বাঙলাদেশের বিভিন্ন সময়ের সামাজিক ও রাজনীতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সামন্জস্য রেখে রচিত হুমায়ুন আজাদের কিছু নির্বাচিত কবিতার সংকলন ৷
“ তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না ৷ জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট
ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের
কথা ; তার রাজনীতি , অর্থনীতি
, ধর্ম , পাপ , মিথ্যাচার , পালে পালে মানুষ্যমণ্ডলি , জীবনযাপন , হত্যা , ধর্ষণ
, মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না ; আমি তা মুহূর্তও
সহ্য করতে পারি না , - তার অনেক কারণ রয়েছে ৷”
২০০৪ সালে প্রকাশিত বাঙলাদেশের
কথা , কবিতার কিছু অংশ৷
হুমায়ুন আজাদ বাঙলাদেশের
প্রধান প্রথা বিরোধী
, সত্যনিষ্ট , বহুমাত্রিক , লেখক
৷ তিনি কবি
, ঔপন্যাসিক , ভাষাবিজ্ঞানী , সমালোচক , কিশোর সাহিত্যিক
এবং রাজনীতিক ভাষ্যকার
ও ৷ অন্যদিকে
ডক্টক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক
ও সভাপতি ছিলেন ৷
২০০৪
এর ২৭ ফেব্রুয়ারী
সন্ধ্যায় বাঙলা একাডেমির
বইমেলা থেকে ফেরার সময়, চাপাতি
দিয়ে আক্রমন করে মৌলবাদীরা তাঁকে গুরতর রূপে করলে , কয়েকদিন মূত্যুর
মধ্যে বাস করেও বেঁচে উঠেন ৷ পরবর্তিতে
গবেষনা বূত্তি নিয়ে জার্মানী যান এবং জার্মানী
পৌঁছার পাঁচ দিন পর ১২ আগষ্ট,
২০০৪ সালে মিউনিকয়স্ত
ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে রহস্যজনক ভাবে তাকে মূত অবস্থায় পাওয়া যায় ৷
তাঁর
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা
৬০ এর অধিক ৷ তবে এখানে শুধু তাঁর কয়েকটি
কবিতার বই থেকে বাঙলাদেশের সামাজিক
ও রাজনীতিক প্রেক্ষাপটে
রচিত কিছু বিখ্যাত
কবিতার উল্লেখ করে একটি সংকলন তৈরি করা হয়েছে আগ্রহী
পাঠকদের জন্য ৷
তাঁর “ অলৌকক ইস্টিমার ” কবিতার
বইটি প্রকাশিত হয়েছিল
১৯৭৩ সালে ( ১৯৬৮
- ৭২ : এর রাতদিন
গুলোর উদ্দেশে রচিত )
এই বইয়ের কিছু নির্বাচিত কবিতা ;-
জীবনচরিতাংশ
(১ )
সকল
সম্পর্ক ছিঁড়ে গেলে ভেঙ্গে গেলে সব যোগাযোগ
প্রতিজ্ঞা গভীর স্মূতি মধ্যরাতে
অন্ধকারে আমি জন্ম নিই ৷
জনকের
সঙ্গে তখন অষ্টাদশী
জননীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে
৷
জনকের
ফ্ল্যাট ছেড়ে জননী নতুন ফ্ল্যাটে
উঠে গেলে
আমি
জন্ম নিই ৷ জন্মের সঙ্গেই আমি
ও জননী
উঠে
গেছি ভিন্ন বিছানায়
৷
চারদিকে ঘর ভাঙ্গে ফ্ল্যাট
ওঠে হোটেল মোটেলে
ভ’রে
যায় বাঙলাদেশ
বাঙলার মেয়েরা
সব গান গায় নেচে যায়
সাততলা হোটেলের
প্রমোদখানায় ৷
( ২ )
অভিসারে যাবো ব’লে বেরিয়েছি
রাস্তায়
কস্ত্তরীর অঙ্গুলিসংকেত
আজো বিপর্যয় নিয়ে আসে
আমার
সমস্ত বনে বাগানে
সৈকতে
আমার
গাড়ির সামনে শুধু মিছিলপ্রবণ জনতার দল এসে
আকস্মাৎ পথরোধ করে
,
আমি কী করবো আমি ওভারটেকিং
জানি না ৷
সব
বাধা পিছে ফেলে চৌরাস্তায় এসে দেখি সবুজ সিগনাল
হয়ে
গেছে সর্বনাশী লাল
মুহূর্ত মিনিট ঘন্টা মাস যায়
লাল
দাগ কোনো দিন সবুজ হবে না
কোনো
দিন হবে না সবুজ
‘ পাবনার রঙিল শাড়ি ভয়ঙ্কর
মসৃন কোমল’
ব’লে গেলো
যে - ছাত্রী কী যেনো ওর নাম ?
পারসেনটেজে ওর কি দরকার
? ওর নামে প্রাণ পায়
আর্টস
ফ্যাকালটির ১৬০ জন শিক্ষক ৷
আমার
লেটারবক্স উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে
একটি
নীল খামের প্রত্যাশায়
৷ সব চিঠি ব্যাগে নিয়ে
পালিয়েছে সবুজ পিয়ন নীল নক্ষত্রের দিকে ৷
তার
সাইকেল
ডানা
মেলে উড়ে যাচ্ছে
ডাকবিভাগের সীমানা পেরিয়ে
সম্রাজ্ঞী তোমার ছাড়া কোন গান নেই স্বর্গে মাটিতে
তোমার
স্নানের পর বাথরুম
কী রকম সেন্টে
ভ’রে থাকে
তোমার
হাতের তালু থেকে আলো
আর
চন্দ্রের চন্দন ঝ’রে যায়
বিপর্যস্ত আকাশের
সুনীল শয্যায় ৷
( ৩ )
আমার
নামফলক আজো সাঁটা হয় নি দেয়ালে ৷
দেয়ালে
গাঁথতে চাই , জীর্ণ হয়ে ঝ’রে যায় সমগ্র দেয়াল ৷
এ
আমার নামফলক আঁধারে
ধাতুর জ্যাৎস্না
প্রাণধারণের হৃৎপিণ্ড
কোন
দেয়ালে গাঁথবো তোমাকে
?
রাজরোষ
দৈবরোষ সারাক্ষণ শাসাচ্ছে
তোমাকে
বারবার
ঘরবদল সত্ত্বেও তোমাকে
আজো রেখেছি অম্লান
তবু
তুমি নিরুপায় নির্বাসিত
থাকবে চিরদিন ৷
( ৪ )
বাঙলাদেশ
বদলে যাচ্ছে , ফোর্ট উইলিয়ম
কলেজ যে দিন
গদ্য
লিখলো সে দিন থেকেই
ঈশ্বর
গুপ্তের মৃত্যু ক’রে দিচ্ছে মধুসূদনের
জন্মসংবাদ রটনা
রবীন্দ্রনাম ১০০,০০০
বার নিলেন
বাঙলাদেশ বদলে যাচ্ছে
ঋতুবদলের
সব চিহ্ন ঝুলে আছে
গাছে
গাছে মেয়েদের ধাতব শরীরে
আমার
প্রৌঢ়া মা ভোর না হতেই চ’লে যান টেলিফোন একচেঞ্জে
কনিষ্ঠা বোন সেই ভোরে লিপিস্টিক রুজ মেখে
বের
হয় ফিরে আসে মধ্যরাতে, ফিরে আসে কিনা তাও
জানি না ৷
আজো
বাঙলার যে -সব মেঠোপথ
বাকি আছে
সেই
সবে আরো পাঁচটা
পাঁচসালা পরিকল্পনার পর
ট্রেন
যাবে হুইশাল কাঁপিয়ে
কিষাণের ঘর উঠে যাবে ,
উঠবে হোটেল
প্রতিদিন নতুন স্লিপ নিয়ে ঢুকবে কিষাণ
,
পরস্পরের প্রতি আমাদের আর কোনো আবেদন নেই
মেয়েদের যৌনবেদন
ছাড়া আর কোনো আবেদন নেই
তাহলে ফসল ফলবে কার জন্যে বলো ?
জনতা ও জান্টা
জনতার
আছে প্রতিবাদভরা মুঠো
রক্তনালিভরা রক্ত
দরকার হ’লে
সে করবেই প্রতিবাদ
তুলবেই মুষ্টি আকাশে
দরকার হ’লে
সে দেবেই রক্ত
ভিজিয়ে দেবেই
শুকনো মাটিকে
জান্টার
রয়েছে কামান রাইফেল
মর্টার
বিদেশে প্রস্তুত
দরকার হ’লে
দাগবেই কামান কাঁপবে
নিসর্গ
কামান মর্টারের
সে ব্যবহার জানে
তাই তার ব্যবহর করবেই
৷
জনতার মুঠো
ভরে প্রতিবাদে পোড়া
বুক থেকে
রক্তনালিতে রক্ত
আসে মাটি থেকে
কেবল আসেই
নিঃশেষ হয় না
জান্টার রাইফেল
সহজেই তেতে ওঠে
ব্যবহার উপযোগিতা
হারিয়ে ফেলে কামাম
মর্টার
দুদিনেই ফৌত হয় বুলেট
বারুদ গোলাগুলি ৷
তখন শূন্য
মুঠোর কাছে আত্নসমর্পণ
করে
চীন আমেরিকায়
তৈরি রাইফেল
নিরস্ত্র জনতার
হাতে
বন্দী হয় অস্ত্রভারাক্রান্ত জান্টার
নেতারা
তখন জনতা
সৈন্যাবাস ভেঙ্গে
দিয়ে
সহজে দেখায়
গৃহনির্মাণপ্রবণতা ৷
এ -সভা প্রস্তাব করেছে
এ
- সভা নিশ্চিত জানে বাঙলাদেশকে
কবি ছাড়া ভালোভাবে আর কেউ
জানে নাই
বাঙলার প্রতিটি
পাতা সব পথ সব নদী হৃৎপিণ্ড কবিরাই
ভালো পড়েছেন
এসভা প্রস্তাব
করছে বাঙলার রাষ্ট্রপতি
অর্থমন্ত্রী চিরকাল হবেন
কবিরা
এ
-সভা প্রস্তাব করেছে
কবিরাই হবে বাঙলার
কারেন্সি
এ
-সভা প্রস্তাব করছে বাঙলার শাসনতন্ত্র
রচনা করবেন কবিরা
কেননা কবিরাই
বাঙলার একমাত্র অবিনশ্বর
তন্ত্র
কবিতা ছাড়া
বাঙলাদেশ আর কোনো
তন্ত্রমন্ত্র জানে না
এ
- সভা আনন্দিত মুজিবর
ঘন ঘন রবীন্দ্রনাথ
উদ্ধৃত করেন
এ
-সভা প্রস্তাব করছে বিপন্ন
রবীন্দ্রনাথকে যারা রক্তমাংসে
বাঁচিয়েছে
তিনি যেনো মাঝে মাঝে সেই সব কবিদেরও উদ্ধৃত
করেন
এ
-সভা প্রস্তাব করছে বাঙলার বাঙলার
গণপরিষদ যেনো কবিতাপাঠের দ্বারা যাত্রা শুরু করে , কেননা
কবিতাই বাঙলার একমাত্র
অবিনশ্বর বাহন
এই
কবিতার বইয়ের শেষ কবিতাটির নাম হুমায়ুন আজাদ .
এ কবিতায়
কবি তাঁর জন্ম থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত
তাঁর জীবন এবং তখনকার সামাজিক
ও রাজনীতিক বিভিন্ন
ঘটনার সঙ্গে সামন্জস্য
রেখে সেই সময়ের অবস্থা বর্ণনা
করেছেন এই কবিতায়
৷
হুমায়ুন আজাদ
আব্বার খোলার ধান মায়ের কোলেতে আমি একই দিনে
একই সঙ্গে এসেছিলাম ৷ আড়িয়ল বিল থেকে সোনার গুঁড়োর মতো
বোরোধান এলো
, ঘোড়ার পিঠের থেকে ছালার ভেতর থেকে
গড়িয়ে পড়লো লেপানো উঠোনে , তখনি
আতুর ঘরের থেকে দাদি চিৎকার
ক’রে উঠলেন , ‘ রাশু রাশু , তোর
ঘরে এইবার সোনার চানই আইছে ‘
কিছু দিন পর
বাড়ির উত্তর ধারে আকাশ ফেড়ে ওঠা কদম গাছটার
উচ্চতর ডালে
একটি চানতারা
আঁকা নিশান উড়িয়ে আমার আব্বা ব’লে উঠলেন , ‘ এতো দিনে
স্বাধীন হইলাম ৷’ মায়ের বাহুতে আমি গাছের মাথায় চানতারা
আব্বার গলায় মেঘের মতোন শব্দ
- ‘ পাকিস্থান জিন্দাবাদ
’ ৷
আব্বা
, লাল তাজা রক্তের
মতোই কোলাহলময় ৷ তাঁর প্রেমে
ধান
জমি গৃহ স্ত্রী দেশ একাকার ৷ আঠারো বছর বয়সে আব্বা যে
ত্রয়োদশী কিশোরীর
প্রেমে পাগল হয়ে ইস্কুল ছাড়লেন
,
সে কিশোরী
আমার জনজী ৷ আব্বা
, আরো
এক প্রেমে , কিশোরীর
প্রেমের মতোই তীব্র প্রেমে
‘ লড়কে লেংগে ’ ব’লে
পাড়া গ্রাম থানা মাতাতেন
৷
জিন্নাকে দেখেন নি কোনো দিন
, জিন্নার জবান বোঝেন নি কখনো
তবু বুঝেছিলেন
দেশ চাই , কিশোরীর দেহের মতোন একান্ত
স্বদেশ ৷
যে
- কিশোরী আমার জননী তার অভাবে আঠারো বছর বয়সে
আব্বা হাসিমুখে
বিষ ঢেলে দিতে পারতেন গলায় ,
পারতেন প্রতিদ্বন্ধীর মাথা
ভেঙ্গে দিতে ,
তেমনি পারতেন
তাঁর সাধের দেশের জন্যে বুকে নিতে ছুরির আঘাত ৷
আব্বা , যিনি কোনো দিন রাড়িখাল
ছেড়ে উনিশ মাইল
দূরে ঢাকায় আসেন নি ৷ ঢাকা
এসে কী লাভ , রাড়িখালই সব ৷
আমি পাকিস্থানের
সমান বয়সী ৷ স্বাধীনতার আমার কোনো
দরকার ছিলো না ১৯৫৭ পর্যন্ত ৷ ১৯৫৮-তে যখন সপ্তম শ্রেণীতে
পড়ি ,
হাফপ্যান্ট ছাড়াছাড়ি
করি , হঠাৎ একলা দুপুরে আমার স্বাধীনতার
দরকার হয় ৷
চিৎকার
করে বলি , স্বাধীনতা চাই ৷ ঘাটে মাঠে সারা বঙ্গে খুঁজে দেখি স্বাধীনতা নাই ৷
একরত্তি বাচ্চা
আমি মায়ের স্তনের
ফাঁকে নিশ্চিন্তে ঘুমোই
ঘুম ভাঙ্গে
হামাগুড়ি দিয়ে , হাত রাখি আব্বার
পকেটে , তাঁর কান টানি
দুলি মায়ের দীর্ঘ চুলের দোলনায়
, ঘুম
ভাঙলে জেগে দেখি
আমি হুমায়ুন
, বয়স সাড়ে পাঁছ
/ ছয় ৷
পুকুরে ভাসছে হাঁস শাপলার
থরোথরো ফুলের মতোই
আমার ইজার ভরে কাটাতণে
, প্রতিদিন
শরীরের কোনো অংশ না কাটলে ঘুমোতে
দেরি হয়ে যায়
কোন দিকে বয় নদী খরাক্রান্ত নির্জল
বাঙলায় ?
তারা কই
? বাল্যকালের আমার সাথীরা কই ?
এক দুপুরে
ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বিবির পুকুর পারে
জল দেখে লোভে পড়ি
, বইশ্লেট রেখে শার্ট ইজার খুলে নেমে যাই জলে
আমার ক্লাশের
সাথী রাজিয়া , যে আমার ইজার হরণ ক’রে খলখল
ক’রে দৌড়ে পালিয়েছিলো , আমি জল থেকে উঠতে পারি নি ;
সে কই ? কে আজ তার বস্ত্র
হরণ করে মাঝরাতে
, বৃষ্টির দুপুরে
?
শেফলিরা দেশ ছেড়ে গেলো ৷
শেফালি অন্নদা
স্যারের মেয়ে শেফালি
নীলাদির ছোটো বোন
শেফালি যার সঙ্গে আমি কমপক্ষে এক হাজার দিন ন্যাংটো নেয়েছি
শেফালি যে আমার সমবয়সী
শেফালি যে ফ্রক ইজার পরতো
শেফালি যার তখন বুক উঠছে
শেফালি আমি যার পেয়ারার
মতো বুক উঠতে দেখেছি
সেই শেফালিরা
চ’লে গেলো ৷
মুসলিম লিগের রহমত খাঁ , যার মাথায় জিন্না
টুপি জিন্নার মতোই
শোভা পেতো ,
তার সাথে শেফালকে
সাতটি রাত কাটাতে
হয়েছে ৷
ফয়জনরা এলো রাড়িখাল
, তারা আসাম না ত্রিপুরায় থাকতো ৷
আসার কয়েক মাস পর ফজু যার বিয়েই হয় নি
বাচ্চা বিয়োতে
গিয়ে মারা গেলো ৷
বাচ্চাটি হয়তো কোনো দেশপ্রেমিক
কংগ্রেস নেতার ৷
শেফালি কি বেঁচে আছে ?
চারপাশে ডানে বাঁয়ে ভাঙছেই
কেবল ৷
আমার বাল্যকালে
আমি কিছু গড়তে দেখি নি
না সড়ক না ব্রিজ না কুঠির না ইস্কুল
চারদিকে
ভাঙছেই
কেবল
মাত্র একটি গড়া আমার বাল্যকাল দেখতে পেয়েছে
সে
-স্মৃতি রক্তের দাগের মতো লেগে আছে আমার ভেতরে
জেলাবোর্ডের ভঙা সড়ক দিয়ে প্রচণ্ড স্রোত গেলো মানুষের
ছোট্ট আমি বুঝতে পারি নি কেনো মানুষের এমন প্রচণ্ড নদী
এমন লেলিহান
আগুন হয়ে ওঠে
সেই আমার জীবনের আদি স্রোত জীবনের
প্রথম আগুন
তারা রাষ্ট্রভাষা
বাঙলা চেয়ে ভাঙা সড়ক দিয়ে কোন দিকে গেলো ?
আমি তা বুঝতে পারি নি
৷ আজ
বুঝি তারা গিয়েছিলো
আমারই
ভবিষ্যতের দিকে ৷
আমার বাল্যকাল
রাজিয়া কায়সর বিল্লাল
হারুন
আমর বল্যকাল
জোনাকির গুচ্ছ মাছ লম্বা ইস্কুল
আমার বাল্যকাল
স্তব্ধ নদীর তীর নৌকা কাদা বালি
আমার বাল্যকাল
দুঃস্বপ্নের গর্ভে ফোটা ভয়ঙ্কর ফুল
বাঙলাদেশ বিবর্ণ
হচ্ছে সাথে সাথে আমিও ধূসর
আদর্শলিপির পৃষ্ঠার
মতোন ফ্যাকাশে
আব্বার খোলায় ঘোড়ার আনাগোনা
ক’মে গেছে
মায়ের বহুতে সেই শিহরণ নেই
আব্বার চোখ আগে ভিটার শব্জির মতোই সবুজ ছিলো
সেখানে নামলো ধূসরতা বুকে পোড়া ঘাস
মায়ের বুকের মধ্যে কনিষ্ঠ
পুত্রের লাশ
এর মাঝে পাকিস্তান ম’রে গেছে পোকারা
কেটেছে পতাকা
টিনের বাস্কের
মধ্যে
দুর্দান্ত বাঘের পিঠে চেপে আমি ইস্কুল
ছেড়ে কলেজে এলাম
চারদিকে মত্ত হাওয়া কালাকানুন
রক্ত ১৪৪ ধারা
সামনে সুদীর্ঘ
রাত্রী দীর্ঘ পরাবার
রক্তের লাল রঙ বুলেটের
থেকে বেশি ধার
এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৷ অনেক বাগান
জ্ব’লে গেছে ৷ চলে গেছে অনেক বাউল ৷
বাতিস্তম্ভ থেকে খ’লে গেছে আলো ৷
চারদিকে অন্ধকার ,
সারাদেশ ঘুমহীন স্তব্ধ
নিঃশ্চুপ .
রক্ত খাচ্ছে
দশ দিকে এনএসএফ
মোনেম আইউব ৷
বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন - ভগ্নস্বপ্ন পুনর্নির্মাণ
বিশ্ববিদ্যালয় আশ্চর্য
দুরূহ আলোক
বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি
অপার্থিব অমিতাভ গান
রাজনীতি
, বুকের বন্ধুরা গেলো কারাগারে
শ্লোগান
, রক্তের বিনিময়ে ফিরিয়ে
আনবো তাদের
কবিতা
, প্রদীপের মতো জ্বলে সবুজ হীরক
এলো প্রেম প্রেম এলো
দূর দেশ থেকে এলো অনিন্দ্য চন্দন
বন্ধুরা সবাই অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত
ঠোঁট দিলো ঠাণ্ডা প্রেমে
৷
ডালপালা থেকে কিছু ফুল এলো নেমে
বুকে ও বুকপকেটে ৷ কেউ কেউ প্রেমের কামড় ভুলতে দল বেঁধে
গেলো পতিতাপল্লীতে
, ফিরে এলো তৃপ্ত হয়ে ৷ রফিক শরমিন
কোর্টে গিয়ে ছাপ মেরে পাকা ক’রে নিয়ে এলো
অবিনশ্বর প্রেম গৃহনির্মাণের
প্রতিশ্রুতি ৷ তাও টিকলো না
আমার নিকট এলো প্রেম হাতে নিয়ে শোক কষ্ট অবিশ্বাস
দীর্ঘশ্বাস অনিদ্র
নিশীত ৷ আমি প্রেমে আর কামে জ্ব’লে
জ্ব’লে নিজের রক্তের দুধে প্রস্তুত ক’রে চললাম
আশ্চর্য গরল ৷
কিন্তু প্রেম ,
আজো স্বীকার করি
, আমার নিকট বড়োবেশি ছিলো ৷
বিশ্বাস
, কবিতা
পড়তে ভলো লাগা
, ছন্দ মেলানো ,
প্রথম শ্রেণীতে
প্রথম স্থান পাওয়া
তার চেয়ে বড়ো বেশি ছিলো প্রেম
, বড়োবেশি ছিলে তুমি ,
আমার বিষাক্ত
প্রেম , ব্যর্থ
ভালোবাসা ৷
আজো কি তা আছে অধ্যাপক হুমায়ুন
আজাদ ?
চশমার কাচ ভারি হচ্ছে দিন দিন
সুপ পোচ মাংস যদিও খাচ্ছি তবুও আমি শুকিয়ে
যাচ্ছি
এবং শুকোচ্ছে
বহু কিছু ৷
শুকাচ্ছে জলের নদী , কবিতা থেকে দূরে যাচ্ছি
, মানুষের থেকেও
উদ্যমপরায়ণ ছাত্রীও
আর জাগয় না উল্লাস
রবীন্দ্ররচনাবলি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি
মনে পড়ে
আজ ফেরিঅলার
ডাক শুনলেই বেচে দিতে ইচ্ছে হয়
ঘুমোতে দেরি হয় উঠতে দেরি হয়
ক্লাশে যেতে দেরি হয় বাসায় ফিরতে দেরি হয়
ক্লাবে য়েতে দেরি হয় বাসায় ফিরতে দেরি হয়
এলো ২৫ মার্চ ১৯৭১
যে
-কোনো কারণে মারা যেতে পারতাম
৷ আমি বাঙালি
,
বাঙলা পড়াই
, ভাত খাই
, প্রেমে পড়ি
, ব্যর্থ হই , রাত্রে ঘুমাতে
দেরি হয় , আমি মানুষ
, এর যে -কোনো
একটির জন্যে রাষ্ট্রদ্রোহী
বিবেচনায় আমাকে নিয়ে যেতে পারতো ওরা বধ্যভূমিতে ৷
বেঁচেছিলাম একটি আলোর জন্যে যা এসে পৌঁছলো ষোলোই ড়িসেম্বর ৷
‘
জয় বাঙলা’ , চিৎকার
করে উঠি , ‘ এত দিনে স্বাধীন
হলাম ’ ৷
আমার সন্তান
আজো জন্মে নি ৷ যদি জন্মে
সে কি জন্মেই পাবে স্বাধীনতা ? আমার বাবার স্বাধীনতা
ব্যর্থ হয়েছিলো
আমার জীবনে ৷
আমার স্বাধীনতা
কী রকম হবে আমার সন্তানের
জীবনে ?
নাকি
তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনোদিন
‘ এতো দিনে স্বাধীন
হলাম ’ ৷
আমার সন্তান
কি চাইবে জানিনা
৷ পরবর্তীরা সর্বদাই
অধিক সাহসী ,
তাদের চাহিদা অধিক ৷ আমি চাই আমার আলোক
সত্য হোক তার মধ্যে
আমি
শুধু চাইতে পারি তার মধ্যে সত্য হোক আমার জ্যোৎস্না
৷
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন