৩ ) কোরান
ও সুন্নাহ্ র আদি ইসলামে ফিরে যাবার আকাঙ্খা এবং মুসলিম মৌলবাদের বিকাশ এবং আলাদা শিয়া রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠা ;-
নবীজী(সঃ) এর ইসলাম , খলিফাহ্ দের শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
সূত্র;-ইসলাম-
নবীজী(সঃ) এর ইসলাম , খলিফাহ্ দের শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
প্রাক-আধুনিক সকল সমাজে, কৃষিভিত্তিক ইউরোপসহ, শিক্ষার
মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকে
টিকিয়ে রাখা এবং ব্যক্তিবিশেষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কৌতুহলে
প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করা ৷ যেন সমাজ বা গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না হয় । তখন মাদ্রাসাসমূহে ছাত্ররা প্রাচীন বিবরণ ও টীকাভাষ্য মন দিয়ে মুখস্থ করতে হয়েছে ,শুধু গ্রন্থের শাব্দিক বা আক্ষরিক ব্যাখ্যা দিয়ে । এভাবে মাদ্রাসাসমূহ সেইসব ধ্যান-ধারণার গ্রহনযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছে , যেগুলোর সাহায্যে সারা বিশ্বের মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে ৷ এবং ধর্ম বিরোধী ধ্যান ধারণাকে চাপা দেয়া যাবে, যেন বিরোধ সৃষ্টির ফলে মানুষ ধর্মের সরল পথ ত্যাগ করে আপন
পথ বেছে না নেয় । অর্থাৎ ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে মানুষের চিন্তা ও চেতনাকে আগলে রাখার চেষ্টার প্রয়াস ছিলো সেটি ৷ মানুষকে জ্ঞান বিজ্ঞানে আলোকিত করে সভ্য সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিপরিত পদক্ষেপ ছিলো সেটা ৷
চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ একমাত্র শরিয়াহ্ পাঠ এবং তা পালন করাই সুন্নী, শিয়া, সুফি
এবং
ফায়লাসুফ-অর্থাৎ সকল মুসলিমের গৃহীত ধার্মিকতার রূপ হয়ে
দাঁড়িয়েছিল । এই সময়ের উলেমারা বিশ্বাস করতে থাকেন যে ইসলামী
ইতিহাসের একেবারে সুচনাকাল থেকেই এসব আইনের অস্তিত্ব
রয়েছে । এ সময়ে রুমির মত কিছু সুফি যখন নতুন দিগন্তের দিকে তাকানোর
প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন , উলেমাদের অনেকেই তখন বিশ্বাস করছিলেন
যে কিছুই পরবর্তিত হয়নি আগের । এ কারণে “ ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ
হওয়ায়
সন্তুষ্ট ছিলেন তাঁরা । অতীতের শিক্ষার ব্যাপক ক্ষতিকরে , পুরাতন পণ্ডুলিপির
বিনাশ করে এবং জ্ঞানী-গুণীদের নির্বিচারে হত্যার পর তাদের সম্পদের
পুনরুদ্ধারই নতুন কোনো পরিবর্তন আনার চেয়ে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো ৷ মঙ্গোল সামরিক আইনে সাধারণ নাগরিকদের বিষয়ে কোনো বিধিব্যবস্থা না থাকায় উলেমারা বিশ্বাসীদের জীবনধরন পরিচালনা অব্যাহত রাখেন এবং ফলে তাঁদের প্রভাব রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত হতে থাকে বেশি করে । তাই রুমির মত সুফিরা যেখানে সকল
ধর্মকেই বৈধ বলে বিশ্বাস করেছেন, তখন চতুর্দশ শতাব্দী
নাগাদ উলেমাগণ সেখানে কোরানের বহুত্ব মতবাদকে কঠিন সাম্প্রদায়িকতায় রূপ দিয়েছেন, এবং সেখানে অন্য ট্র্যাডিশনসমুহকে অতীতের মূল্যহীন নজীর
হিসাবে দেখেছেন । আমুসলিমদের জন্যে এই সময় পবিত্র নগরী মক্কা ও মদীনা
সফর ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর পয়গম্বর মুহাম্মদ (সঃ)
সম্পর্কে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশ করা অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় ৷ আর সে অপরাধকে পরিণত করা হয় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য
অপরাধে ।
কিন্তু
“ ইজতিহাদের দ্বার” রুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি মেনে
নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী কিছু উলেমাগণও ছিলেন তখন । আবার কিছু সংস্কারক (মুজদাদিদ) ) ও ছিলেন যারা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন নি । তবে তাঁরাও ছিলেন রক্ষণশীল, তাঁরা
নতুন
সমাধান সৃষ্টির বদলে মূলে প্রত্যাবর্তনের প্রয়াস পেয়েছেন বেশি করে । কিন্তু কোরান ও সুন্নাহ্ র
আদি ইসলামে ফিরে যাওয়ার চেয়ে , সংস্কারকারকগণ প্রবিত্র বলে
বিবেচিত এবং পরবর্তী মধ্যযুগীয় সকল পরিবর্তনকে প্রতিমা পূজার
বিরোধিতার মত বিতাড়ন করতে চেয়েছেন এবং করেছেনও । এঁরা বিদেশী প্রভাবের বেলায়ও
সন্দিহান ছিলেন এবং ভিনদেশী সংযোগও-যা তাঁদের দৃষ্টিতে ধর্মবিশ্বাসের
