বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ' ধর্ম নিয়ে যতো কথা' ,



                                   ধর্ম নিয়ে যতো কথা
                     
                   পৃথিবীকেন্দ্রিক যে-সব বিশ্ব বা মহাজগত কল্পনা করেছিলেন ইউডোক্সাস, আরিস্ততল, টলেমি, সে গুলো আজকের মহাজগতের তুলনায় ছিলো খুবই ছোট এর মূলে রয়েছে তাঁদের দুটি বিশ্বাস ; একটি হচ্ছে যে বিশ্বের কেন্দ্র হচ্ছে পৃথিবী, অন্যটি হচ্ছে পৃথিবী স্থির এর মূলে আছে পৃথিবীর ধর্মের বইগুলো ; এগুলোতেই বেশি বিশ্বাস করে অন্ধরা

           কোপারনিকাস ,কেপলার, আর গ্যালিলিওর জন্মের পরেও সাহিত্য অন্ধ থেকে গেছে মিল্টন তাঁর স্বর্গচ্যুতি মহাকাব্যে পৃথিবীই মহাজগতের কেন্দ্র উল্লেখকরে লিখেছেন তাঁর মহাকাব্য দেবদূতরা চিরকালই অন্ধতা ও আনুগত্যের পরামর্শ দিয়েছে; কিন্তু মানুষ , অন্তত কিছু মানুষ , ওই পরমর্শ শোনেনি বিশ্ব বা মহাজগত কখন সৃষ্টি হয়েছিলো ? ইহুদি, খ্রিস্টান, ও ইসলাম ধর্ম মতে, অতীতের একটা নির্দিষ্ট সমকম বেশী প্রায় সাত হাজার বছর আগে বিধাতা সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্ব । কিন্তু য়ে,১৯২৯-এ এডউইন হাবেল দেখতে পান, দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ দ্রুত সরে যাচ্ছে আমাদের থেকে; অর্থাৎ মহাজগত সম্প্রসারিত হচ্ছে বিজ্ঞানীরা মনে করেন আজ থেকে দশ বা বিশ হাজার মিলিয়ন বছর আগে মহাজগতের সবকিছু ছিলো একীভূত; তাই মহাজগতের ঘনত্ব ছিলো অসীম আর ওই অবস্থায়ই ঘটে Big Bang-মহাবিস্ফোরণ , আর সূচনা হয় মহাজগতের হকিংয়ের মতে সময়ের সূচনা ও হয় বিগ ব্যাংয়ে থেকে কিন্তু সময় বইতে থাকে,মহাজগত সম্প্রসারিত ও বিকিরণ , শীতল এবং অন্ধকার হতে থাকেআদি মহাজগত পরিপূর্ণ ছিলো হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম, এবং বিকিরণে তখনই সৃষ্টি  হয় নক্ষত্রমণ্ডলি আর ওই মহাবিস্ফোরণ থেকেই দেখা দেয় নক্ষত্রমণ্ডলি, নক্ষত্র, গ্রহ, তারপর   জীবন এখন মহাজগতে রয়েছে অজস্র নক্ষত্রমণ্ডল এক সময় হয়ত পৃথিবীর জলবায়ু নিঃশেষিত হয়ে মিশে যাবে মহাশূন্যে, মহাপ্রলয় শুরু হবে পৃথিবী জুড়ে সূর্য ও পৃথিবী ধ্বংস হবে , তবে মানুষ হয়তো ধ্বংস হবে না তখন মানুষেরও এতো বিবর্তন ঘটবে, এতো বিকশিত হবে তাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিভা যে তাঁরা পৃথিবী ধ্বংসের অনেক আগেই হয়তো পাড়ি জমাবে অন্য কোনো গ্রহে, বা নিজেদের জন্যে তৈরি রে নেবে কোনো মহাজগতিক বাসভূমি

           মহাজগতের উৎপত্তির জন্যে দরকার পড়ে না কোনো বিধাতার, ধ্বংসের জন্যেও পড়ে না ; তবে সমাজরাষ্টের ওপর প্রভুত্ব করার জন্যে দরকার পড়ে বিধাতার তবে বিধাতা সরে যাবেন, রাজনীতিবিদেরা তাঁকে বেশি দিন আয়ত্তে রাখতে পারবেন না

          পৃথিবীর সব প্রাণীই গঠিত জৈব অণুতে, যাতে কার্বনপরমাণু পালন করে কেন্দ্রীয় ভূমিকা এমন এক সময় গেছে যখন কোনো প্রাণ ছিলো না পৃথিবীতে, এটা ছিলো নিষ্প্রাণ শূন্য; কিন্তু এখন পৃথিবী প্রাণে ভরপুর কীভাবে নিষ্প্রাণ শূন্য পৃথিবী রে উঠলো প্রাণে ? পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে যেসব প্রাণ, তাদের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক

         পৃথিবীতে আমাদের সকলের রয়েছে একই সাধারণ জৈবরাসায়ন ; আমরা বহন করি একই সাধারণ বিবর্তনমূলক উত্তরাধিকার আমরা , সব প্রাণী, উদ্ভূত হয়েছি বিবর্তনের ফলে মানুষ কোনো স্বর্গচ্যুত অভিশপ্ত প্রাণী নয়, মানুষ বিকশিত প্রাণী ; তবে মানুষেরই একদল রটিয়েছে যে মানুষ স্বর্গচ্যুত পাপী বিবর্তন প্রমানিত সত্য পৃথিবীর সূচনা হয়ে ছিলো কীভাবে ? মোটামুটি ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে মহাজাগতিক গ্যাস ও ধুলো জমাট বেঁধে উৎপত্তি হয়েছিলো পৃথিবীর পৃথিবীর উদ্ভবের পর প্রাণের উদ্ভব হতে ও সময় লাগে নি ; চার বিলিয়ন বছর আগে আদিম পৃথিবীর সমুদ্রে জলাশয়ে দেখা দিয়েছিলো প্রাণ তবে একদিনেই আজকের জটিল প্রাণবাশি দেখা দেয় নি, নানা বিক্রিয়র ভেতর দিয়ে কোটি কোটি বছরে বিকাশ ঘঠেছে প্রাণের প্রাণের মূলবীজ হচ্ছে ডিএনএ, বা ড়িঅক্সিরিবোনিউক্লেয়িক এসিড ডিএনএ অণু দেখতে মুছড়ে কুণ্ডলিপাকানো মইয়ের মতো, যার ধাপগুলোর রয়েছে চারটি অংশ এগুলোতে রয়েছে জৈব সংকেত একেক প্রাণীর জৈবসংকেত ভিন্ন অন্যটির থেকে চার বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী ভরে উঠেছিলো জীবন-অণুতে, শুরু হয়েছিলো প্রাণের বিবর্তন ; তার পর কোটি কোটি বছরে দেখা দিয়েছে ও বিলীন হয়ে গেছে বহু ধরনের প্রাণ এক সময় পৃথিবীতে এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিত দেখা দিয়েছিলো, যা আজ নেই এক সময় পৃথিবীতে ঘটে এক মহাবিস্ফোরণ, তার পর থেকে প্রাণের বিকাশ ঘটতে থাকে দ্রুত দেখা দিতে থাকে মাছ, মেরুদণ্ডী প্রাণী ; ভূমিতে জন্ম নিতে থাকে গাছপালা ; জন্মে সরীসৃপ, ডাইনোসর, স্তন্যপায়ী প্রাণী , পাখি,এবং ফুটে ফুল এক সময় লোপ পায় ডাইনোসররা ; দেখা দেয় প্রাইমেট বা উচ্চ মেরুদণ্ডী প্রাণীরা, যারা বানর আর মানুষের পূর্বপুরুষ আজ থেকে এক কোটি বছরের মতো আগে উদ্ভূত হয় মানুষের পূর্ব -পূর্ব - পূর্ব - পূর্বপুরুষ, তাদের মস্তিষ্ক ও হয় বিকশিত ; আর কয়েক মিলিয়ন বছর আগে দেখা দেয় আদিমানুষেরা ধর্মের বইগুলোতে মানুষ সৃষ্টির কাহিনী অত্যন্ত সরল; অতো সরলভাবে অতো অল্প সময়ে মানুষ সৃষ্টি হয় নিপ্রাণ থেকে প্রাণী সূষ্টি করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে প্রকৃতির । ধর্ম প্রবর্তকরা তাঁর কাঠামো বিধাতার কাঠামো হিসাবে ঢুকিয়ে দেন বিধাতার বইতে , সাত আসমান দশ আসমান বলে কিছুই নেই, ধর্মের বইগুলো বিধাতা লিখলে এমন ভূল করতেন না


             যারা অন্ধ তারা চোখে সবচেয়ে বেশি দেখতে পাচ্ছে এখন 

        এক বড়ো অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে, যারা অন্ধ তারা চোখে সবচেয়ে বেশি দেখতে তো পাচ্ছেই, তারা অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস করছে  এবং পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের মহামারী বিশ্ব এখন মেতে উঠেছে মধ্যযুগীয় বিশ্বাসে ; শক্তিলোভী ভ্রষ্ট রাজনীতিকেরা মানুষকে আক্রান্ত করে তুলেছে বিশ্বাসের রোগে তবে বিশ্বাস শুধু অতিমানবিক সত্তায়ই সীমাবদ্ধ নয় ; হাজার হাজার শূন্য প্রথা বিশ্বাস করে চলেছে তারা, যা খুবই ক্ষতিকর বাঙলাদেশে আজ সবাই বিশ্বাসী ;তবে হুমায়ুন আজাদের অবিশ্বাস আরো গভীরে, দেখেছেন মানুষের বিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতা,  বিশ্বাস তার কাছে আরণ্যিক নির্বোদের ভ্রান্ত দুঃস্বপ্ন।  

       তিনি যেমন তার ইন্দ্রিয়গুলোকে ভালবাসেন, তেমনি ভালবাসেন তার মগজকে, এ সব তার কাছে কিংবদন্তির মতো  তার মতে মানুষ তৈরি করেছে ধর্মের রূপকথা, তৈরি করেছে স্রষ্টা, পাপ, পূণ্য ,স্বর্গ আর নরক এ যেন তাৎপর্যহীন জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করার স্থুলতম প্রয়াস ধর্ম একে তৎপর্যপূর্ণ করতে চেয়েছে সবচেয়ে নিকৃষ্টরূপে বহু মানুষ বিশ্বাস করে বিধাতায়,  পোষণ করে ধর্মীয় বিশ্বাস ;  তবে বিধাতা বা ধর্মীয় বিশ্বাস,  যা মানুষের আদিম কল্পনার ফল,  যা জীবনকে করে তোলে মিথ্যায় পূর্ণ    নির্বোধ,অন্ধ,লোভী, কপট, ভীতুরা তাতে শান্তি পেতে পারে যা হাস্যকরও নিরর্থক   তিনি মনে করেন ,  কোনো পূর্বনির্ধারিত পথ  নেই মানুষের জন্য ;  কোনো গ্রন্থ পথ দেখাতে পারে না তাকে,  কোনো মহাপুরুষ বা প্রবর্তক  তার জন্য পথ প্রস্তুত করতে পারেন না ; ওই মহাপুরুষেরা তৈরি করেছেন নিজেদের পথ, অন্যদের নয়   প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে হয় নিজেদের পথ,তৈরি করতে হয় নিজেদের রাস্তা , মানুষের জীবনটা শুধু দুই অন্ধকারের মাঝখানের হঠাৎ ঝলকানিটুকু পাঁচ হাজার বছর ধরে মানুষ জন্ম নিয়েই দেখেছে তার জন্যে প্রাণপণে প্রস্তুত হয়ে আছে পূর্বনির্ধারিত বিশ্বাসের জগত পৃথিবীর দীর্ঘস্থায়ী মহামারির নাম বিশ্বাস তিরিশের আধুনিক কবিরা অবিশ্বাসী ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন,  সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ;  এবং ঈশ্বর নামের অলীক ব্যাপারটি ছিলো তাঁর কাছে স্পষ্ট তিনি বাতিল করেছেন প্যালেস্টাইনি ও আর্য ঈশ্বর , তিনি বলেছেন ,  শূদ্রের অলক্ষ্যভেদে নিহত আমার ভগবান’  তিনি অবিশ্বাসে বলেছেন- ভগবান, ভগবান, রিক্ত নাম তুমি কি কেবলই ,তুমি কি সত্যই  আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন ? তপন্ত তপন সাহারা-গোবর বক্ষে জ্বলে না কি তোমার আজ্ঞায় যাযাবর আর্যের বিধাতা





   সূত্র:  হুমায়ুন  আজাদের বই       আমার অবিশ্বাস        অবলম্বনে লিখিত।











মন্তব্যসমূহ