাঁপছো  সেখানে  তুমি ,  একলা ,  সন্ধ্যার  পদ্মের  মতো’   ৷
                                          হৃদয়   অক্ষত,
                                                           হুমায়ুন  আজাদ ,

                                     বিশ্বাস 

জানো ,  তুমি ,  সফল  ও  মহৎ  হওয়ার  জন্যে  চমৎকার  ভণ্ড  হতে  হয়  ?
বলতে  এই  অন্ধকার  কেটে  যাবে , 
চাঁদ  উঠবে ,  পুব  দিগন্ত  জুড়ে  ঘটবে  বিরাট  ব্যাপক
সূর্যোদয়  ৷  বলতে  হয় ,  প্রেমেই  মানুষ  বাঁচে ,
বলতে  হয় ,  অমৃতই  সত্য  বিষ  সত্য  নয়  ৷

জানো ,  তুমি ,  মহৎ  ও  সফল  হওয়ার  জন্যে  ভীষণ  বিশ্বাসী  হ’তে  হয়  ?
বিশ্বাস  রাখতে  হয়  সব  কিছুতেই  ৷
বলতে  হয় ,  আমি  বিশ্বাসী ,  আমি  বিশ্বাস  করি  সভ্যতায় , 
বলতে  হয় ,  মানুষের  ওপর  বিশ্বাস  হারানো  পাপ  ৷
তাই  তো  এখন  সবাই  খুব  বিশ্বাস  ক’রে ,
চারদিকে  এখন  ছড়াছড়ি  বিভিন্ন  শ্রেণীর  বিশ্বাসীর  ৷
একদল  বিশ্বাস  পোষে  ধর্মতন্ত্রে , 
চিৎকার  মিছিল  ক’রে  আরেক  দল  বিশ্বাস  জ্ঞাপন  করে  প্রভুতন্ত্রে  ৷
পুঁজিবাদে  বিশ্বাসীরা  ছড়িয়ে  রয়েছে
প্রথম ,  দ্বিতীয় ,  তৃতীয় ,  ও  সম্ভাব্য  চতুর্থ  বিশ্ব  ভ’রে  ৷
এখন  গণতন্ত্রে  বিশ্বাস  করে  এমনকি  একনায়কেরা ,
কী  সুন্দর  স্তব  করে  তারা  জনতার  ৷
আমার  শহরের  প্রতিটি  মস্তান  এখন  বিশ্বস  করে  সমাজতন্ত্রে ,
বিশ্বাস  ছাড়া  সাফল্য  ও  মহত্ত্বের  কোনো  পথ  নেই  ৷

আমি  জানি  সবচেয়ে  বিশ্বাসযোগ্য  তোমার  ওই  চোখ
আমি  জানি  সবচেয়ে  বিশ্বাসযোগ্য  তোমার  ওই  ওষ্ঠ
সবচেয়ে  নির্ভরযোগ্য  তোমার    বিস্তীর্ণ  দেহতন্ত্র  ৷
তবুও  আমি  যে  কিছুতেই  বিশ্বাস  রাখতে  পারি  না
অবিরাম  ভূমিকম্পে  ধ’সে  পড়ে  বিশ্বাসের  সমস্ত  স্তম্ভ  ৷
এমন  কি  মিলনের  পর  আমাকে  জড়িয়ে  ধ’রে
অন্যমনস্কভাবে  যখন  তুমি  দূর  নক্ষত্রের  দিকে  চেয়ে  থাকো
তখন  যে  আমি  তোমাকেও  বিশ্বাস  রাখতে  পারি  না  ৷

               আমার চোখের সামনে

আমার চোখের সামনে পচে গলে নষ্ট হলো কতো শব্দ, 
কিংবদন্তি, আদর্শ, বিশ্বাস কতো রঙিন গোলাপ
কখনোবা ধীরে ধীরে, কখনো অত্যন্ত দ্রুত, পরিণত হলো ,নোংরা আবর্জনায়
আমার বাল্যে বিপ্লবশব্দটি প্রগতির উথ্থান বোঝাতো
যৌবনে পা দিতে- না-দিতেই দেখলাম শব্দটি পচে যাচ্ছে-
ষড়যন্ত্র, বুটের আওয়াজ,পেছনের দরোজা দিয়ে ,প্রতিক্রিয়ার প্রবেশ বোঝাচ্ছে 
        
সংঘশব্দটি গত এক দশকেই কেমন অশ্লীল হয়ে উঠেছে
এখন সংঘবদ্ধ দেখি নষ্টদের, ঘাতক ডাকাত ভন্ড আর 
প্রতারকেরাই উদ্দীপনাভরে নিচ্ছে সংঘের শরণ যারা 
মানবিক, তারা কেমন নিঃসঙ্গ আর নিঃসংঘ ও 
অসহায় উঠছে দিনদিন
আমার চোখর সামনে শহরের সবচেয়ে রূপসী মেয়েটি 
প্রথমে অভিনেত্রী, তারপর রক্ষিতা, অবশেষে 
বিখ্যাত পতিতা হয়ে উঠলো

এক দশকে যেতে- না যেতেই আমি দেখলাম 
বাঙলার দিকে দিকে একদা মাথা- ছোঁয়া মুক্তিযোদ্ধারা 
কী চমৎকার হয়ে উঠলো রাজাকার

আর   আমার   চোখের   সামনেই   রক্তের দাগ - লাগা   সবুজ   রঙের
বাঙলাদেশ   দিন   দিন  হয়ে   উঠলো   বাঙলাস্তান

                             গরু   ও   গাদা  

আজকাল  আমি  কোনো  প্রতিভাকে  ঈর্ষা  করি  না  ৷
মধুসূদন  রবীন্দ্রনাথ  এমন  কি  সাম্প্রতিক  ছোটোখাটো
শামসুর  রাহমানকেও  ঈর্ষাযোগ্য  ব’লে  গণ্য 
করি  না  ;  বরং  করুণাই  করি  ৷  বড়  বেশি  ঈর্ষা 
করি  গরু  ও  গাধাকে  ; -  মানুষের  কোনো  পর্বে  গরু
ও  গাধারা  এতো  বেশি  প্রতিষ্ঠিত ,  আর  এতো  বেশি
সম্মানিত  হয়  নি  কখনো  ৷  অমর  ও  জীবিত 
গরু  ও  গাধায়  ভ’রে  উঠছে  বঙ্গদেশ  ;  যশ  খ্যাতি 
পদ  প্রতিপত্তি  তাদেরই  পদতলে  ৷  সিংহ  নেই ,
হরিণেরা  মৃত  ;  এ- সুযোগে  বঙ্গদেশ  ভ’রে  গেছে 
শক্তিমান  গরু  ও  গাধায়  ৷  এখন  রবীন্দ্রনাথ
বিদ্যাসাগর  বাঙলায়  জন্ম  নিলে  হয়ে  উঠতেন
প্রতিপত্তিশালী  গরু  আর  অতি  খ্যাতিমান  গাধা  ৷ 

                    নষ্ট  হৃৎপিণ্ডের  মতো  বাঙলাদেশ 

তোমার  দুই  চির- অপ্রতিষ্ঠিত  পুত্র  কবি  ও  কৃষক  ( নিষাদেরাই
প্রতিষ্ঠিত  চিরকাল ) তোমার  রূপের  কথা
 রটায়  দিনরাত  ৷  একজন  ধানখেতে  তোমার  দেহের
স্তব  ক’রে  যেই  গান  গেয়ে  ওঠে  অন্যজন  অমনি  পুথির  ধূসর
পাতা  ভ’রে  তোলে  সমিল  পয়ারে  ৷
একজনকে  তুমি  এক  বিঘে  ধান  দিলে  সে  তোমার  দশ  বিঘে
ভ’রে  তোলে  গানে  ৷  অন্যজনকে  যখন  তুমি
একটি  পংক্তি  দাও  সে  তখন  দশশ্লোক  স্তব  রচে  তোমার  রূপের  ৷
এ  ছাড়া  তোমার  স্তব  কোনো  কালে  বেশি  কেউ
করে  নি  কখনো ,  বরং  কুৎসাই  রটিয়েছে  শতকে  শতকে  ৷
এখন  তো  তুমি  অপরিহার্য  নও  তোমার  অধিকাংশ  পুত্রের  জন্যেই  ৷
অনেকের  চোখেই  এখন  মরুভূমি  তোমার  চেয়েও  বেশি
সবুজ  ও  রূপসী ,  আর  শীতপ্রধান  অঞ্চলের  উষ্ণতা  রক্তেমাংসে
উপভোগে  উৎসাহী  সবাই ,  তাই  তোমাকে   ‘বিদায়’  না  ব’লেই  তারা         ছেড়ে  যাচ্ছে  তোমার  উঠোন  ৷  আর  চিরকলই
ঝোপঝাড়ে  পাটখেতে  ওৎ  পেতে  আছে  অজস্র  ধর্ষণকারী  ৷
কতোবার  যে  দশকে  দশকে  ধর্ষিত  হয়েছো  তুমি ,  তোমার  আর্ত  চিৎকার
মিশে  গেছে  মাঠে  ঘাটে  তুমি  তার  হিশেবও  রাখো  নি  ৷
তুমি  সেই  কৃষক -কন্যা  ,  যে  ধর্ষতা  হ’লে  প্রতিবাদে  কোনো  দিন
সরব  হয়  না  গ্রাম  ৷  আমিও  যে  খুব  ভক্তি  করি  ভালবাসি
তোমাকে ,  তা  নয়  ;  ভাগ্যগুণে  অন্য  গোলার্ধে  আমিও  বিস্তর  রূপসী
দেখেছি  ৷  তাদের  ওষ্ঠ  গ্রীবা  বাহু  এখনো  রক্তে
তোলে  ঢেউ ,  অর্থাৎ  তোমার  রূপে  আমার  দু-চোখ  অন্ধ  হয়  নি  কখনো  ৷
অপরিহার্য  ভাবি  না  তোমাকে ,  তবু  যেই  রক্তে  চাপ  পড়ে
টের  পাই  পাঁজরের  তলে  নষ্ট  হৃৎপিণ্ডের  মতো ,  বাঙলাদেশ , 
সেঁটে  আছে  অবিচ্ছেদ্যভাবে  ৷
                               ---
                        বিজ্ঞাপন  :  বাঙলাদেশ  ১৯৮৬

হ্যাঁ ,  আপনিই  সে -প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি  ৷
        যদি  আপনার  কোনো  মগজ  না  থাকে ,  শুধু  পেশি  থাকে
        যদি  আপনার  কোনো  হৃৎপিণ্ড  না  থাকে ,  শুধু  লিঙ্গ  থাকে
        যদি  আপনার  কোনো  ওষ্ট  না  থাকে ,  শুধু  দাঁত  থাকে
        তাহলে  আপনিই  সেই  প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি 
যদি  আপনি  অবলীলায় ,  একটুও  না  কেঁপে ,  শিশুপার্কে  একঝাঁক  কবুতরের
মতো  ক্রীড়ারত  শিশুদের  মধ্যে  একের  পর  এক
                                                  ছুঁড়ে  দিতে  পারেন  হাতবোমা
যদি  আপনি  কল্লোলমুখর  একটা  কিন্ডারগার্টেনে  পেট্টল  ছড়িয়ে
হাসতে  হাসতে  আগুন  লাগিয়ে  দিতে  পারেন  প্রাতরাশের  আগেই
এবং  পকেটে  হাত  রেখে  সেই  দাউদাউ  অগ্নিশিখার  দিকে
তাকিয়ে  খুব  স্থিরভাবে  টানতে  পারেন  ফাইভ  ফিফটি  ফাইব
   হাঁ ,  তাহলে  আপনিই  সে-প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি 

যদি  আপনি  প্রেমিকাকে  বেড়াতে  নিয়ে  উপর্যপরি  ধর্ষণের  পর
খুন  ক’রে  ঝোপে  ছুঁড়ে  ফেলে  একশো  মইল  বেগে  সাইলেন্সারহীন  হোন্ডা      চালিয়ে  ফিরে  আসতে  পারেন  ন্যাশনাল  পার্ক  থেকে
কলাভবনের  বারান্দায়  যদি  আপনি  অকস্মাৎ  বেল্ট  থেকে  ছোরা  টেনে  নিয়ে
                  আমূল  ঢুকিয়ে  দিতে  পারেন  সহপাঠীর  বক্ষদেশে ,
যদি  আপনি  জেব্রাক্রসিংয়ে  পারাপাররত  পথচারীদের  ওপর  দিয়ে
                  উল্লাসে  চালিয়ে  দিতে  পারেন  হাইজ্যাক  করা  ল্যান্ডরোভার
তাহলে  আপনিই  সেই  প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি

যদি  আপনার  ভেতরে  কোনো  কবিতা  না  থাকে ,  শুধু  হাতুড়ি  থকে
যদি  আপনার  ভেতরে  কোনো  গান  না  থাকে ,  শুধু  কুঠার  থাকে
যদি  আপনার  ভেতরে  কোনো  নাচ  না  থাকে , শুধু  রিভলবার  থকে
যদি  আপনার  ভেতরে  কোনো  স্বপ্ন  না  থাকে ,  শুধু  নরক  থাকে 
তাহলে  আপনিই  সেই  প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি

যদি  আপনি  পিতার  শয্যার  নিচে  একটা  টাইমবোম্ব  ফিট  ক’রে
                                      যাত্রা  করতে  পারেন  পানশালার  দিকে ,
যদি  আপনি  জননীকে  ঠেলে  ফেলে  দিতে  পারেন  টাওয়ারের
                                        আঠারো  তলার  ব্যালকনি  থেকে
যদি  আপনি  আপনার  এলাকার  ফুলের  চেয়েও  রূপসী  মেয়েটির  মুখে
               এসিড  ছুঁড়ে  তাকে  রূপান্তরিত  করতে  পারেন
                                        পৃথিবীর  সবচেয়ে  কুৎসিত  দুঃস্বপ্নে
        তাহলে  আপনিই  সেই  প্রতিভাবান  পুরুষ ,  যাঁকে  আমরা  খুঁজছি

হ্যাঁ , আপনাকেই  নিয়োগ  করা  হবে  আমাদের  মহাব্যবস্থাপক
আপনার  ওপর  ভার  দেয়া  হবে  সমাজের
          আপনার  ওপর  ভার  দেয়া  হবে  রাষ্ট্রের
          আপনার  ওপর  ভার  দেয়া  হবে  সভ্যতার
          আপনার  খাদ্য  হিশেবে  বরাদ্দ  করা  হবে  গুদামের  পর গুদাম ভর্তি বারুদ
           আপনার  চিত্তবিনোদনের  জন্যে  সরবরাহ  করা  হবে লাথ লাখ  স্টেনগান

    আপনিই  যদি  হন  আমাদের  আকাঙ্খিত  প্রতিভাবান  পুরুষ
             তাহলে  ‘  পোস্টবক্স  :  বাঙলাদেশ  ১৯৮৬’ তে 
                                      আজই  আবেদন  করুণ  ৷

                   পুত্রকন্যাদের  প্রতি  ,  মনে   মনে   

মাতৃগর্ভে  অন্ধকারে  ছিলে ,  এখন  তথাকথিত
আলোতে  এসেছো  ৷  ভাবছো  চারদিক  আলোকখচিত  ৷
অপ্রপ্তবয়ষ্ক  কন্যা  ,  শিশু  পুত্র  আমি  বারেবারে 
স্মরণ  করিয়ে  দিতে  চাই  এক  কূট  অন্ধকারে 
আসলে  পোঁচেছো  ৷  এ- সূর্য ,  বিদ্যুৎ ,  নিওন  টিউব 
বড়ো  বেশি  প্রবঞ্চক  ;  পৃথিবীতে  অন্ধকার  খুব  ৷
পথ  দেখানোর  ছলে  এরা  কোনো  ভয়াবহ  খাদে 
পোঁছে  দেবে  তোমাদের  ;  বিপজ্জনক  সব  ফাঁদে
আটকে  যাবে  ৷  চারদিকে  ধ্বনিত  হবে  অর্ত  চিৎকার ,
নিজেদের  ঘিরে  দেখবে  থাবা- মেলা  ক্রুর  অন্ধকার  ৷
তথাকথিত  এ-আলো  ঠাণ্ডা ,  দুষ্ট , কদর্য , কুটিল ,
চক্রান্তপরায়ণ , অন্ধকারের  চেয়েও  অশ্লীল  ৷
আর  ওই  সমাজরাক্ষস ,  তোমাদের  যে-দিকেই  যাবে 
সে  দিকেই  মেলে  দেবে  হিংস্র  হাত- ধ’রে  গিলে  খাবে 
সুযোগ  পেলেই  ৷  তাই  সাবধান , একটু  ফসকালে
পোঁছে  যাবে  উদ্বাররহিত  কোনো  নিস্তল  পাতালে  ৷

আমি  শুধু  জন্মদাতা ,  পিতা  নই  ;  জনক  যদিও -
এ- বাস্তবে ,  অন্ধকারে  আমি  নই  অনুসরণীয়  ৷
আমি  গেছি  যেই  পথে  সেটা  ভুল  পথ  ;  গেছে  যারা
সরল  সঠিক  পুণ্য  পথে  পথপ্রদর্শক  তারা 
তোমাদের  ৷  সামাজিক  পিতাদের  পদাংক  মুখস্থ
কোরো  দিনরাত  ;  অক্ষয়  ধৈর্যে  জেনে  নিয়ো  সমস্ত 
পবিত্র  গন্তব্য  ৷  কারণ  তারাই  এই  অন্ধকারে
মোক্ষধামে  পোঁছোনোর   ঠিক  পথ  ব’লে  দিতে  পারে  ৷

হে  পুত্র ,  তুমি  কিছুতেই  বিশ্বাস  রেখো  না  ৷  ইস্কুলে
শেখাবে  যে-সব  মস্ত  মিথ্যা ,   তাতে  কখনো  ভুলে
বিশ্বাস  কোরো  না  ৷  তোমাদের  সামনে  খোলা  যে-পুস্তক
জেনো  তা  প্রচণ্ড  ভণ্ড ,  মিথ্যাভাষী ,  আর  প্রতারক  ৷
মনে  রেখো  যারা  গলে  ওই  সব  মুদ্রিত  মিথ্যায় ,
পরাজয়  নিয়তি  তাদের , তারা  ধ্বংস  হয়ে  যায়  ৷

ঘৃণা  কোরো  সততাকে  সামাজিক  পিতাদের  মতো
প্রত্যেক  মুহূর্তে ,  অসত্যকে  জপ  কোরো  অবিরত  ৷
সুনীতি  বর্জন   কোরো ,  মহত্ত্বের  মুখে  ছুঁড়ো  থুতু ,
মনুষ্যত্বকে  মাড়াতে  দ্বিধাহীন  হয়  যেনো  জুতো 
তোমার  পায়ের  ৷  দুর্বলকে  নিশ্চিন্তে  পদাঘাত  করো 
পায়ের  আভাস   পেলে  সবলের  নত  হয়ে  পোড়ো
তার  দিকে ,  চিরকাল  সবলের  থেকো  পদানত ,
তার  পদযুগলের  চকচকে  পাদুকার  মতো  ৷
শত্রু  হোয়ো  মানুষের ,  দানবের  পক্ষে  চিরদিন 
দিয়ো  জয়ধ্বনি  ;  প্রতিক্রিয়াশীলতার  নিশান  উড্ডীন 
রেখো  গৃহে  ও  গাড়িতে  ;  নিয়ো  তুমি  প্রত্যহ  উদ্যগ
যাতে  পৃথিবীতে  পুনরায়  ফিরে  আসে  মধ্যযুগ  ৷
যা  কিছুই  মানবিক  তার  শিরে ,  হে  আমার  পুত্র ,
সকালে  দুপুরে  রাত্রে  ঢেলো  তুমি  মল  আর  মূত  ৷

তুমি  তো  জানো  না   কন্যা , শ্যামলাঙ্গী , অমৃতা  হৃদয়া  ;
চলছে  আজ  উজ্জ্বল  পতিতাবৃত্তি ,  এবং  মৃগয়া
এ-গ্রহে , পৃথিবীতে  পতিতারাই  প্রসিদ্ধ  এখন  ৷
জেনো  প্রতিভা - সৌন্দর্য  নয়  যৌন  আবেদন
তোমার  সম্পদ  ৷  শিখে  নিয়ো  তুমি  তার  নিপুন  প্রয়োগ ,
চিত্ত  নয় , দেহ  দিয়ে  পৃথিবীকে  করো  উপভোগ  ৷ 
তোমাকে  সম্ভোগ  করতে  দিয়ো  না  কাউকে  ;  প্রীতি -স্নেহ
থেকে  দূরে  থেকো  ;  যাকে  ইচ্ছে  হয়  তকে  দিয়ো  দেহ ,
কিন্তু  কক্ষণো  কাউকে  হৃদয়  দিয়ো  না  ৷  তুমি  তবে  পরিণত  হবে  লাশে  ;                 আমন্ত্রিত  হবে  না  উৎসবে  ৷

পুত্র  তুমি  জপ  কোরো  দিনরাত -টাকা ,  টাকা , টাকা .
টাকা , টকা  ৷  একমাত্র  ওই  বস্তু  ইন্দ্রজাল  মাখা
পৃথিবীতে  ;  সব  কিছু  নষ্ট  হয় ,  সবই  নশ্বর  ;
টিকে  থকে  শুধু  টাকা -শক্তিমান ,  মেধাবী , অমর ৷
জেনো  পুত্র  মহত্ত্বে  গৌরব  নেই ,  কালোবাজারিতে
নিহিত  গৌরব  ;অমর্ত্য  গীতাঞ্জলির  থেকে  পৃথিবীতে                                        জুতোও  অনেক  দামি ,  অমরত্বের  চেয়ে  শোনো  প্রিয় ,
বহুগুণে  মনোরম  শীতাতাপনিয়ন্ত্রিত  গৃহ  ৷
ভুল  পথে , আমার  মতোন , যেয়ো  নাকো  ; অবিকল
হয়ো  তুমি  সমাজিক  পিতাদের   মতোই  গাড়ল  ৷

মাতৃগর্ভে  অন্ধকারে  ছিলে  ;  এখন  তথাকথিত
আলোতে  এসেছো  ৷  ভাবছো  চারদিক  আলোকখচিত  ৷
অপ্রাপ্তবয়স্ক  কন্যা ,  শিশু  পুত্র  আমি  বারেবরে
স্মরণ  করিয়ে  দিতে  চাই  এক  কূট  অন্ধকারে
আসলে  পৌঁচেছো  ৷  এ - সূর্য ,  বিদ্যুৎ ,  নিওন  টিউব
বড়ো  বেশি  প্রবঞ্চক  ;  পৃথিবীতে  অন্ধকার  খুব  ৷
                (৪র্থ  পর্ব  সমাপ্ত  )   
                            _

  


  

মন্তব্যসমূহ