খাঁটিত্বকে বিনষ্ট করতে পারে বলে তা বর্জণ করেছেন কঠোর ভাবে । পরবর্তিতে এ ধরণের সংস্কারকগণের চিন্তা ও চেতনা ই মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্যে পরিনত হয়েছে ।
আমাদের বর্তমান সময়ে যাদের “ মুসলিম মৌলবাদী” বলে
আখ্যায়িত করা হয় , তাদের অনেকেই মুজদাদিদের রেখে যাওয়া
পুরনো প্যাটার্নই হুবহু বেছে নিয়েছেন ।
মঙ্গোল পরবর্তীকালের পৃথিবীর যুগ-শ্রেষ্ঠ সংস্কারক ছিলেন
আহমাদ ইবনে তাঈমিয়াহ্ (১২৬৩-১৩২৮) ৷ দামাস্কাসের আলিম ছিলেন তিনি এবং হানবালি
মাযহাবের অনুসারী এক প্রাচীন উলেমা পরিবারে তাঁর জন্ম হয়েছিল । শরিয়াহ্ র মূল্যবোধকে সুসংহত
করতে
চেয়েছিলেন তিনি । তবে তাঁর একটা ইতিবাচক কর্মসূচীও ছিল । তিনি মনে করতেন ; পরিবর্তিত
এই মুসলিমদের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ করার স্বার্থে শরিয়াহ্ কে আরো সময়োপযোগী করতে হবে, সে জন্যে যদি কয়েক শতাব্দী
ধরে গড়ে ওঠা ফিকাহ্’র বেশীরভাগ বিসর্জনও দিতে হয় তবে তাও করতে তিনি পিঁছপা হন নি । সুতরাং চেতনামুখী বৈধ সমাধান আবিস্কারের লক্ষে জুরিস্টদের জন্যে ইজতিহাদের প্রয়োগ আবশ্যক বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন । যদি তাতে সাম্প্রতিককালে যেভাবে আইনের ব্যাখ্যা বা ভাষ্য চালু আছে তাঁর লঙ্ঘন ঘটে তবুও । তাই তিনি তখন প্রশাসনের জন্যে উদ্বগজনক ব্যক্তি হওয়ায় তাকে কারারুদ্ধ হয় এবং কারারুদ্ধ অবস্থায় তাঁর সন্দেহজনক মৃত্যু হয় ।
কোরান ও সুন্নাহ্’য় প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামের
সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের বেশীরভাগেরই প্রত্যাখ্যান এক
ধরণের প্রতিক্রিয়াশীলা ছিল, কিন্তু তা আবার ক্ষেত্রবিশষে বিপ্লবী ধারাও ছিলো । রক্ষণশীল উলেমারা তখন আক্ষরিক গ্রন্থভুক্ত জবাব আঁকড়ে ছিলেন । কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঈমিয়াহ্
কে ভালোবেসেছিল তাঁর শরিয়াহ্ র সংস্কারের উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির
কারণে ।
আব্দ আল-রাহমান ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) স্পেন থেকে
টিউনিসিয়ায় এসেছিলেন যখন , তখন স্পষ্টতই সঙ্কটে নিপতিত ছিল
ইসলাম । তিনি
এসে বলেছেন;
“ যখন পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে, তখন যেন গোটা সৃষ্টি বদলে যাওয়া, আর বদলে যাওয়া গোটা বিশ্বেরই যেন
নতুন করে সৃষ্টি ঘটে আরএক বিশ্বের , যাকে বলা যেতে পারে এক " বিশ্বের নতুন পুনর্জন্ম, ” । তিনি ছিলেন সর্বশেষ প্রধান
স্প্যানিস ফায়লাসুফ ; তিনি এই পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো আবিস্কার করতে চেয়েছিলেন । তাঁর উদ্ভাবন ছিল ইতিহাসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে দার্শনিক যুক্তিবাদের নীতিমালার বিশেষ প্রয়োগ ৷ এর আগে পর্যন্ত যা
দার্শনিকদের মনোযোগের বাইরে ছিল বলে মনে করা হত ৷ কেননা
এটা চিরন্তন সত্যের পরিবর্তে কেবল অস্থায়ী এবং অনিশ্চিত
ঘটনাবলীকে নিয়ে কাজ করে বলে তাঁর ধারণা জন্মে ছিল । তাই ইবনে খালেদুন বিশ্বাস করতেন যে ,ঐতিহাসিক
ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে বিশ্বজনীন আইন সমাজের ভাগ্যকে পরিচালিত
করে থাকে । তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে দলীয় সংহতির (আসিবীয়াহ্-asibiyyah) প্রবল বোধই কেবল কোনো জাতিকে টিকে থাকতে সক্ষম করে তোলে এবং
অনুকূল পরিস্থিতিতে অন্য জাতিকে ও তাদিয়ে বশীভূত করা যায় । তখন প্রভাবশালী দলটি তাদের অধীনের লোকদের সম্পদ আত্মীকরণ করে আর নতুন সংস্কৃতি আর জটিল নাগরিক জীবন গড়ে তুলে বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলে আবার এক নতুন চক্রের
সুচনা
ঘটে । ইবনে খালদুনের প্রধান রচনা আল-মাকাদ্দিমাহ্;( An introduction to
history) ইসলামের ইতিহাসে এই তত্ত্বের প্রয়োগ দেখিয়েছে , যা
পরবর্তী বছরগুলোয় মুসলিম সাম্রাজ্য নির্মাণকারীগণ ও উনবিংশ
শতাব্দীর পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ নিবিষ্ট মনে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করেছেন । ইবনে খালদুনকে ইতিহাসের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখছেন এঁরা । চতুদর্শ শতাব্দীর
দ্বিতীয়ার্ধে মঙ্গোল রাজ্যগুলোর পতন খালদুনের তত্ত্বকে স্পষ্টভাবে
প্রমান করেছে ।
টিমুর ল্যাঙ্ক বা খোঁড়া টিমুর (১৩৩৬-১৪০৫) পতনোম্মুখ
চ্যাঘাটাই সাম্যাজ্যের ক্ষমতা দখল করে নিজেকে মঙ্গোল বংশোদ্ভুত দাবী করেন । তাঁর ইসলামের -গোঁড়ামিপূর্ণ, নিষ্ঠুর
এবং সহিংসতা ও ধ্বংসলীলার সঙ্গে উলেমাদের রক্ষণশীল ধার্মিকতার
বা সুফিদের ভালোবাসার মতবাদের সামান্যই মিল ছিল , ছিল সম্পূর্ণ বিপরিত । টিমুর লং ১৩৮৭ সাল নাগাদ গোটা ইরানি উঁচু অঞ্চল এবং মেসোপটেমিয়ার সমভূমি অধিকার করে নেন ।আর ১৩৯৫ -এ রাশিয়ায় গোল্ডেন
হোর্ড দখল করে , ১৩৯৮-সালে চডাও হন ভারতের ওপর এবং হাজার
হাজার হিন্দুকে হত্যা করেন এবং ধ্বংস করে দেন দিল্লীকে । এর দু ‘বছর
পর
আনাতোলিয়া জয় করেন এবং দামাস্কাসে কুক্ষিগত করে বাগদদে
হত্যাযজ্ঞ চালান । ১৪০৪-এ চীনের দিকে হন এবং ১৪০৫-এ নিহত হন তিনি ।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে দিল্লীর সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ
হিন্দুরা মুসলিমদের আধিপত্য মেনে নেয় । তখন সেখানে জাতপ্রথা ও
রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুশীলন মুষ্টিমেয় পরিবারের হাতে
সীমিত থাকার ফলে সাধারণ হিন্দুরা জাতপ্রথার বিধিবিধান লঙ্ঘিত
না হলে তাদের জায়গায় যে কাউকে গ্রহণ করতে মানুষিক ভাবে প্রস্তুত ছিল । ফলে নিম্নবর্ণের
কিছু হিন্দু এবং অস্পৃশ্যদের একটা অংশসহ মূলত সুফি পিরদের প্রচারণর
ফলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেফেলে ৷ এর পরিপ্রক্ষিতে ১৩৩০-এ নাগাদ উপমহাদেশের বৃহত্তর অংশ দিল্লীর সালতানাতের কর্তৃত্ব মেনে নেয় ।
এক রাজনৈতিক কারণে এই সময়ে গাজী যোদ্ধাদের তাদের নিজস্ব আমিরাত পরিচালনা করার সুযোগ করে দেয়
মঙ্গোলরা । কারণ গাজীদের ধার্মিকতা
ও সুফিবাদের প্রতি তারা প্রবলভাবে ঝুকে পড়ে এবং আযেরবাইজান ও আনাতোলিয়ায় বিভিন্ন তরিকাহ্ গড়ে তুলে ৷ যেগুলোতে সুফিবাদের কোনো কোনো চরমপন্থী ধরনের প্রাচীন মতবাদ ও বিপ্লবাত্মক শিয়া বৈশিষ্টের মিশ্রণ ঘটিয়েছিল । এই মত অনুযায়ী আলীকে ঈশ্বরের অবতার হিসাবে শ্রদ্ধা করা আরম্ভ করা হয় ৷ কারণ এদের বিশ্বাস ছিল- পরলোকগত
আমিরগণ “উর্ধ্বগামী” (Occultation) হয়েছেন ৷ তাই তারা তাদের মনোনিত নেতাদেরকে মাহ্ দি হিসাবে শ্রদ্ধা জানাতে আরম্ভ করে দেয় ৷ তাদের মতে তিনি ন্যায়-বিচারের নবযুগের সূচণা
ঘটাতে আবার ফিরে এসেছেন বলেও তারা বিশ্বাস করত ৷ এদের সবাই আনাতোলিয়ার বক্তাশি দরবেশদের ব্যাপক অনুসাসী ও ছিল । তবে তারা প্রচীন ধর্মীয় নিয়মকানুন প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখাতনা তেমন ভাবে । ইহা প্রথমে সুন্নী তরিকাহ্ হিসাবে সুচিত হলেও
পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ তা চরমপন্থি ঘুলুউ(ghuluww) ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় ৷ এবং নিজেদেরকে দ্বাদশবাদী শিয়া বলে আখ্যায়িত করত । তাদের নেতাকে তারা সপ্তম ইমামের বংশধর হিসাবে বিশ্বাস করত ; আর সে কারণে তিনিই মুসলিম উম্মাহ্
র একমাত্র বৈধ নেতা বলে দাবী করত ৷
ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই মতবাদের পির ছিলেন ইসমায়েল ৷ যিনি
হয়ত নিজেকে গুপ্ত ইমামের অবতার বলে বিশ্বাস করতেন ৷ একপর্যায়ে তিনি ইরানে এক নতুন শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।ফলে আজও ইরান শিয়া রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত আছে ঐ সময়ের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরে ৷
বিজয়ী ও রাজকীয় ইসলাম
এবং সাফাভীয় সাম্রাজ্য ও ইসলামী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে এক শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ;-
দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদ গ্রহনকারী সাফাভীয় সুফি ধারার অনুসারীরা জর্জিয়া ও ককেসাসের ক্রিশ্চান অধিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘাযু (Ghazu) হামলা চালিয়ে আসছিল, তারা আবার মেসোপটেমিয়া ও
পশ্চিম ইরানের ক্রোধের ও শিকার হয়েছিল । ১৫০০-তে ষোল বছর বয়স্ক
ইসমায়েল এই ব্যবস্থায় পির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আমিরদের হাতে নিহত
পিতার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে, ১৫০১-সলে তাব্রিয অধিকার করেন এবং পরবর্তী
এক দশকে ইরানের বাকি অংশ দখল ক’রে দ্বাদশবাদী শিয়াদের জন্যে এক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন ৷ এবং তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে দ্বাদশবাদী শিয়া পন্থি রাষ্ট্র হিসাবে
ঘোষণা দেন ।
এর আগ পর্যন্ত অধিকাংশ শিয়াই ছিল আরব । ইরানেই রাঈ, কাশান, খুরাসান
ও কুম-এ শিয়া দের কেন্দ্র থাকলেও সিংহভাগ ইরানিই ছিল সুন্নী । তাই ইরান থেকে সুন্নীমতবাদ নিশ্চিহ্ন করতে নামেন ইসমায়েল ; সুফি তরিকাহ্ সমূহকে
দমন ক’রে , উলেমাদের হত্যাকরা হয় নয়ত পাঠানো হত নির্বাসনে । অতীতে কখনও কোন শিয়া শাসক এমন ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহন করেননি । তবে একপর্যায়ে এসে, পরবর্তী দুশো বছর ধরে শিয়া ও সুন্নীদের মাঝে একটা আঁতাত গড়ে উঠে ছিল । “ রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদে” অতীন্দ্রিয়বাদী দ্বাদশবাদীদের আপত্তি ও তাঁদের
নীতি বর্হিভূত হওয়া সত্ত্বেও শাহ্ ইসমায়েল হয়ত নিজকে গোপন ইমাম হিসাবে তুলে ধরেন ৷ তাই তাকে শেষ জমানায় যুদ্ধে অংশ নিতে ফিরে আসা মেহেদি বা ঈমাম হিসেবে তাঁর অনুসারীদের কেউ কেউ তখন মনে করেছেন । সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাঁর জিহাদ ইরানেই
শেষ
হয়নি । ১৫১০-এ সুন্নী উযবেকদের খুরাসান থেকে উত্তরে বিতাড়িত
ক’রে ,সুন্নী অটোমানদেরও আক্রমণ করেন তিনি ৷ এবং ১৫১৪-সালে চ্যাল্ডিরানের
যুদ্ধে সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে পরাস্ত হওয়ায় আপন
রাজ্যের বাইরে সুন্নীদের ধ্বংস করার তাঁর চেষ্টাও তখন ব্যর্থ হয় । কিন্তু ইরানের অভ্যন্তরে তাঁর
আক্রমন সফল হয় এবং সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ
ইরানি প্রবলভাবে শিয়া হয়ে ওঠে এবং আজ পর্যন্তও তাই
আছে ।
শাহ্ প্রথম আব্বাস(১৫৮৮-১৬২৯ ) ইসমায়েলের নীতি থেকে সরে এসে ঘুলুউ আদর্শর অনুপ্রাণিতদের বাদ দিয়ে জনগণকে দ্বাদশবাদী শিয়া মতবাদে অধিকতর অর্থোডক্স রূপ শিক্ষা দেয়ার জন্যে অন্যদেশ থেকে আরব শিয়া উলেমাদের আমদানি ক’রে
তাদের
জন্যে মাদ্রাসা নির্মান করেন এবং তাদেরকে আর্থিক সমর্থন ও দেন । আব্বাসের অধীনে সাম্রাজ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ প্রত্যক্ষ করেছে জাতি তখন ৷ ফলে তখন ইসফাহান পরিণত হয়েছিল আকর্ষণীয় মসজিদ মাদ্রাসাসহ , পার্ক, প্রাসাদ
আর
বিশাল সব খোলা ময়দানের এক অনন্য সাধারণ এবং আকর্ষনীয় নগরীতে ।
কিন্তু অভিবাসী নতুন উলেমাগণের নিজস্ব শিয়া মাদ্রাসা না থাকায় তারা গবেষণা ও আলোচনার জন্যে পরস্পরের বাড়িতে মিলিত হতেন । এক পর্যায়ে তাঁদেরকে ইরানের শিক্ষা ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব রাষ্ট্রিয় ভাবে অর্পণ করায় তাঁরা আর্থিক দিক দিয়েও স্বাধীন হয়ে যান ৷ এবং তাঁদের ধর্মবিশ্বাসকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে আরম্ভ করেন এবং, নিজদেরকে তারা অর্থাৎ উলেমাগণই গোপন ইমামের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি দাবী করতে আরম্ভ করেন । কিন্তু এই সময়ে সাফাভীয় শাহ্ রা
উলেমাদের সামাল দিলেও মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃত্যু
১৭০০ ) সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উলেমায় পরিণত হয়ে যান ৷ এবং তিনি এক নতুন শিয়া গোঁড়ামি মতবাদ প্রদর্শন করেন আর তা প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হন । তাঁর মতে উলেমাদের কেবল ফিকাহ’র ওপরই জোর দিতে হবে ৷ তিনি মজলিসি ইরানি শিয়াবাদের মধ্যে অতীন্দ্রিয়বাদ দর্শনের প্রতি এমন এক অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম দেন যা আজও ইরানে টিকে আছে ।
মজলসি জনগণকে সমবেত জিকীর ও হুসেইনের সম্মানে পালিত অচার অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেন , যা পরবর্তিতে ইরানের প্রধান ধর্মীয় পতিষ্ঠানে পরিণত হয়েউঠেছে ৷ অষ্টাদশ শতাব্দীতে
কারবালার করুণ ঘটনা তুলে ধরা আবেগময় নাটক ‘ তাজিয়াহ্’র জন্ম দেয়া হয় ৷ যেখানে জনগণ আবেগময় সাড়া প্রদান করে আর তারা
বুক চাপড়ে কাঁদে এবং ইমাম হুসেইনের দুর্ভোগের সঙ্গে
নিজেদের একাত্ম করে তোলে ।
কিন্তু মজলিসি এবং শাহ্ গণ এই আচার অনুষ্ঠানের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে যত্নের সঙ্গে চাপা দিতে সক্ষম হন ৷ শাসকগণ এর পরিবর্তে আপন গৃহে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার বদলে
জনগণকে সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর শিক্ষা দেয়া
হয়েছে । তাই ইরানি বিপ্লব (১৯৭৮-৭৯) অনুষ্ঠিত হবার আগে পর্যন্ত আর কাল্ট দুর্নীতিগ্রস্থ
সরকারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত জনগণের ক্ষোভ প্রকাশের উপায় হয়ে উঠতে পারেনি ।
কিন্তু উলেমাদের কিছু অংশ পুরনো শিয়া ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে গিয়েছিলেন ; তাই তাদের
ধ্যান-ধারণা বর্তমান কালেও ইরান সহ সরা বিশ্বের সংস্কারক ও বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জোগায় ।
মির দিমাদ(মৃত্যু-১৬৩১) এবং তাঁর শিষ্য মোল্লা সদরা (মৃত্যু-১৬৪০) ইসফাহানে অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের এক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷ মজলিসির
বাধা
সত্ত্বেও দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে একত্রিত করার সুহ্
রাওয়ার্দির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তাঁরা ৷ এবং তাদের অনুসারীদের তারা অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে তারা
আলম আল-মিথাল এবং আধ্যাত্মিক জগতের অনুভূতি লাভে সফল হয়ে
উঠতে পারে । উলেমাদের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ঞুতার ব্যাপারে দু’জনই দারুণ বিরুপ ছিলেন ৷ তাঁরা এসব কাজকে ধর্মের বিকৃতি হিসাবে দেখেছেন । তাঁর মতে-বুদ্ধিবৃত্তিক
সমরূপতাবাদ (Intellectual
Conformism) প্রকৃত ধর্মের সঙ্গে
বেমানান । মোল্লা সদরা রাজনৈতিক সংস্কারকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য
হিসাবেই দেখেছেন । তাঁর প্রধান রচনা আল-আফসান আল-আরবাহ্ ( দ্য ফোরফোল্ড
জার্নি- -The
fourfold Journey ) তে তিনি জাগতিক পৃথিবীকে পরিবর্তনের
করার আগে যে সব অতীন্দ্রিয়বাদী প্রশিক্ষণ নেয়া আবশ্যক তার বর্ণনা
দিয়েছেন । তার বিশ্বাস ছিল এই পথে তাঁরা শিয়া ইমামদের মত প্রায় একই রকম আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি
অর্জন করতে পারবে ।
আয়াতোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) মোল্লা সদরার শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং পরলোকগমনের আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া শেষ ভাষনে তিনি জনগণকে ইরফানের গবেষণা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছেন ৷ কেননা তার মতে আধ্যাত্মিক সংস্কার
ছাড়া
প্রকৃত অর্থে কোনো ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না ।
ইরানে নিজেদের উসুলি বলে দাবীকারীদের ব্যাপারে মোল্লাসদরা গভীরভাবে উদ্বগ্ন ছিলেন । উসুলিদের বিশ্বাস ছিল সাধরণ
মুসলমরা নিজেরা ধর্মবিশ্বাসের মৌল নীতিমালা(উসুল) ব্যাখ্যা করার
ক্ষমতা রাখে না ৷ তাই জ্ঞানী শিক্ষিত উলেমাদের
সন্ধান করে তাঁদের আইনি বিধান অনুসরণ করা কর্তব্য ৷ যেহেতু তাঁরাই গোপন ইমামের কর্তৃত্ব ধারণ করেন । শিয়া উলেমাগণ কখনওই সুন্নীদের মত “ ইজতিহাদের দ্বার”
রুদ্ধ করতে রাজি হননি। তাদের মতে মুজতাহিত-যিনি ইসলামী আইন
প্রণয়নর ক্ষেত্রে “ স্বাধীন বিচার বুদ্ধি” প্রয়োগের অধিকার লাভ
করেছেন তাই নেতৃস্থানীয় জুরিস্টকেই তারা মুজতাহিদ বলে
অভিহিত করেন ।
১৭২২-এ আফগান গোত্রগুলো ইসফাহান দখল করার পর নিষ্ঠুর কমান্ডার নাদির খানের
সহায়তায় হানাদারদের বিতাড়িত করা হয় । এরপর বিশ বছর ধরে নাদির খান নিজকে
শাহ্ ঘোষণা করে ইরানকে একত্রিত করে সামরিক বিজয় অর্জন করলেও
১৭৪৮-এ আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান তিনি । নাদির খান ইরানে অসফলভাবে ইরানে সুন্নী ইসলাম
পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন ৷, তখন উলেমাগণ নাজাফ ও কারবালা য় আশ্রয় নিয়েছিলেন । সেখান থেকে তাঁরা ইরানের জাগতিক শাসকের নাগালের বাইরে থেকে জনগণকে নির্দেশনা দিতে পারতেন । এরপর ইরানে যখন কেন্দ্রিয় কর্তৃত্ব বলে কিছুই ছিলনা তখন
উলেমাগণ ক্ষমতার শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন ।
১৭৭৯-এ কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ নিয়ন্ত্রনভার গ্রহন করে কাজার বংশ প্রতিষ্ঠা করলে ইরানে আবার কেন্দ্রিয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উসুলিদের অবস্থান অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় ৷ তখন উলেমাগণও যে কোনো শাহ্ র চেয়ে কার্যকরভাবে ইরানি
জনগণের ভক্তি আর আনুগত্য আদায় করতে সফল হয়েছেন ।
;
;
·
বিজয়ী ও রাজকীয় ইসলাম এবং সাফাভীয় সাম্রাজ্য ও ইসলামী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে
শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ;-
মঙ্গোল রাজ্যসমূহের পতন ঘটার পর সমগ্র আনাতোলিয়ায় ছোট ছোট স্বাধীন গাজী রাজ্যে ভাগ হয়ে য়ায ৷ এই রাজ্যগুলোর অন্যতম ক্ষুদ্র রাজ্য শাসিত হচ্ছিল ওসমানলি পরিবারের হাতে ৷ যা চতুদর্শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্রমবর্ধমান হারে
শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৩২৬-এ ওসমানলি বা অটোমানরা বাসরাহ্ দখল
করে নেয় যা পরে তাদের রাজধানীতে পরিণত হয় । ১৩২৯-এ তারা ইয্ নিক ছিনিয়ে
নেয় এবং ১৩৭২-এ বাইযানটিয়ামের বৃহত্তর এলাকা দখল করে ফেলে । এডিরনে (এড্রিয়ানোপল) এ নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে বাইযানটাইন সম্রাটকে মিত্রে পরিণত করে । তখন প্রথম মুরাদ (১৩৬০-৮৯) শক্তিশালী পশ্চিমা মুসলিম শাসকে
পরিণত হন । কিন্তু ১৩৮৯-এ অটোমানরা মধ্য সার্বিয়ায় কসোভো যুদ্ধক্ষেত্রে
সার্বীয় সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ফেললে মুরাদ নিহত হয় এবং
সারবীয় যুবরাজ Hrevlbejan0vic Lazar (হ্রেলবেলিয়ানোভিচ লাযার )কে
বন্দীকরে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে সারবিয়ার স্বাধীনতার । অটোমানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত
থাকে ৷ তবে ১৪০২-এ আঙরায় টিমুরের কাছে বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও টিমুরের
মৃত্যুর পর তারা আবার শক্তি সংহত করে এবং ১৪৫৩-সালে দ্বিতীয় মেহমেদ(১৪৫১-৮১ ) খোদ কনসট্যান্টিনোপলই
অধিকার করে নিতে সক্ষম হন-নতুন প্রযুক্তি ও গান পাউডার অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ৷
মঙ্গোল-বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে নতুন এক শক্তির সন্ধান পেল তারা এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইসলামী জগত বিশ্বের বৃহত্তম পরাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ৷ নৌপথ
ও মহাসাগরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও অনেকটা মুসলিমদের দখলে চলে যায় সে সময় ।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি প্রধান ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে ;
ইরানে সাফাভীয় সাম্যাজ্য , ভারতে মোঘুল সাম্রাজ্য
এবং আনাতোলিয়া ,
সিরিয়া,উত্তর আফ্রিকা ও আরবে অটোমান সাম্যাজ্য । তখন উযবেকিস্তানে এক বিরাট মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল আর মরোক্কোয় গঠিত হয়েছিল শিয়া প্রধান্য বিশিষ্ট আরেকটি রাজ্য । ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলমানরাই আধিপত্য বিস্তার করে ৷ সুতরাং বিজয়ের একটা পর্ব ছিল
এটা । তবে তিনটি প্রধান সাম্রাজ্যই ইসলামের সাম্যবাদী ঐতিহ্যের দিক থেকে সরে এসে পরম রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলো ৷ আব্বাসীয় খলিফাহ্ গণ শরীয়াহ্ আইনের আওতাভূক্ত ছিলেন না কিন্তু নতুন সাম্রাজ্যগুলো শক্ত ইসলাম মুখী ছিল । সাফাভীয় ইরানে শিয়া মতবাদ
রাষ্ট্র-ধর্মে পরিণত হয় এবং মোঘুল নীতিমালায়ও ফালসাফাহ্
ও সুফিবাদের প্রবল প্রভাব ছিল প্রবল । অন্য দিকে অটোমান সাম্রাজ্য পরিচালিত
হয়েছে সম্পূর্ণও শরিয়াহ্ অনুযায়ী ।
শিয়া সাম্রাজ্যের
প্রতিষ্ঠা হলে সুন্নী ও শিয়াদের মাঝে এক
নতুন ও অনতিক্রম্য ভাঙন সৃষ্টি করে আর জন্ম দেয় এক অসহিষ্ঞুতা আর
আক্রমণাত্মক সাম্প্রদায়িকতাবাদের যা ইসলামী জগতে ছিল নজীরবিহীন ।
রাশানরা এই সময় (১৫৫২-৫৬) মুসলিম কাযান ও অস্ত্রাখানে আক্রমন চালিয়ে খ্রিষ্টধর্ম চাপিয়ে দেয় । ১৪৯২-সালে আমেরিকা আবিস্কার ও পর্তুগিজ বণিকদের সাগরে মুসলিম বাণিজ্য
ধ্বংস করার চেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামী জগতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি তখন ।
ইরানে শিয়া সাম্যাজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারেই মুসলিমরা বেশী আগ্রহ ছিল প্রাথমিক সাফাভীয়দের অসাধারণ সাফল্য সুন্নী প্রত্যাশার ওপর এক বিরাট আঘাত ছিল । কয়েক শতাব্দী
সময়কালের মধ্যে প্রথমবারের মত ইসলামী রাজ্যের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে
এক স্থিতিশীল ও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী শিয়া রাষ্ট্রের পত্তন ঘটেছিল ।
উপমহাদেশে মোঘুল সাম্রাজ্য ও ইসলাম :-
সুন্নী ইসলামের বিরুদ্ধে শাহ্ ইসমায়েলের শিয়া জিহাদের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা ভারতে নতুন মুসলাম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার
জন্যে অংশতঃ দায়ী মনে করা হয়ে থাকে । এর প্রতিষ্ঠাতা বাবুর
(মৃত্যু-১৫৩০) ইসমায়েলের মিত্র ছিলেন এবং
সাফাভীয় ও উযবেকদের যুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী হয়ে কাবুলে পালিয়ে
যান । সেখানে টিমুর লেঙ্ক প্রতিষ্ঠিত
রাজ্যের অবশিষ্টাংশের নিয়ন্ত্রণভার নিজ হাতে নিয়ে উত্তর ভারতে ক্ষমতার একটা ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম হন । তবে তাঁর রাজ্যটি বেশীদিন না টিকলেও ১৫৫৫সালে অবধি বাবুরের সক্ষম বংশধর হুমায়ুন সিংহাসন
দখল করেন । কিন্তু এর পরপরই তাঁর মৃত্যু হলে ১৫৬০-সালে তাঁর পুত্র
আকবর(১৫৪২-১৬০৫) সাবালকত্ব
লাভের আগ পর্যন্ত “মঙ্গোল” বা (“মোঘুল”) ক্ষমতা অটুট রাখেন এবং উত্তর ভারতে একটি সংহত রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় । আকবর তখন
অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক হিসাবে স্বীকৃতিও লাভ করেন । পরবর্তীতে হিন্দুস্তান, পাঞ্জাব, মালভা এবং দক্ষিণাত্য পর্যন্ত
মোঘুল সাম্যাজ্যের বিস্তার
ঘটান তিনি ।
মুসলিমরা যদিও সংখ্যালঘু
শাসক ছিল কিন্তু সেখানে কখনও ধর্মীয় একরূপতা চাপিয়ে না দিয়ে, বরং প্রত্যেক হিন্দুবর্গের নিজস্ব ধর্মীয়
আচার-অনুষ্ঠান ,বুদ্ধ, জ্যাকবাইট, ইহুদি, জৈন, ক্রিশ্চান, যরোস্ট্রিয়, সুন্নী মুসলিম এবং ইসমায়েলিরা কোনো রকম বাধা-বিপত্তি
ছাড়াই উপাসনা করার অনুমতি পেয়ে আসছিল । চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে সকল বর্গের হিন্দু , এবং
এমনকি কিছু সংখ্যক মুসলিমও একেশ্বরবাদের এক আধ্যাত্মবাদী ধ্যানধর্মী ধরণ প্রতিষ্ঠার লক্ষে একত্রিত হয় এবং সবরকম সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে ত্যাগ করে । এই সময় গুরু
নানক(মৃত্যু-১৪৬৯) প্রতিষ্ঠিত শিখ ধর্ম এইসব গোষ্ঠী হতে গড়ে উঠেছিল এবং তখন হিন্দুধর্ম এবং ইসলামের ঐক্য ও সংহতির ওপর ও জোর দেয়া হয়েছে । আকবর এই ঐতিহ্যকে আরো জোরদার করে তোলেন । তিনি জিম্মিদের ক্ষেত্রে শরিয়াহ্ কর্তৃক জারি করা জিযিয়াহ্
কর বাতিল করে দেন ৷ এক পর্যায়ে হিন্দু অনুভূতিকে আঘাত না করার জন্যে নিরামিষ-ভোজীতে পরিণত হয়ে শিকারে পর্যন্ত ইস্তফা দেন তিনি । আকবর সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করতেন । হিন্দুদের জন্যে মন্দির নির্মান করেছেন তিনি ।
১৫৭৫- সালে তিনি এক “ উপাসনা গৃহ” স্থাপন করেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ আলোচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হতে পারতেন । “স্বর্গীয় একেশ্বরবাদের” (devine monotheism বা তাওহীদ-ই-ইলাহী ) প্রতি নিবেদিত নিজস্ব মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি ৷ যা কোরানের একজন মাত্র ঈশ্বর সঠিকভাবে পরিচালিত যেকোনো ধর্মে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন ৷ এই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর এই মতবাদ । যদিও নিঃসন্দেহে এটা কোরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল ৷ কিন্তু আকবরের বহুত্ববাদ (pluralism) কোনো কোনো শরিয়াহ্ গোষ্ঠীর মাঝে গড়ে ওঠা কট্রর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের একেবরে বিপরীত এবং বর্তমান শিয়া/সুন্নী বিরোধের গোঁড়ামির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরবর্তী ছিল ইহা ।
১৫৭৫- সালে তিনি এক “ উপাসনা গৃহ” স্থাপন করেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ আলোচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হতে পারতেন । “স্বর্গীয় একেশ্বরবাদের” (devine monotheism বা তাওহীদ-ই-ইলাহী ) প্রতি নিবেদিত নিজস্ব মতবাদও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি ৷ যা কোরানের একজন মাত্র ঈশ্বর সঠিকভাবে পরিচালিত যেকোনো ধর্মে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন ৷ এই বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাঁর এই মতবাদ । যদিও নিঃসন্দেহে এটা কোরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল ৷ কিন্তু আকবরের বহুত্ববাদ (pluralism) কোনো কোনো শরিয়াহ্ গোষ্ঠীর মাঝে গড়ে ওঠা কট্রর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের একেবরে বিপরীত এবং বর্তমান শিয়া/সুন্নী বিরোধের গোঁড়ামির তুলনায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরবর্তী ছিল ইহা ।
আকবর কখনওই শরিয়াহ্ র ব্যাপারে আগহ ছিলেন না । তাঁর নিজস্ব ঝোঁক ছিল সুফিবাদ ও ফালসাফাহ্ র দিকে এ দুটোই ঝুকে ছিল এক বিশ্বজনীন দর্শনের প্রতি । আকবরের জীবনীকার
ঐতিহাসিক আবদুল ফযল আল্লামি (১৫৫১-১৬০২) তাঁকে একজন আদর্শ দার্শনিক-রাজা হিসাবে দেখেছেন , এবং একজন আদর্শ মানুষ (perfect man) হিসাবে
অভিহিত করেছেন । অকবর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে ছিলেন ।
সুফি
আহমাদ সিরহিন্দি (মৃত্যু-১৬২৫) ঘোষণা করেন যে , আকবর
নন, বরং তিনিই যুগের আদর্শ মানব(perfect man) আর একমাত্র তখনই ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া যাবে মানুষ যখন নিবেদিতভাবে
শরিয়াহ্ র আইন মেনে চলবে ৷ তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সাম্প্রদায়িকতা
প্রতি সমর্থন জুগিয়েছিল ।
অকবরের পৌত্র শাহ্ জাহান,
যিনি ১৬২৭ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করেছেন, তিনি
আকবরের নীতি বজায় রাখেন । তাঁর তাজমহল হিন্দুদের স্থাপত্য কৌশলের সঙ্গে মুসলিমদের স্থাপত্য কলার মিশ্রণের পিতামহের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছেন এবং রাজদরবারে হিন্দু কবিদের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম বৈজ্ঞানিক রচনাবলী সংস্কৃত ভাষায় অনূদিত করার ও ব্যবস্থা করেছিলেন । তাঁর ধর্মানুরাগ সুফিবাদের তুলনায় অনেক বেশী শরিয়াহ্ ভিত্তিক ছিল ।
পরবর্তী শাসক আউরেঙজিবের শাসন পূর্ববর্তীদের বিপরিত ছিল । আউরেঙজিবের
শাসনামলে(১৬৫৮-১৭০৭) অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে ।তাঁর বিশ্বাস ছিল মুসলিম
সমাজের বৃহত্তর শৃঙ্খলার মাঝে সমাধান নিহিত ৷ মুসলিম “ভিন্ন
মতাবলম্বী”
দের পাশাপাশি অন্য ধর্মবলম্বীদের
প্রতিও ভয়ঙ্কর ঘৃণাবোধের মাঝে তাঁর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি
প্রকাশিত হয়েছে । সিরহিন্দির মত মুসলিমের কাছ থেকে ও তাঁর সাম্প্রদায়িক নীতির পক্ষে সমর্থন পান তিনি । ভারতে হুসেইনের সম্মানে
শিয়াদের উৎসব উদযাপন নিষিদ্ধ ও ঘোষিত হয় এই সময়ে ৷ তখন আইন করে সুরাপান নিষিদ্ধ করা হয় । হিন্দু অনুষ্ঠানাদিতে সম্যাটের অংশগ্রহণের
হার হ্রাস করা হয় ।জিযিয়াহ্ কর পুনর্বহাল করা হয় এবং হিন্দু বণিকদের
ওপর দ্বিগুণ হয়ে যায় করের হার । সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে হিন্দুদের মন্দির
ধ্বংস করা হয় । এই অবস্থায় হিন্দুগোত্রপ্রধান আর শিখদের নেতৃত্বে মারাত্মক
বিদ্রোহ পরিচালিত হয় এবং ,শিখরা পাঞ্জাবে নিজস্ব স্বদেশের জন্যে আন্দোলন শুরু করে ।
আউরেঙজিবের পরলোকগমনের পর সাম্রাজ্য টালমতাল অবস্থায় পড়ে যায় এবং আর কখনও সামলে উঠতে
পারেনি । সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছিল এবং স্থানীয় মুসলিম কর্মকর্তারা স্বায়ত্তশাসিত একক হিসাবে যার যার এলাকা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে ফেলে তখন ।
অবশ্য
১৭৩৯ পর্যন্ত মোঘুলরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে
রাজদরবারে হিন্দু ও মুসলিমদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ৷ এবং তারা ইউরোপ থেকে আসা বইপত্র একসঙ্গে পাঠ ও অনুবাদ আরম্ভ করে । মুসলিমরা তখন কেবল হিন্দু এবং শিখদের ছাড়াও ব্রিটিশদের শক্তিশালী বাণিজ্যিক অস্তিত্বের ও মোকাবিলা করতে হচ্ছিল । এই পর্যায়ে ভারতে মুসলিমের জীবনে এক নয়া নিরাপত্তাহীনতার বোধ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় । প্রশ্ন দেখা দেয় মুসলিমরা কী তাদের সাংস্কৃতিক
ও ধর্মীয় সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে ? না ইসলামের জন্মভূমি
মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে আলাদা ভিন্ দেশী সংস্কৃতির তোড়ে ভেসে যাবে ? তবে
কী শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ চ্যুত হয়েছে তারা ?
এই সময়ে সুফি চিন্তাবিদ শাহ্ ওয়ালি-উল্লাহ্ (১৭০৩-৬২)
বলেন, এর সমাধান নিহিত রয়েছে সিরহিন্দির প্রস্তাবনায় এবং তাঁর মতামত
ভারতের মুসলিমদের ওপর একেবারে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল । নতুন সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে তিনি বলেন যে মুসলমানদের অবশ্যই গোত্রীয় ভেদাভেদ ভূলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রণাঙ্গনে দাঁড়াতে হবে । উপমহাদেশের বিশেষ পরিস্থিতির দাবী মিটাতে শরিয়াহ্ কে অবশ্যই পরিমার্জনা করতে হবে এবং হিন্দুত্বকরণ প্রতিরোধের উপায়ে পরিণত করতে হবে একে । তাই সামরিক ও রাজনৈতিক প্রধান্য বজায় রাখা মুসলমানদের জন্যে অত্যাবশ্যক ।তাঁর চিন্তাধারা ও কার্যক্রম মুসলিমদের চিন্তা জগতে যে একটা
আত্মরক্ষামূলক চাপ যোগ করেছিল তা আজও আধুনিক যুগের মুসলিমদের ধার্মিকতার ক্ষেত্রে একটা বৈশিষ্ট্যতা রয়ে
গেছে ।
সূত্র;-ইসলাম-
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ক্যারেন আর্মস্ট্রং, অনুবদ শওকত হোসেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন