আধুনিক প্রযুক্তি ও যুক্তিবাদী বিশ্বে ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানিদের দৃষ্টিতে
মৌলবাদের আবির্ভাবের কারণ এবং বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য ৷
(প্রথম পর্ব )
বর্তমান বিশ্বের এই সময়টি তে আধুনিক প্রযুক্তি ও যুক্তিবাদের প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ধর্মীয় ও সমাজ ব্যবস্থায় কম বেশি সেক্যুলার হওয়ার কথা ৷ কিন্ত শুধু ইসলামই নয় , বিশ্বের অন্যান্য প্রধান সব ধর্মের ক্ষেত্রেই এখন মৌলবাদী শক্তি প্রবল হয়ে উঠেছে ৷ এর কারণ বিশ্লেষণে , ইতিহাস , সমাজবিজ্ঞান এর সঙ্গে আধ্যাত্মিকতাকে মিশিয়ে যারা মানবজাতির বর্তমান এই সময়ের অবস্থার কারণ বিচার বিশ্লেষণ করেছেন , তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ গবেষক - লেখক ক্যারেন আর্মস্ট্রং ৷ তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে , মৌলবাদের আবির্ভাবের যে কারণ বের করেছেন , তা হচ্ছে - তাঁর কথায় , মৌলবাদ , ধর্মের প্রাচীন ধরণের পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের আধ্যাত্মিক টানাপোড়োনের প্রতি এক ধরণের সাড়া দেয়ার বিশেষ প্রবনতা , আর এই দুইয়ের সমন্নয়েই ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টির কারণ বলে ক্যারেন আর্মস্ট্রং ৷ তাঁর বিশেষ গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে তিনি ইহা মনে করেন , আর যারা এসব বিষয় নিয়ে চর্চা করেন তাঁরাও এই মতামতে সাথে একমত পোষণ করতে দেখা যায় ৷ তাঁরা আরোও মনে করেন যে , মানবসমাজের আলোকনপর্ব এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের পূর্বের কালের প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় কিংবদন্তী ও মানুষের বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মানুরাগের বিশেষ অনুভূতি ও পূর্বের বিশ্বাসে ফাটল ধরার পর , নতুন ভাবে মানুষ আবার এক ধার্মিকতার নতুন উপায় সন্ধানে বাধ্য হয়েছে ৷
যার ফলে বিশ্বজুড়ে এই সময়ে সব মানব সমাজেই মৌলবাদের আবির্ভাব হয়েছে আবার নতুন ভাবে ৷ শুধু তাই নয় , বর্তমান মৌলবাদ , আধুনিকতার আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে তাদের প্রতিটি আন্দোলনকে বিভিন্ন দেশে , আন্দোলনের এক নিজস্ব কৌশল ও গড়ে তুলতে পেরেছে ৷ আর তাদের ধর্মীয় অভিব্যক্তি প্রকাশের একটি চরম ও আকর্ষনীয় রূপ ও তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ৷ যে অভিব্যক্তটি বর্তমান বিশ্বের ইতিহাসের গতি পর্যন্ত মন্তর করে দিচ্ছে , বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন সমাজে ৷ ফলে মৌলবাদীরা এখন ধর্মের এক সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিব্যক্তি ও ধর্মের আধুনিকায়নের নতুন একটি ধারণাকে ও প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ৷
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ আমেরিকার ৯/১১ পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মকে নির্বিচারে মৌলবাদ আখ্যা দিয়ে খোদ ধর্মের বিরুদ্ধে সকল শক্তি প্রয়োগের একটি প্রবণতা গোটা বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ৷ তবে একেশ্বরবাদী ও সেমিটিক ধর্মগুলোর তিনটিতেই মৌলবাদের প্রবল উপস্থিতি থাকলেও বিশ্ব-মিডিয়ার একপেশে প্রচারণার ফলে বর্তমানে কেবল ইসলাম ধর্মই মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷ আর যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে ইসলামী সন্ত্রাসবাদই দায়ী ৷ অন্যদিকে , ধার্মিকতা , ধর্মান্ধতা , সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য ও রাখা হচ্ছে না , বিশ্ব প্রচার-মাধ্যমে ৷ তাই বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গটি একটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ৷
মৌলবাদ কোনোভাবেই নতুন ঘটনা নয় বা কেবল ইসলামই মৌলবাদী নয় ৷ বিগত প্রায় কয়েকশো বছর ধরে , আধুনিকায়নের সূচনাকাল হতে , বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের আবির্ভাবে , ধর্মের প্রতিনিধিরা , ধর্মের অস্তিত্ব বিনাশের আশঙ্কায় , এবং ধর্মকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম থেকেই জন্ম হয়েছিল মৌলবাদের ৷ পৃথিবীর সকল দেশের এবং সকল ধর্মের মানুষই , অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষ , ধর্মের অখণ্ডতা রক্ষার নামে আধুনিকতার সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে ৷ আবার যুগে যুগে রাষ্ট্রও উপর হতে আধুনিকতা চাপিয়ে দিতে গিয়ে প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করেছে ধর্মকে , রাষ্ট্রই ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পশ্চাদপদতার সমার্থক বিচার করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে ৷ একথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্য , মধ্যপ্রাচ্য , ব্যতিক্রম নেই কোথা ও ৷ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রাষ্ট্রই যেন মৌলবাদকে আধুনিক মানুষের জন্যে অপরিহার্য সঙ্গী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করছে ৷
তাই শক্তি প্রয়োগে মৌলবাদকে প্রতিহত বা নির্মূল করার চেষ্টা না করে , প্রযোজন একে সংশোধন করা ৷ এর জন্য মৌলবাদের চেহারা , তার আদিরূপ বা ইতিহাসটুকু সন্ধান করা জরুরি ৷ অর্থাৎ ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে মৌলবাদের উৎপত্তি হতে শুরু করে পর্যায়ক্রমে এর বিকাশ জানতে পারলে ধর্মের এই অসুস্থ অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশোধন প্রয়াস সহজতর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন ৷
এখন এটা বিশ্বাস করা হয় যে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের আমেরিকার ঘটনাটি বিশ্বকে চিরতরে পাল্টে দেয়ার দিন হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে ৷ পরবর্তিত এই বিশ্বে কিছুই আর আগের মতো থাকছে না ৷ আমরা ভীতিকর অস্বস্তিকর এক পরিবর্তনের মুখে বর্তমানে অবস্থান করছি ৷
প্রায় শতবছর ধরে ক্রিশ্চান , ইহুদি ও মুসলিমরা এক উগ্র ধরনের ধার্মিকতা গড়ে তুলে , সেক্যুলার ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ; এবং এরই মধ্যে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জনেও সক্ষম হয়েছে ৷
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সাময়ে সমাজবিজ্ঞানিগণ ধরে নিয়েছিলেন যে সেক্যুলারিজমই বিশ্বে আগামীর আদর্শে পরিণত হবে , এবং ধর্ম আর কখনোই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না ৷ কিন্তু মৌলবাদ এই প্রবণতাকে উল্টে দিয়ে , ক্রমশঃ যুক্তরাষ্ট্র সহ মুসলিম বিশ্বে ধর্মকে এমন এক শক্তিতে পরিণত করতে পেরেছে , যাকে এখন প্রতিটি সরকার গুরুত্বের সাথে নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে ৷ পণ্ডিতদের মতে এটা শুধু সভ্যতার সংঘাত নয় , তাঁরা মৌলবাদ কে সব সময়ই আন্তর্সমাজ বিরোধ হিসাবে আখ্যায়িত করতে চান ৷ তাই তাদের মতে মৌলবাদ সহসা বিদায় নিচ্ছে না ৷ মৌলবাদের ইতিহাস বলে উগ্র ধার্মিকতাকে অগ্রাহ্য করলেই তা মিলিয়ে যায় না , মৌলবাদকে দমন করার প্রয়াস স্রেফ তাকে আরো চরম রূপ দেয় ৷ কারণ মৌলবাদ আধুনিক দৃশ্যপটেরই অংশ , এবং মৌলবাদ এমন এক বাস্তবতা যার মোকাবিলার টেকনিক আমাদের এখন আয়ত্ত করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই , কারণ উগ্রধার্মিকতাকে শক্তি দিয়ে প্রতিহত করলে বা অন্য কোনোভাবে অগ্রাহ্য করলে , বা দমনের চেষ্টা করলে ইহা আরো চরম রূপ নিয়ে ধ্বংসাত্মক প্রবনতার দিকে অগ্রসর হয় ৷ সেমিটিক ধর্ম বিশ্বাসের সবকটাতেই মৌলবাদীরা এখন সেক্যুলারিজমকে ধ্বংস ও নিশ্চহ্ন করণের কল্পনা লালন করছে ৷ আর যদি তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের মৌলবাদীরা আরো রেডিক্যাল ও ধ্বংসাত্মক বিশ্বাস নিয়ে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে , তবে সেটা সত্যই এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে ৷ তাই এই মৌলবাদের পিছনে কী লুকিয়ে আছে , আর কোন জিনিসটা মৌলবাদীদের এসব কর্মকাণ্ডে বাধ্য করে , সেটাকে প্রয়োজনীয় গবেষণার মাধ্যমে বের করে , এই ভীতিকর সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে যা কিছু করার দরকার তা করার প্রয়াস নিতে হবে এখনই ৷
( মৌলবাদের আবির্ভাব - এর দ্বিতীয় পর্ব )
বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে প্রতিটি প্রধান ধর্মের অন্যতম চমকপ্রদ পরিবর্তন ছিলো , ধার্মিকতার এক নতুন ধরনের উগ্র প্রকাশ , যাহা বর্তমানে “ মৌলবাদ” নামে পরিচিতি লাভ করেছে ৷ তাই মৌলবাদ কেবল মহান একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেই আর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি , বুদ্ধধর্মে , হিন্দুধর্মে এমনকি কনফুশীয়মতবাদে ও মৌলবাদ বর্তমানে বিকাশ লাভ করেছে ৷ শুধু ইসলাম ধর্মই নয় , ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা ও প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে জীববিজ্ঞান ও পদার্থ বিদ্যার বিভিন্ন আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোই সব দিক দিয়েই আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভূল ৷
বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টরা ধরে নিয়েছিলেন যে , সেক্যুলারিজম অপরিবর্তনযোগ্য , এর সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রবনতা আর রোধ হবে না ৷ যেহেতু মানবজাতি দিন দিন যৌক্তিক হয়ে উঠবে , তখন তাদের আর ধর্মের প্রয়োজন হবে না , বা তারা ধর্মকে জীবনের একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রেখেই সন্তুষ্ট থাকবে ৷ তাই ধর্মবিশ্বাস আর কোনোদিনই বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না ৷
কিন্তু ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে মৌলবাদীরা ক্রমশঃ সেক্যুলারিষ্ট আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধর্মকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে একেবারে মধ্য মঞ্চেলে আনতে সমর্থ হয় ৷ সুতরাং এই ধরনের ধার্মিকতার মানে কী , কীভাবে এবং কোন কারণে এর বিকাশ ঘটলো ! এবং কেমন করে এর মোকাবিলা করা যেতে পারে সেটা জানার বা বুঝার চেষ্টা করা এখন খুবই জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে , অন্ততঃ এসব ব্যাপার নিয়ে যারা চিন্তা ভাবনা , তারা মনে করেন ৷
আজ থেকে প্রায় ২৭০০ বছর আগে , এবং এর পরবর্তি প্রায় ৫০০ বছর ধরে প্রাচীন বিশ্বে একই ধরনের ক্রান্তিকাল গেছে বলে ইতিহাসবিদরা বলেন ৷ অর্থাৎ ৭০০ থেকে ২০০ বিসিই পর্যন্ত এই সময়টাকে ইতিহাসবিদগণ “ আক্সিয়াল” যুগ হিশেবে গণ্য করে থাকেন ৷ কারণ মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই যুগটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো ৷ বর্তমান ইরানের সুমের ও প্রাচীন মিশরে ,এর সূচনা ঘটেছিলো সেই সময়ে , কারণ সেখানকার অধিবাসীরা কৃষিতে উদ্বৃত ফসল উৎপাদনে সেই সময়েই সক্ষমতা অর্জন করে , এবং এর পরবর্তিতে নানাবিধ বানিজ্য পরিচালনা করে তারা আরো আয় বৃদ্ধি করে প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলে ৷ এই পর্যায়ে তারা শিল্পকলার বিকাশ ও ক্রমবর্ধমানহারে শক্তিশালী রাজনীতির বিকাশে ও সক্ষম হয়ে উঠে , যা তাদেরকে পরবর্তি পর্যায়ে নগর , নগর - রাষ্ট্র ও শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য ও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম করে তুলেছিলো ৷ এমন এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানকার অধিবাসীরা শেষতক আবিষ্কার করতে শুরু করে যে তাদের পূর্ব-পুরুষদের প্যাগন বা বিভিন্ন প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদ ও ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের বর্তমান পরবর্তিত অবস্থার সাথে আর অগেরমত খাপ খাচ্ছে না ৷
আক্সিয়াল যুগে সাধারণ জনগণ প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও সৃজনশীল চিন্তা করার মতো যোগ্যতার অধিকারী হয়ে উঠেছিলো ৷ ঈশ্বরকে তারা বহুদেবতার মাঝে সীমিত ভাববার বদলে একজন মাত্র বিশ্বজনীন দুর্জ্ঞেয় সত্তা ও পবিত্রতার উৎসের উপাসনা শুরু করেছিলো ৷ তখন সমাজের কিছু সংখ্যক লোক কৃষিভিত্তিক আর্থ - সামাজিক অবস্থার কারণে অস্বস্তিতে ভূগছিলো , কৃষকদের উপর নির্ভরশীল তখনকার সমাজব্যবস্থায় ঐ অস্বস্তিতে ভূগা লোকগণ তেমন কোনো আলাদা রকম সুবিধা চাইলেও পেত না ৷ অর্থাৎ সমাজের এই মধ্যসত্তভোগী বা কৃষিকর্মে সরাসরি যুক্ত নয় , অর্থাৎ উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি যুক্ত ছিলো না , এমন লোকজনদের আগ্রহেই তখনকার সমাজব্যবস্থায় পয়গম্বর ও সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে ৷ তারা তখন ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করতে থাকে তাদের নিজের স্বার্থেই এবং এক পর্যায়ে সক্ষমও হয়েছে তারা ৷
এইভাবে আক্সিয়াল যুগে মানবজাতিকে পথনির্দেশনা দিয়ে চলা মহান কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাস সমূহ সভ্য সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ৷ ভারতে বুদ্ধধর্মমত ও হিন্দুধর্ম ,দূরপ্রাচ্যে কনফুসিয় মতবাদ ও তাওবাদ ৷ এগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও আক্সিয়াল যুগের এইসব ধর্মের ভেতর আবার অনেক সাধারণ মিলও ছিলো ৷ এসব ধর্মবিশ্বাস তখন আধ্যাত্মিকতার চর্চার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সামাজিক সহানুভূতির প্রতি ও জোর দিয়েছে ৷
বর্তমান সময়ে অর্থাৎ আজকের দিনে আক্সিয়াল যুগের মতই একই ধরনের ক্রান্তিকাল চলছে ৷ যার শেকড় প্রোথিত হয়েছিলো ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ৷ যখন পশ্চিমা সমাজ বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের মানুষ ভিন্ন - ধরনের সমাজিক বিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছিলো ৷ তারা তখন আর কৃষি উদ্বৃত্তের উপর নির্ভরশীল না থেকে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে তাদের সম্পদকে সীমাহীনভাবে বাড়াতে সক্ষম হয় ৷ ফলে তাদের তখনকার সমাজে তারা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিবাদী ব্যবস্থা গড়ে তুলে ৷ যা তাদের আগের চারশত বছরের রীতিনীতিকে পেছনে ফেলে , তখনকার বিপুল সামাজিক , রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সাথে পাল্লা দিয়ে , অর্থনৈতিক পরিবর্তন সমূহকেও তারা একই সঙ্গে অগ্রসর করতে সক্ষম হয়েছিলো,এর ফলশ্রুতিতে আবার আরো একবার , প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিলো ৷ কারণ এই বদলে যাওয়া পরিবেশে প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাসের ধরন আর তেমন ভাবে কাজ করছিলো না ৷ ফলে নারী - পুরুষ আক্সিয়াল যুগের অতীত দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা বিশ্বাসের সঙ্গে তাদের সময়ের নিজদের পরবর্তিত বিশ্বাসের সঙ্গে সমন্নয় এর প্রয়াসের সঙ্গে যে আধুনিক পরীক্ষা - নিরীক্ষা আরম্ভ করে , যা অনেকটা পরস্পর বিরোধী ও ছিলো, আর তার ফলাফলকে কেন্দ্র করে সমাজে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে , তারই একধারাকে , সংশ্লিষ্টরা মৌলবাদ হিবে অবিহিত করেন ৷
মিথোস ও লোগাস প্রসঙ্গ
মিথোস - ক্যারেন আর্মষ্ট্রং একে সংজ্ঞায়িত করেছেন এ ভাবে যে - গ্রিক শব্দ মিথোস এর ' মিথ ' গ্রিক মাস্তেরিয়ন থেকে উদ্ভূত , ' মিস্ট্রি ' , বা ' মিস্টিসিজমের ' মতো শব্দঃ মুখ বা চোখ বন্ধ করা ৷ নীরবতা ও স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টিতে প্রোথিত জ্ঞানের এক ধরন যা জীবনের অর্থ যোগায় কিন্তু যোক্তিক পরিভাষায় বাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷ প্রাক আধুনিক বিশ্বে পৌরাণিক জ্ঞানকে লোগোসের সম্পূরক হিসাবে দেখা হত ৷
লোগোস - গ্রিক শব্দ , এর অর্থ বাণী , যাকে যৌক্তিক বা যুক্তিপূর্ণ বা বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্স হিশেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে ৷
মানব সমাজের বিশ্বাসের প্রাচীন ধারার সঙ্গে পরবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের যে নতুন ধারার বিকাশ লাভ করেছে , তাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সমাজ বিশ্লেষকরা মিথোস ও লোগাস এর প্রসঙ্গ এনেছেন ৷
ক্যারেন আর্মষ্ট্রং তার এইসব ব্যাপার নিয়ে লেখা গবেষণা গ্রন্থ “ Battle for God” এ উল্লেখ করেছেন যে , মানুষের চিন্তাধারা অনাদিকাল থেকেই বিকাশিত হয়েছে পরিষ্কার দুটি ধারায় ৷ এর একটি হচ্ছে ‘ মিথোস’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘ লোগাস’ ৷ মিথোস এসেছে ইংরেজী ‘ মিথ’ থেকে , এর প্রতিশব্দগুলো mystery এবং mysticism , যা প্রকাশ করে রহস্যময়তা , দুর্জ্ঞেয়তা এবং অতীন্দ্রিয়তাকে ৷ ক্যারেন আর্মষ্ট্রং - এর মতে মিথ হচ্ছে কতকগুলো রীতি - নীতি , অচার অনুষ্ঠান ও সংস্কার - যেগুলোর কোন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমান কখনও পাওয়া যায় না ৷ এগুলো মানব মনে জায়গা করে নিয়েছে স্রেফ কতকগুলো বিশ্বাসের কাঁধে ভর করে ৷ আর আর্মস্ট্রং গ্রিক শব্দ ‘লোগাসকে’ বর্ণনা করেছেন ‘ যুক্তি গ্রাহ্য’ ‘ প্রমানসাপেক্ষ’ ‘ বিজ্ঞানভিত্তিক’ শব্দ ক’টির সাহায্যে ৷ তিনি মনে করেন আধুনিক বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি , প্রগতি আর উন্নয়নের মূলে রয়েছে ‘ লাগোস’ - যা জ্ঞান ও যুক্তির মাপকাঠিতে প্রকৃত বাস্তবতার পরিচায়ক ৷
অতীতের মানুষ মোটামুটি আমাদের মত হলেও তাদের আধ্যাত্মিক জীবন বর্তমান থেকে অনেক ভিন্ন ছিলো ৷ পণ্ডিতেরা যার নাম দিয়েছেন (উপরে উল্লেখিত ) মিথোস ও লোগাস ৷ (সূত্র ;- জোহানেস স্লোয়েক - ডিভোশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ , ১৯৯৬ , পৃষ্টা -৫৩ ,-৯৬ )
মানবসমাজে তখন দুটোই ছিলো আবশ্যক , কারণ তখন সত্য অর্জনের ক্ষেত্রে দুটোকেই সম্পূরক মনে করা হত ৷ কারণ তখন মিথকেও মৌলিক বিষয় হিসেবে গণ্য করা হত এবং মিথ তখন জীবনের উৎস , সংস্কৃতির ভিত্তি ও মানব মনের গভীরতর স্তরে দৃষ্টি দিতে পারতো বলে বিশ্বাস করা হতো ৷ যদিও বাস্তব বিষয় - আশয়ের সাথে মিথের কোনো সম্পর্ক ছিলো না , সম্পর্ক ছিলো অর্থের সাথে ৷ এর পর ও মিথোস মানুষকে তখন হতাশা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পেতে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের একটা অর্থ মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারতো ৷ মিথোস মানুষের অবচেতন মনে প্রোথিত হয়ে পৌরাণিক কাহিনী গুলোকে মানুষের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর গভীর প্রভাবের সৃষ্টি করে মানুষের অবচেতন বলয়ের অস্পষ্ট এলাকাসমূহকে আলোয় তুলে নিয়ে আসতো , অর্থাৎ সমাজে মিথোস মানুষকে এমন এক প্রেক্ষিতের যোগান দেয় যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা আলাদা অর্থ তুলে ধরতো বলে মনে করা হয় ৷ বর্তমানে যাকে একবারেই যোক্তিক মনের অনুসন্ধানে বোধগম্য হয় না , আধুনিক চিন্তা চেতনা বিশিষ্ট মানুষর কাছে ৷ তবে তখন মানুষের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর এর যে একটা গভীর প্রভাব পড়েছিলো , তা কোনো ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই ৷
(সূত্র;- মির্চা এলিয়ান , প্যাটার্নস ইন কম্প্যারেটিভ রিলিজিয়ন , ১৯৫৮, পৃষ্টা- ৪৫৩-৫৫ )
তাই বর্তমান আধুনিক সমাজে মিথ- এর মৃত্যুর ফলে মানুষের অন্তস্থঃ জগতের মোকাবিলা করতে সাইকোএনালিসিসের বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করতে হয়েছে , কারণ যৌক্তিক প্রমান দিয়ে মিথকে এখন আর তুলে ধরা সম্ভব হয় না ৷ মিথ ও কাল্ট পরস্পরের সাথে আবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং মিথ আবার অতীন্দ্রিয়বাদের সাথেও সম্পর্কিত ছিল : কল্ট বা মরমী চর্চা ছাড়া ধর্মের মিথসমূহ বিমূর্ত রয়ে যায় ও অবিশ্বাস ঠেকে , তাই তাকে বুঝতে হলে এক বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে ৷
(সূত্র;-জোহানেস স্লোয়েক, ডিভোশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ , প্রকাশ ১৯৯৬ , পৃষ্টা ৭৫-৭৬ )
প্রাক - আধুনিক বিশ্বে ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো ৷ তখন তারা আসলে কী ঘটনা ঘটেছিলো তা জানতে তেমন আগ্রহী ছিলো না , এখনকার মানুষের মতো ৷ তারা তখন ঘটে য়াওয়া ঘটনার নিগূঢ় অর্থ জানতে বেশি আগ্রহী ছিলো , ঘটনা সত্য না মিথ্যা , তা জানতে তাদের কোনো আগ্রহ থাকতো না ৷ তাই ঐসব ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহকে তারা এক অটল , সময়হীন , বাস্তবতার প্রকাশ বলে মনে করতো ৷ কারণ ঐতিহাসিক ঘটনাকে মিথে পরিণত করে একে অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী কাল্টে রূপান্তরিত না করতে পারলে তা তখন ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিনত হতো না ৷ আর ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিনত হয়ে গেলেই , তা সত্য ঘটনায় রূপান্তরিত হতে আর বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো না ৷ আর এভাবে তখন সমাজে এক অন্ধ বিশ্বসের প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেত ৷
পরবর্তি সময়ে প্রযুক্তির আবির্ভাবে লোগোস ও ক্রমান্নয়ে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ৷ লোগোস হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে এবং যার যার ক্ষেত্রে কর্মক্ষম করে তোলার যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাভাবনা ৷ মিথোস এর বোধ এখন পশ্চিমে প্রায় হারিয়ে গেছে , তার পরিবর্তে এখন পশ্চিমের সমাজ লোগোস এর সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত হয়ে উঠছে , আর এটাই এখন বর্তমান পশ্চিমের সমাজের মূল ভিত্তি হিশেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ৷ তাই বর্তমানে পশ্চিমা সমাজে কোনো যৌক্তিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা ছাড়া কোনো বিষয়ের সমাপ্তি টানা সম্ভব হয় না ৷ লোগোস বর্তমানে বাস্তবভিত্তিক , তাই এর সূচনা ভিত্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকারী মিথের বিপরিতে লোগোস দৃঢ়তার সাথে সামনে অগ্রসর হয়ে , প্রাচীন দর্শনকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে নতুন এক আবিস্কারের চেষ্টা করে , পরিবেশের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে ৷ এবং আমকোরা আরো কিছু আবিস্কার করে ও এর সঙ্গে নতুন আরো কিছু উদ্ভাবণ করে , পশ্চিমা সমাজে লোগোস তার উপযোগীতা প্রমাণ করেছে ৷
তবে প্রাক - আধুনিক বিশ্বে একসময়ে মিথোস ও লোগোস উভয়ই সমাজে অপরিহার্য ছিলো , অর্থাৎ একটা ছাড়া অপরটা অচল হয়ে পড়তো , যদিও তাদের কাজ তখনও ভিন্ন ভিন্ন ছিলো , এবং একে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলাকেও বিপজ্জনক বলে মনে করা হতো ৷
কিন্তু লোগোস এর নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিলো ৷ লোগোস মানব জীবনের পরম মূল্য সম্পর্কে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা বা তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের চাহিদামত উত্তর যোগাতে সমর্থ হতো না ৷ তাই জীবনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে মিথ আর কাল্টের প্রয়োজন হতো ৷ অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর সাফল্যের পর পশ্চিমে মিথোস কে মিথ্যা ও কুসংস্কার বলে নাকচ করে দিয়ে ,লোগোস কেই সত্য জানার একমাত্র উপায় হিশেবে গ্রহন করা আরম্ভ হয়ে যায় ৷
তখন তারা ধর্ম বিশ্বাসের মিথোস কে প্রায়শ:ই লোগোস এ পরিনত করার প্রয়াস পেয়েছে আর মৌলবাদীরাও একই প্রয়াস পেয়েছে ৷ যা বর্তমানে ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি করে সমস্যার সৃষ্টি করেছে ৷ কারণ মৌলবাদীরা মনে করে তারা তাদের পবিত্রতম মূল্যবোধ ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্রান্তকারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে ৷ মৌলবাদীদের ধারনা , আধুনিকায়নে তাদের কোনো মুক্তি অর্জিত হচ্ছে না , বরং তারা বিশ্বাস করে , ইহা তাদের পবিত্রতম বিশ্বাসের উপর একধরনের আক্রমাণাত্বক হামলা । যাহা থেকে তাদের বিশ্বাস ও আদর্শকে রক্ষা করতে তাদেরকে অবশ্যই নতুনভাবে এবং নতুন টেকনিকে যুদ্ধে অবতির্ণ হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই ৷
মৌলবাদের আবির্ভাব-শেষ পর্ব :
নিকট ভবিষ্যৎ এ মৌলবাদ আর বিদায় নিচ্ছে না ৷ কারণ বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সবস্থানেই মৌলবাদ ক্রমেই কমবেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং দিনে দিনে আরো চরম রূপ ধারন করছে ৷
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক সমাজব্যবস্থা বর্তমানে “ দুইটি জাতিতে” বিভক্ত হয়ে পড়েছে : সেক্যুলারিষ্ট গোষ্টি ও ধার্মিক গোষ্টি ৷ তারা একই দেশে বসবাস করেও একে অন্য কে বুঝতে চাচ্ছে না বা একই দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করতে পারছে না একত্রে বসে ৷ এক পক্ষের কাছে যে ঘটনা বা যাকে তারা পবিত্র বা ইতিবাচক মনে করছে , অন্য পক্ষ তাকে দানবীয় এবং পরিহাসের বিষয় হিশেবে দেখছে ৷ তাই সেক্যুলারিষ্ট ও মৌলবাদী ধার্মিকরা দুই পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ৷ ফলে দুই পক্ষই পরস্পরের বিপরিত অবস্থানের কারণে নিজদের গভীরভাবে হুমকির মুখে আছে বলে মনে করছে ৷
প্রাক-আধুনিক রক্ষণশীল সমাজের মতো এখন অধিকাংশ মানুষই তাদের পূর্বপুরুষের ন্যায় ধার্মিক হওয়া আর সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে পশ্চিমাদের পক্ষে , বলে তারা মনে করছে এখন ৷তখনকার সমাজে ধর্মবিশ্বাসের মিথ ও আচার , প্রাচীন মানুষকে তাদের সময়ের কৃষি ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক সভ্যতার সীমাবদ্ধতায় , তা মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো ৷
বর্তমানে পশ্চিমরা ছাড়াও বিশ্বের আলোকিত অনেক মানুষই এখন ভবিষ্যৎ মুখী হয়ে উঠেছে ৷ তাই যারা আধুনিক বিশ্বের যুক্তিবাদের আলোকে বিশ্বাসী হয়ে গেছে , তাদের পক্ষে আর প্রাচীন ধরনের আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয় ৷ অর্থাৎ যুক্তিকে যারা সত্য প্রকাশ করার একমাত্র পথ হিশেবে দেখে , তাদের পক্ষে এটাই নৈতিক ও সৎ অবস্থান বলে বিবেচিত হয়ে যায় ৷ তখন মিথলজি উপলব্ধি তাদের কাছে অসম্ভব বলে হয় ৷ কারণ ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্বের সাথে নিতে হলে অবশ্যই এর মিথসমূহকে ও ঐতিহাসিকভাবে তাদের কাছে প্রমাণযোগ্য হতে হবে এবং আধুনিকতার প্রত্যাশা অনুযায়ী তাকে বাস্তব ক্ষেত্রে দক্ষতার সাথে কাজ করতে সক্ষম হতে হবে ৷ যার কোনোটাই এখন আর সম্ভব নয় ৷ কেন সম্ভব নয় , তার ব্যাখ্যায় দেখা যায় যৌক্তিক লোগোস এর প্রয়োগিক অনুসন্ধানে দেখা যায় যে , পৌরণিক কাহিনী বা মিথের অতীতে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো বাস্তবভিত্তিক সত্যতার প্রমাণ নাই , অন্য ভাবে ও ইহা বলা যায় যে , যৌক্তিক লোগোসের প্রয়োগিক অনুসন্ধান অতীতের চরম অর্থ সংক্রান্ত কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছে ৷
তা সত্তেও এক বিশাল সংখ্যক মানুষ এখন ও ধার্মিক হতে আগ্রহী , তাই তারা বিশ্বাসের এক নতুন ধরন বা ধারা গড়ে তুলতে চেয়েছে ৷ আর মৌলবাদই ঠিক তেমনই এক ধারা , যাকে আধুনিক ধর্মীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক অন্যতম নজীর ৷ কিন্ত ক্রমশই তাদের এই নতুন ধরন , পূর্বের কনফেশনাল ধর্ম বিশ্বাসের বিশেষ কিছু পবিত্র মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে ৷ তাই মৌলবাদীরা আগের প্রচলিত কিছু বিশ্বাসকে যোগবিয়োগ করে প্রাচীন ‘ডগমাসমূহকে’ বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য দাবী করে , তাদের বর্তমান জটিল মিথলজিকে কঠোর আদর্শে পরিণত করে ধর্মের মিথোসকে লোগোসে পরিণত করেছে , ফলে জ্ঞানের দুইটি পারস্পরিক সম্পূরক উৎস ও ধরনকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছে ৷ যা কিন্তু প্রাক -আধুনিক মানুষ বিচ্ছিন্ন রাখাকেই শ্রেয়তর বলে স্থির করেছিলো ৷ মৌলবাদীরা তাদের নতুন অভিজ্ঞতায় এই রক্ষণশীল ও কিছুটা বদলে ফেলা প্রাচীন দর্শনকে সত্যে রূপান্তরিত করে তুলে ধরছে এখন ৷
ক্রিশ্চান , ইহুদি ও মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদীরা অন্য সেক্যুলার আদর্শের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে তাদের মৌলবাদী ধর্মীয় বিশ্বাসকে যুক্তিভিত্তিক ও পদ্ধতিগত ভাবে উপস্থাপন করে , মৌলবাদীরা পুরাতন ধর্মীয় ঐতিহ্যকেও বিকৃত করে ফেলেছে ৷ ফলে সবাই এখন আরো সহিষ্ণু , অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহানুভূতিশীল ধর্মীয় শিক্ষাকে অবহেলা করেছে এবং এর পরিবর্তে ক্রোধ , অসন্তোষ ও প্রতিশোধের ধর্মতত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছে ৷ ক্ষেত্র ভেদে এটা এমনকি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যাকে ও অনুমোদন দানের কাজে ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মকে বিকৃতও করেছে ৷ মৌলবাদীদের যে অংশ ইহাকে গ্রহন করে না , তাদেরকে ও ঐ সব মৌলবাদীরা ধর্ম বর্জনকারী বলে আখ্যায়িত করতে চায় ৷
বর্তমান মৌলবাদী হিংস্রতা আধুনিক সংস্কৃতির মানুষের উপর এক কঠিন পরীক্ষা , যদিও মৌলবাদী হিংস্রতা তাদের আত্মঅহমকেও ভোঁতা করে দিয়েছে অনেকটা ৷ কিন্তু একই সময়ে যৌক্তিক বিশ্বদৃষ্টি সম্পূর্ণ মানুষকে একজন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি ও দিয়েছে ৷ যা কোপার্নিকাস , কান্ট , ডারউইন , ফ্রয়েড় সহ অন্যান্য অনেক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকগণ পূর্বেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মানুষকে ইহা বুঝাতে ছেয়েছেন ৷ প্রকৃতপক্ষে তাহাই যৌক্তিক মানুষের আধুনিক অভিজ্ঞতার আলোকে আবার নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে ৷
তবে একথাও সত্য যে ধর্ম একসময় পর্যায়ক্রমে মানুষকে আধুনিকতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্যও করেছে ৷ যেমন শাব্বেতিয়বাদ , মেথডিজম ও ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ , ইহুদি , ক্রিশ্চান ও মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত করেছে ও তাদের নতুন ধারণার প্রতি অগ্রসর হতে সক্ষম করে তুলে একটা পরিপ্রেক্ষিত দিয়েছে ৷
প্রাক - আধুনিক ধর্ম সব সময়ই মিথোস ও লোগোস কে সম্পূরক হিশেবে দেখে ছে ৷ ইসলামি সংস্কারকগণ সরকারের বাস্তবভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মীয় ও অতীন্দ্রিয়বাদী কাঠামোর ভেতর দিয়েই দেখেছেন ৷ এটা সেক্যুলার আধিপত্যের বিরুদ্বে মৌলবাদীদের বিদ্রোহের অংশ ও বটে ৷ ইহা ঈশ্বরকে ফের রাজনৈতিক বলয়ে ফিরিয়ে আনার একটা উপায় , যেখানে থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছিলো ৷ তাই বিভিন্নভাবে মৌলবাদীরা আধুনিকতার বিচ্ছিনতা ( চার্চ রাষ্ট্রের , সেক্যুলার ও জগতিক কর্মকণ্ডকে ) প্রত্যাখ্যান করে নতুন করে তাদের হারানো সামাজিকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে ৷ ধর্মের মৌলবাদী সংস্কারের মানে দাঁড়ায় এমন এক এক্টিভিজম যাকে এতোদিন অবধি অধর্ম সুলভ মনে করা হলেও তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এখন ৷ ধার্মিক যায়নবাদী এবং মৌলবাদী ক্রিশ্চান ও মুসলমানরা সবাই গতিশীলতা ও বিপ্লবী পরিবর্তনের উপর জোর দিয়েছে যাতে আধুনিক সমাজের অগ্রযাত্রা ও বাস্তবভিত্তিক গতির সাথে তাল মেলানো যায় ৷ তাই সষ্টার পক্ষে মৌলবাদীদের এই লড়াই বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কেন্দ্রে অবস্থান করা শূন্যতাকে ভরে তোলার একটা প্রয়াস হিশেবে দেখে সেক্যুলারিষ্টরা তাদের প্রতি - সংস্কৃতির দিকে তীক্ষ্ন ও নিবিড় দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে লাভবান হতে পারবে বলে ধারণা করা হয় ৷
উপরে উল্লেখিত মৌলবাদের আবির্ভাবের যে ব্যাখ্যা বা কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা শুধুমাত্র আধুনিক ইউরোপ , আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের উপর ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর গবেষণা গ্রন্থ স্রষ্টার জন্য লড়াই ( The Battle for God ; A History of Fundamentalism , by Karen Armstrong ) এর উপর ভিত্তি করে লেখার চেষ্টা করা হয়েছে ৷
তাই ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাপারে সকল ক্ষেত্রে এই সব কারণ বা ব্যাখ্যা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম ৷ কারণ এই উপমহাদেশের প্রধান তিনটি দেশ - ভারত , বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানে মৌলবাদের আবির্ভাবের কারণ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির ৷ এই তিন দেশের মানুষের শিক্ষার হার এখনো পশ্চিমের তুলনায় অনেক কম ৷ আর যারা শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছেন , তাদের মধ্যে ও আলোকিত ও যৌক্তিক লোগোসের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষার যে ধারা বর্তমানে প্রচলিত হয়েছে তার সঙ্গে এখানকার শিক্ষার মান সমান নয় ৷ ফলে এখানকার শিক্ষিতরা সবাই পশ্চিমার মতো এতোটা যৌক্তিক ও আধুনিক চিন্তা চেতণার অধিকারী এখনও হতে পারেন নি ৷ তবে ইনটারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বর্তমানে আলোকিত ও যৌক্তিক চিন্তাধারার মানুষ এখন এখানে সৃষ্টি হতে আরম্ভ হয়েছে ৷
অন্যদিকে এই তিন দেশের সাধারণ মানুষ যার যার ধর্মে খুবই ধর্মপ্রাণ এবং তাদের ধর্মের প্রাচীন বিশ্বাসে এখন বিশ্বাসী ৷ তাই আধুনিক মৌলবাদী ধরন এখনো এখানে ভাল ভাবে শেকড় প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও বর্তমানে এ সব দেশের নীতিহীন রাজনীতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে এখন এ সব দেশে ও আধুনিক মৌলবাদের প্রতিষ্ঠা লাভ করছে তীব্র গতিতে ৷ এখানকার রাজনীতিবিদরা নিজেরা মৌলবাদী না হলে এবং আর মৌলবাদীরাও ক্ষেত্রবিশেষে সেক্যুলারিস্ট এর অভিনয় করে রাজনৈতিক স্বার্থে এবং ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে বা আগামিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে মৌলবাদীদের ব্যবহার করছেন আর মৌলবাদীরা এর সুফল ভোগ করে এখানে রাষ্ট্রের সহায়তায় মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পাচ্ছে ৷
বাঙলা দেশের প্রায় সব মানুষই ধর্মপ্রাণ মুসলমান , হিন্দু , বা বুদ্ধ ,এখানে যার যার ধর্মবিশ্বাসে সবাই অটল ৷ তবে তারা মোটামোটি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসে এখন ও বিশ্বাসী ৷ ফলে তারা একে অন্যের প্রতি সহনশীল ৷ তাই বাঙলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক তাদের চিন্তা চেতণায় এখনো ৷ তবে বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে এর কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে ৷ কারণ হিশেবে মনে করা হচ্ছে , বিগত সামরিক দুই সরকারের সময়ে , তারা ক্ষমতায় ঠিকে থাকার স্বার্থে দেশে , ওহাবী , দেওবন্দী ও মওদুদী পন্থি অনেক ধর্মীয় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিয়ে ছিলেন ৷ পরবর্তিতে সৌদি-বলয়ের বেশ কিছু এন জি ও এদেরকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে , এই তিন ধারাকে একত্রে এক ধারায়( বহ্যিক না হলেও ভেতরে ভেতরে ) রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে ৷ ফলে এই তিন ধারা একত্রে একটা আধুনিক মৌলবাদী ধারা বর্তমান বাঙলাদেশে গড়ে তুলেছে , এবং তাদের পেছনে ভোটে বা নির্বাচনে সহায়তা পেতে অনৈতিকভাবে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা গ্রহণে তারা সক্ষমতা অর্জন করেছে ৷ ফলে অন্য ধারার ইসলামপন্থিরা , বিশেষ করে বারলেভি ও ইজতেহাদবাদী , আহলে হাদিস এবং আহমদিয়েরা এখন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিয় সহায়তার অভাবে পেছনে চলে যাচ্ছে অর্থাৎ সমাজে ইসলামী দুই ধারার, ব্যালেন্সিং থাকছে না পূর্বের মত , যা কোনো ভাবেই বাঙলা দেশকে মৌলবাদীদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে সহায়ক হবে না ৷ কারণ যদি ওহাবী ধারা শক্তিশালী হয়ে যায় বাঙলাদেশে , তবে তা ধীরে ধীরে ইসলামী জঙ্গীবাদের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে ৷ তাই রাজনীতিবিদগণকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে , তাদের এ সব অনৈতিক ও জাতির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়েছে বলে দেশের দেশপ্রেমিক মানুষের প্রত্যাশা , দেশের ক্ষমাতাসীন ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ৷ না হয় অচীরেই বাংলাদেশ একটি মৌলবাদী এবং অকার্যকর রাষ্ট্র পরিণত হবে ,সমস্ত বিশ্বের কাছে ৷ তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে এখনই সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহনে সথেষ্ট হতে আহ্বান করা হলো ৷
(সূত্র;-এই লেখাটি The Battle for God ; A History of Fundamentalism , by Karen Armstrong ,অনুবাদ : শওকত হোসেন , গ্রন্থের অনুকরণে লিখিত )
(এই লেখাটা একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা , কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করার উদ্দেশ্য লেখাটি তৈরি করা হয় নাই , এবং গণমাধ্যমে ইহা প্রকাশ করা যাবে না লেখকের অনুমতি ছাড়া ৷ অগ্রীম ধন্যবাদ , )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন