নবীজী(সঃ) এর ইসলাম , খলিফাহ্ দের শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
অটোমান
সাম্রাজ্য ও মুসলিমদের অবস্থান ;
১৪৫৩-তে অটোমানরা কনস্ট্যান্টিপোল (বর্তমান-ইসতাম্বুল )
অধিকার করে একটা সাম্যাজ্য প্রতিষ্ঠার অবস্থানে পৌছার পর আস্তে আস্তে সাম্যাজ্যটি গড়ে তুলে এবং অন্যান্য সাম্যাজ্যের তুলনায় সর্বাধিক সাফল্যমণ্ডিত এবং স্থায়ী হিসাবে এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় । প্রথমে অটোমান গোত্রপতিরা
গাজী
শাসকদের মত থাকলেও ইস্তাম্বুলে সুলতানগণ বাইযানটাইনদের আদলে এক চরম রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন । মেহমেদ, দ্য কনকোয়েরার-এর ক্ষমতার ভিত্তি ছিল
বলকান অভিজাত গোষ্ঠির সমর্থন-যাদের অনেকেই তখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল ৷ আর নিজেদের তারা ইসলামের শক্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে নিবেদিত এক সীমান্ত রাজ্যের কর্মীদল হিসাবে পরিচিত করেছে । পশ্চিমে ছিল ক্রিশ্চান জগত আর পুবে ছিল শিয়া সাফাভীয়রা । তারা সাফাভীয়দের মত তীব্র সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে এবং তখন অটোমান সাম্যাজ্যে বসবাসরত শিয়াদের বিরুদ্ধে ও গণহত্যা র ঘটনা ঘটে তাদের সহায়তায় ও মদদে ৷
কিন্তু সাফাভীয়দের বিরুদ্ধে প্রথম সেলিমের(১৪৬৭-১৫২০) অভিযান ইরানি
অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয় ৷ ফলে সমগ্র সিরিয়া এবং মিসর অটোমান শাসনের আওতায় চলে আসে ৷ তখন আরব এবং উত্তর আফ্রিকাও ঐ সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত হয়ে যায় ৷ আর পশ্চিমে অটোমানরা ইউরোপ অধিকার অব্যাহত রেখে, ১৫৩০-সালে ভিয়েনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় । অটোমান সুলতানগণ অসাধারণ আমলাতান্ত্রিক দক্ষার সঙ্গে এক সুবিশাল সাম্যাজ্য শাসন করেছেন । সরকার কেবল এমন একটা কাঠামোর ব্যবস্থা করেছে যার ফলে বিভিন্ন গ্রুপ , যেমন ক্রিশ্চান, ইহুদি , আরব , তুর্কী , বারবার বণিক, উলেমা , তরিকাহ্ আর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী-সবাইকে শান্তিময় পরিবেশে
বসবাসে সক্ষম করে তুলেছিল । প্রত্যেকে যার যার অবদান রেখে নিজ নিজ বিশ্বাস আর
রীতি পালন করতে পেরেছে । একজন করে গভর্নর (পাশা) কর্তৃক শাসিত দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল সাম্রাজ্যটি ৷ আর প্রাদেশিক গভর্নর সরাসরি ইস্তাম্বুলের কাছে জবাবদিহি করতেন ।
সুলেইমান আল-কানুনির ( “ দ্য
ল-গিভার” )
(১৫২০-৬৬) এর শাসনামলে সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায় । পাশ্চাত্যে যিনি সুলেইমান দ্য
ম্যাগনিফিশেন্ট নামে খ্যাত হয়েছিলেন । তখন ইস্তাম্বুল এক সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর সূচনা প্রত্যক্ষ
করেছিল ৷ ফলে গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে ভিন্ন স্টাইলে মসজিদগুলোর
নির্মান সম্ভব হয়ে ছিল , স্থাপতি সিনান পাশার(মৃত্যু-১৫৭৮) স্থাপত্য কর্ম
অনুসারে । ১৫৭৯ -তে একটা মানমন্দির ও
নির্মিত হয় ৷ তখন ইউরোপের বিভিন্ন সাফল্য সত্ত্বেও অটোমান সাম্রাজ্য
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি ছিল ।
অন্য দু’টি
সাম্যাজ্যের মত অটোমানরাও তাদের রাজ্যকে একটা বিশেষ ইসলামী পরিচয় দিয়েছিল এবং সুলেইমানের অধীনে অতীতের যেকোনো
মুসলিম রাষ্ট্রের তুলনায় শরিয়াহ্ আইন অনেক বেশী মর্যাদার
আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল । আর শরিয়াহ্ আইন সকল মুসলিমের জন্যে সরকারি আইনে পরিণত করা হয় । কাজিগণ আদালতে ন্যায় বিচার
নিশ্চিত করতেন আর তাদের পরামর্শক(মুফতি) যারা তারা আইনের ব্যাখ্যা দিতেন ৷ তখন মাদ্রাসার শিক্ষকগণকে ও সরকারি কর্মিবাহিনীতে পরিণত করা হয় । সে সময়ে উলেমাদেরকেও রাষ্ট্রীয় মার্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় ৷
নির্দিষ্ট প্রদেশের স্থানীয় অধিবাসী উলেমাগণ তখন স্বদেশ জনতা এবং তুর্কি
গভর্নরের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছেন । উলেমাগণ অনুভব করতে পেরেছিলেন যে , এই সাম্রাজ্য অটোমানদের রাষ্ট্রীয় নীতি এবং বিবেকের এক বিরল সমন্বয় অর্জন করেছে ৷
তবে এর নেতিবাচক দিকও ছিল ৷ উলেমাদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে শেষ অবধি তাদের কণ্ঠরোধ করে অপমানিত এবং অসম্মানও করেছে । শরিয়াহ্ র সূচনা হয়েছিল প্রতিবাদ আন্দোলন হিসাবে ৷ কিন্তু অটোমান ব্যবস্থার অধীনে এক পর্যায়ে তা অনিবার্যভাবে হারিয়ে যায় এবং অটোমানদের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে উলেমাগণ সহ কাজিগণও চলে যেতে বাধ্য করা হয় ৷ ফলে অটোমানদের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করে শরিয়াহ্ কে চরম রাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় । যা (শরিয়াহ্) মূলত তার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই সূচনা ঘটেছিল প্রথম দিকে ।
তবে এর নেতিবাচক দিকও ছিল ৷ উলেমাদের ক্ষমতায়নের পরিবর্তে শেষ অবধি তাদের কণ্ঠরোধ করে অপমানিত এবং অসম্মানও করেছে । শরিয়াহ্ র সূচনা হয়েছিল প্রতিবাদ আন্দোলন হিসাবে ৷ কিন্তু অটোমান ব্যবস্থার অধীনে এক পর্যায়ে তা অনিবার্যভাবে হারিয়ে যায় এবং অটোমানদের নিয়ন্ত্রনের মধ্যে উলেমাগণ সহ কাজিগণও চলে যেতে বাধ্য করা হয় ৷ ফলে অটোমানদের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করে শরিয়াহ্ কে চরম রাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় । যা (শরিয়াহ্) মূলত তার বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যেই সূচনা ঘটেছিল প্রথম দিকে ।
ইরানে শিয়া উলেমাগণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারায় জনগণের সমর্থন লাভ করেন ৷ তখন অনেকেই পরবর্তীকালে নিবেদিত প্রাণ সংস্কারকে পরিণত হয়ে অত্যাচারী শাহ্ দের বিরুদ্ধে জনগণকে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়ে উঠেন । কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যে উলেমাগণ রাজনৈতিক সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় হীনবল হয়ে রক্ষণশীল হয়ে পড়েন ৷ ফলে তারাও যে কোনো পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে থাকেন । ফলে মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যক্রম
আরো
সংকীর্ণ রূপ নেয় । ফালসাফাহ্ র পাঠ বাদ দিয়ে জোর
দেয়া হয় ফিকাহ্ র প্রতি । এবং অটোমান সাম্যাজ্যের ইসলামী অবস্থান সাম্প্রদায়িক ও গোত্রবাদী রূপ নেয় । রাজদরবার যখন ইউরোপ থেকে আগত
নতুন নতুন ধ্যান-ধারণাকে স্বাগত জানাচ্ছে তখন
মাদ্রাসাগুলো হয়ে দাঁড়াল ইউরোপীয় অবিশ্বাসীদের (তাদের ধারণা) কাছ
থেকে নেয়া যেকোনো পরীক্ষা নিরীক্ষার বিরোধীতার প্রধান কেন্দ্রস্থল ৷ উলেমাগণ তখন ইসলামী বই পুস্তকের মুদ্রণের ও বিরোধিতা
করেন তাই তারা সাম্রাজ্যের ক্রিশ্চান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে দুরে সরে পড়েন । এই পরিস্থিতিতে উলেমাগণ পুরনো
ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের অধুনিকতার ধারণা বাদ দিয়ে দেন ৷ যার জন্যে মুসলিমদের পথনির্দেশের
জন্যে
অন্যত্র চোখ ফেরাতে হয় তাদের ।সুলতানগণের বিলাসী জীবনযাপন এবং দুর্নীতি
আর
কর ফাঁকি ইত্যাদির জন্যে অর্থনীতিতে এক দারুন দুরবস্থার সৃষ্টি হয় ৷ তাই অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ সাম্রাজ্যের পতন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে , বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে । এই পরিস্থিতির সুযোগে স্থানীয় সংস্কারকগণ তখন ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পান ।
আরবীয় পেনিনসূলায় মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল আল-ওয়াহ্ হাব (১৭০৩-৯২ )ধীরে ধীরে ইস্তাম্বুল
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্য আরব ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে এক আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । ইবনে তাঈমিয়াহ্ র ঐতিহ্য অনুযায়ী টিপিক্যাল সংস্কারক ছিলেন তিনি । তাঁর বিশ্বাস ছিল কোরান এবং সুন্নাহ্ য় মৌলবাদীধারায় প্রত্যাবর্তন ক’রে এবং পরবর্তী কালের সকল সংযোজনের জঙ্গী প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে (যেখানে মধ্যযুগীয় ফিকাহ্, অতীন্দ্রিয়বাদ, ফালসাফাহ্
অন্তর্ভূক্ত যা অধিকাংশ মুসলিম যে গুলোকে স্বাভাবিকই মনে করত ) সকল
চলমান সঙ্কট সর্বোত্তম উপায়ে মোকাবিলা করা সম্ভব ।
অটোমান সুলতানগণ প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য মেনে না নেওয়ায় তিনি তাদেরকে ধর্মত্যাগী ঘোষণা দেন এবং এরজন্যে তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য বলে দাবী করেন । তিনি সপ্তম শতাব্দীর প্রথম উম্মাহ্ র আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নিখাদ বিশ্বাসের এক ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পান তার অনুসারিদের মধ্যে । তাঁর আগ্রাসী কৌশল সমূহের কিছু কিছু বিংশ শতাব্দীতেও আরো ব্যাপক ভাবে এবং কিছু পরিবর্তন সহকারে বর্তমানে মৌলবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে । ওয়াহ্ হাবিবাদ ইসলামের একটি রূপ যা আজও সৌদি আরবে অনুসৃত হচ্ছে যা ঐশী গ্রন্থের কঠোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং প্রথম দিকের ইসলামী ট্র্যাডিশনভিত্তিক এক পিউরিটান ধর্ম ।
অটোমান সুলতানগণ প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য মেনে না নেওয়ায় তিনি তাদেরকে ধর্মত্যাগী ঘোষণা দেন এবং এরজন্যে তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য বলে দাবী করেন । তিনি সপ্তম শতাব্দীর প্রথম উম্মাহ্ র আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নিখাদ বিশ্বাসের এক ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পান তার অনুসারিদের মধ্যে । তাঁর আগ্রাসী কৌশল সমূহের কিছু কিছু বিংশ শতাব্দীতেও আরো ব্যাপক ভাবে এবং কিছু পরিবর্তন সহকারে বর্তমানে মৌলবাদীদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে । ওয়াহ্ হাবিবাদ ইসলামের একটি রূপ যা আজও সৌদি আরবে অনুসৃত হচ্ছে যা ঐশী গ্রন্থের কঠোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা এবং প্রথম দিকের ইসলামী ট্র্যাডিশনভিত্তিক এক পিউরিটান ধর্ম ।
মরোক্কোয় সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবনে ইদরিস(১৭৮০-১৮৩৬) ভিন্নভাবে
সমস্যার মোকাবিলা করতে চেয়েছেন । তাঁর বিশ্বাস ছিল জনগণকে শিক্ষিত করার মাধ্যমে আরো ভাল মুসলিমে পরিণত করা সম্ভব হলেই এর সমাধান পাওয়া যাবে । তাঁর দৃষ্টিতে উলেমাগণ তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তারা মাদ্রাসাসমূহে অবরূদ্ধ করে
রেখেছেন নিজেদের আর কেবল ফিকাহ্’ র সূক্ষ্ম বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন ৷ ফলে বাধ্যহয়ে জনগণ নিজস্ব পথ খুজে নিতে আপন বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী চলার প্রয়াস পেয়েছেন ।
অন্য আর এক সানুসিয়াইয়াহ্ নব্য সুফি-মুহাম্মদ
ইবনে আলী আল-সানুসি (মৃত্যু-১৮৩২)সানুসিয়াইয়াহ্ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ৷ যা আজও লিবিয়ায় ইসলামের প্রভাবশালী রূপ হিসাবে টিকে আছে । নব্য-সুফিগণের নতুন পশ্চিমের আধুনিক ধারা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ বা
জ্ঞান ছিল না ৷ কিন্তু তারা তাঁদের নিজস্ব অতীন্দ্রিয়বাদী ঐতিহ্যের মাধ্যমেই ইউরোপীয় আলোকনপর্বে
(Enlightenment)
আবিস্কৃত ধারণার অনুরূপ ধারণা গড়ে তুলেছিল । তাঁরা বলেছে-উলেমাদের উপর নির্ভর না করে মানুষকে তাদের নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হবে ।
ইবনে ইদরিস এমনকি পয়গম্বর বাদে আর সমস্ত মুসলিম চিন্তাবিদের কর্তৃত্ব প্রত্যাখানের কথাও বলেছেন । তার অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তি হচ্ছেন ব্যক্তি পয়গম্বর ৷ মানুষকে তিনি দুরবর্তী ঈশ্বরের আকাঙ্খায় না থেকে নিজেদের আদর্শ মানব সন্তান হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছেন যার অনেকটা ভক্তিমূলক মানবতাবাদের আদলে । সুতরাং, নতুন ইউরোপের বৈশিষ্ট্য প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে মুসলিমদের নিরেট কোনো যুক্তি ছিল না । মুসলিমদের সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তীব্র আবেগ সহ এক সাম্যবাদী রাজনীতি আর বাক স্বাধীনতা এবং তাওহীদের আদর্শ সত্ত্বেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ সচেতন মুসলিম মানতে বাধ্য হন যে ইউরোপ তাদের ছাড়িয়ে গেছে ।
ইবনে ইদরিস এমনকি পয়গম্বর বাদে আর সমস্ত মুসলিম চিন্তাবিদের কর্তৃত্ব প্রত্যাখানের কথাও বলেছেন । তার অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তি হচ্ছেন ব্যক্তি পয়গম্বর ৷ মানুষকে তিনি দুরবর্তী ঈশ্বরের আকাঙ্খায় না থেকে নিজেদের আদর্শ মানব সন্তান হিসাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছেন যার অনেকটা ভক্তিমূলক মানবতাবাদের আদলে । সুতরাং, নতুন ইউরোপের বৈশিষ্ট্য প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে মুসলিমদের নিরেট কোনো যুক্তি ছিল না । মুসলিমদের সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি তীব্র আবেগ সহ এক সাম্যবাদী রাজনীতি আর বাক স্বাধীনতা এবং তাওহীদের আদর্শ সত্ত্বেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অধিকাংশ সচেতন মুসলিম মানতে বাধ্য হন যে ইউরোপ তাদের ছাড়িয়ে গেছে ।
ষোড়শ শতাব্দীতে সুলেইমান ইউরোপীয় বণিকদের কূটনৈতিক নিরাপত্তা (Immunity) দান
করেন । কিন্তু
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ক্যাপিটুলেশনগুলো অটোমানদের
সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং ১৭৪০ -সালের পরে আর তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রইল না । এই সময়
থেকে
অটোমান সাম্রাজ্যের অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায় ৷ ব্যবসা-বাণিজ্যের
আরো অবনতির সঙ্গে সঙ্গে আরবীয় প্রদেশগুলোর বেদুঈন গোত্রগুলো
ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় আর স্থানীয় পাশাগণ ও ইস্তম্বুলের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে জনগণকে শোষণ করতে আরম্ভ
করেন । অন্যদিকে পাশ্চাত্য
একের পর এক জয় লাভ করে যাচ্ছিল ।
মুসলিমরা তখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ইউরোপ সম্পর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজের বিকাশ ঘটিয়েছে ৷ তাই এখন ইউরোপ এক কালের অপ্রতিরোধ্য ইসলামী বিশ্বকে অতিক্রম করে গিয়েছে আর তারা অচিরেই বিশ্ব ক্ষমতার অধিকারী
হয়ে উঠবে ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যই পতনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল ।যেকোনো কৃষিনির্ভর রাজনীতির
আয়ুস্কাল সীমাবদ্ধ থাকে ৷ তাই এই মুসলিম রাজ্যগুলো যা
কৃষিভিত্তিক আদর্শের চূড়ান্ত বিকাশের প্রতিভূ ছিল একসময় যা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অযোগ্যতা বা অর্দৃষ্টবাদের ফলে নয় , স্রেফ ঐতিহাসিক নিয়মেই স্বাভাবিক এবং অনিবার্য সমাপ্তির মূখোমূখি হতে হয়েছে সাম্রাজ্যগুলোর । যা প্রাক-আধুনিক
যুগের পশ্চিমা ও ক্রিশ্চান সাম্রাজ্যের বেলায় ও এক পর্যায়ে তাই ঘটে ছিল । এই পর্যায়ে
মুসলিমদের দুর্বলতা আর পাশ্চাত্যের ভিন্ন ধরণের সভ্যতা সমসাময়িক হয়ে দাঁড়ায় এবং এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা অনেক বেশী দূরূহ হয়ে উঠে মুসলিমদের জন্যে ৷ যার প্রভাব আজও চলছে মুসলিম বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ৷
,
প্রতিরুদ্ধ ইসলাম এবং পশ্চিমের আবির্ভাব (১৭৫০-২০০০
) ;-(১)
পাশ্চাত্যের উথ্থান বিশ্বের ইতিহাসে নজীর বিহীন । ষোড়শ শতাব্দীর দিকে এক ব্যাপক পরিবর্তনের
ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল ৷ এই পরিবর্তনের ফলে এখন পাশ্চাত্য অবশিষ্ট বিশ্বকে আপন প্রভাব বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসার যোগ্য করে তুলেছে । সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী কালে আরব মুসলিমদের প্রধান পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে এর মিল রয়েছে । কিন্তু মুসলিমরা বিশ্ব শাসনের
অধিকার অর্জন করতে পারেনি বা নতুন ধরনের সভ্যতারও
বিকাশ ঘটাতে পারেনি , যেমনটি ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল ।
অবশ্য ইউরোপকে এই জন্যে প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজের আপাদমস্তক পরিবর্তন করতে হয়েছে ৷ এরজন্যে তাদরকে সামাজিক,
অর্থনৈতিক, শিক্ষা, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক
এবং মননশীলতার গোটা কাঠামোর পুননির্মাণের প্রয়োজন হয়েছে ৷ আর
এই পরিবর্তন অর্জনের জন্যে পাশ্চাত্যের তিনশো বছরেরও বেশী সময় লেগেছে । আর মুসলিম বিশ্ব এই সময়ে তা শুধু প্রতক্ষ্য করেছে এবং এর অনুপ্রবেশ মুসলিম বিশ্বে নানা পন্থায় ঠেকিয়ে রেখেছে ৷
ইউরোপ এবং আমেরিকান কলোনিগুলোর নতুন সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তিও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ৷ যার ফলে সমাজ আর কৃষিভিত্তিক সমাজের সংস্কৃতির সীমাবদ্ধতার
ফাঁদে
আটকে যাই নাই ৷ কারণ তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত
রাজনৈতিক ,সামাজিক ,এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রীতিনীতির ব্যাপক অদলবদল করা সম্পূর্ণ করা হয় উল্লেখিত সময়ে । ফলে
জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক এবং সেক্যুলার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো । ষোড়শ শতাব্দীর দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞান , নৌযাত্রা
, কৃষিক্ষেত্রে আর শিল্পজগতে নতুন নতুন আবিস্কার আর
উদ্ভাবন ঘটে যা থেকে এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব অর্জন করে ইউরোপীয়রা । আর এগুলোর সম্বিলিত ফলাফল ছিল আরো মারাত্মক ।১৬০০ সাল নাগাদ উদ্ভাবনের মাত্রা এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে তখন প্রগতিকে মনে হয়েছে অপ্রতিরোধ্য ; বিশ্বকে অপরিবর্তনীয় আইনের
অধীন হিসাবে না দেখে ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করল যে তারা প্রকৃতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম ৷ এবং সমাজের এই
প্রযুক্তিকরণের ফলেই জন্ম নেয় উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব ।
ইউরোপে তখন
উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষে এবং মানবসম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ধর্মীয়
মতপার্থক্য এবং আধ্যাত্মিক আদর্শসমূহকে তাঁদের গোষ্ঠী-নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে দিয়ে গণতন্ত্র , বহুত্ববদ
, সহিষ্ণুতা , মানবাধিকার আর সেক্যুলারিজমের আদর্শগুলোর বিকাশের
মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহকে নয়া
যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক নিয়মানুসারে সংগঠিত করে । যার প্রভাব ইসলামী জগতের ওপর ছিল মারাত্মক । এর প্রভাবে ইসলামী সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় এবং ক্রমবর্ধমান হারে পরস্পরকে বুঝতে না পেরে নিজদেরকে আধুনিকীকরণের বাইরে রেখে দেয় ।
কিন্তু আধুনিকীকরণের
এই প্রক্রিয়ায় ইসলামী বিশ্ব প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে । বিশ্ব সভ্যতার অন্যতম
নেতৃত্বের আসন লাভ করার পরিবর্তে ইসলামী জগত দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল । আর পশ্চিমারা মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা, অদক্ষতা,অদৃষ্টবাদ
আর দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করে হতবাক হয়ে , তারা
ধরে নিয়েছে যে ইউরোপীয় সংস্কৃতি সবসময়ই প্রাগ্রসর ছিল এবং তারা উত্তরাধিকারসূত্রে
এবং জাতিগতভাবে “
ওরিয়েন্টালদের” তুলনায় উন্নত জাতি ।
কিন্তু মুসলিমদের প্রতিক্রিয়াও অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক নয় ; কারণ
ইসলামী বিশ্ব এমন সুবিস্তৃত আর কৌশলগতভাবে বিস্তৃত ছিল যে, এবারই
প্রথম এক সমন্বিত ও পদ্ধতিগত উপায়ে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত
, আরব , মালয় এবং আফ্রিকার উল্লেখযোগ্য অংশ উপনিবেশকরণের প্রক্রিয়ার
অধীনে পড়েছিল । এসব অঞ্চলের মুসলিমরা এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামান্য মাত্র সাড়া না দিয়ে
দৃষ্টান্তমৃলক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ।
ইসলামী বিশ্বের ওপর ইউরোপীয় আগ্রাসন সবক্ষেত্রে এক রকম ছিল না ; কিন্তু
সেটা ছিল সম্পূর্ণ এবং কার্যকর । সূচনা হয়েছিল মোঘুল ভারতে । অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্রিটিশ বণিকের দল রেঙ্গুনে শেকড় গাড়ে এবং সেই সময় আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া যখন প্রাথমিক অবস্থায় ব্রিটিশরা তখন হিন্দু ও মুসলিম
বণিকদের সমান পর্যায়েই বসবাস করছে । কিন্তু ব্রিটিশদের এই
কার্যকলাপ “
বাংলার লুণ্ঠন প্রক্রিয়া” হিসাবে
পরিচিতি পায় ৷ কারণ এর ফলে স্থানীয় শিল্পক্ষেত্রগুলো স্থায়ীভাবে
ক্ষত্রিগ্রস্ত হয় আর কৃষিখাতকে এমনভাবে বদলে দেয় যে , বাঙালীরা তখন আর নিজেদের জন্যে শস্য উৎপাদন না করতে পেরে ৷ উৎপাদন
করতে হয়েছে শিল্পায়িত পশ্চিমা বাজারের কাঁচামাল ফলে বিশ্বের অর্থনীতিতে বাংলার অবস্থান দ্বিতীয় কাতারে নেমে যায় ।
অর্থনৈতিকভাবে
বাংলার লুণ্ঠন একধরণের রাজনৈতিক প্রধান্য ড়েকে আনে । ১৭৯৮ এবং ১৮১৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে চুক্তি বা সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে সিন্দু উপত্যকা বাদে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ আর ১৮৪৩ এবং ১৮৪৯ এর মধ্যবর্তী সময়ে পদানত হয় তা । ইতিমধ্যে ফ্রেঞ্চরা নিজস্ব সাম্রাজ্য স্থাপনের
চেষ্টা করে এক পর্যায়ে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । এই সময় ইরান কৌশলগতভাবে
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে
ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের কাছে ৷ তবে তেল আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কেউই ইরানকে পুরোপুরি কলোনি প্রটেক্টরেট না বানায়ে দুটো শক্তিই নয়া কাজার রাজবংশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল যাতে শাহ্ গণ অন্তত যেকোনো
একজনের সমর্থন ছাড়া পাল্টা আক্রমণ হানার সাহস না পান । বাংলার মত ব্রিটেন এবং রাশিয়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রযুক্তিরই শুধু বিকাশ ঘটিয়েছিল ইরানে ।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো একের পর এক ইসলামী দেশকে উপনিবেশে পরিণত করে । ১৮৩০-সালে ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে আর এর নয় বছর পর এডেন দখল করে ব্রিটেন । ১৮৮১- সালে অধিকূত হয় টিউনিসিয়া , ১৮৮২ তে হয় মিশর , ১৮৮৯ তে সুদান এবং ১৯১২ তে
লিবিয়া ও মরোক্কো । ১৯১৫ তে স্বাক্ষরিত সাইকল-পিকো (Sykes-picot )চুক্তি
অনুযায়ী মুমূর্ষু অটোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে
জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেছিল এরা ) বিজয়ের প্রত্যাশায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের
মধ্যে ভাগ হয়ে যায় । যুদ্ধের পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স যথারীতি সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন , ইরাক
ও ট্রান্সজর্ডানে প্রটেক্টরেট এবং ম্যান্ডেট স্থাপন করে , অটোমানদেরকে
দেয়া
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকরে ।
এর ফলশ্রুতিতে অটোমান মূলভূমিতে মুস্তাফা কেমাল (Mustafa Kemal ) ,যিনি আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) নামে খ্যাত, ইউরোপীয়দের প্রতিরোধে সক্ষম
হন এবং স্বাধীন টার্কি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন । তখন বলকান এলাকা , রাশিয়া
এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনাধীনে চলে আসে । ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ যখন ভারত থেকে
প্রত্যাহৃত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশ হিন্দু ভারত ও মুসলিম পাকিস্তানের
মাঝে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৪৮-এ প্যালেস্টাইনের আরবরা যায়নিস্টদের কাছে তাদের আবাসভূমি হারিয়ে বসে । যায়নিস্টরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা করে ।.
প্রতিরুদ্ধ ইসলাম এবং পশ্চিমের আবির্ভাব (১৭৫০-২০০০ ) (২)
ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলোর হাতে মুসলিম
বিশ্বের অপমানিত হবার জ্বলজ্যান্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো সত্ত্বেও গোড়ার দিকে
মুসলিমদের কেউ কেউ পাশ্চাত্যের প্রতি বেশ দুর্বল ছিল ।এদের মধ্যে ইরানি বুদ্ধিজীবী মুলকুম খান (১৮৩৩-১৯০৮) এবং আকা খান কিরমানি (১৮৩৫-৯৬) ইরানিদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ
আধুনিক সেক্যুলার রীতিনীতি বেছে নিয়ে শরিয়াহ্ বাদ দেয়ার আহ্বান জিনিয়েছিলেন এবং একেই প্রগতির পথে অগ্রসর হবার এইমাত্র পথ বলে বিবেচনা
করেছেন । এই গোষ্ঠীর সেক্যুলারিস্টরা ১৯০৬-এর
সাংবিধানিক বিপ্লবে (C0nstitutional Revolution) অধিকতর উদারন্থী উলেমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজারদের একটি আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন করেন ৷ রাজার ক্ষমতা সীমাত করেন আর ইরানিদের সংসদে অংশগ্রহনের সুযোগ দাবী করেন ফলে নাজাফের অধিকাংশ মুজতাহিদ সংবিধান সমর্থন করেন ।
শেখ মুহাম্মদ হুসেইন নাইনি তাঁর
এড়মোনিশন টু দ্য নেশন (Admonition to the Nation) ১৯০৯ -এ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে যুক্তি দেখান যে এভাবে
স্বেচ্ছাচারিতা সীমিত করা শিয়াদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ৷ এবং
পাশ্চাত্য ধাঁচের সাংবিধানিক সরকার গোপন ইমামের প্রত্যাবর্তনের
জন্য সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ । মিশরীয় লেখক রিফাহ্ আল আল-তাহতাওয়ি (১৮০১-৭৩) ও
ইউরোপীয় Enlightenment
বা আলোকনপর্বের ধারণা ফালসাফাহ্ র দর্শনের কাছাকাছি মনে করতেন । ভারতে সাইয়ীদ আহমেদ খান(১৮১৭-৯৮ )ইসলামকে
পশ্চিমা উদারনৈতিকতাবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে তিনি ব্যাখ্যা
ক’রে দেখান যে আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিস্কৃত প্রাকৃতিক আইনসমূহের সঙ্গে কোরান সম্পূর্ণই মানানসই । আলীগড়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত কলেজে ইসলামী বিষয়াদির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা যেত । তিনি মুসলিমদের নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে ব্রিটিশদের হুবহু অনুকরণ না করে একটা আধুনিক সমাজ চেয়েছিলেন ।
অবশ্য মুসলিম শাসক কেউ
কেউ স্বেচ্ছায় আধুনিকীকরণের ব্যর্থ চেষ্টাও করেছেন । অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ ১৮২৬-সালে এবং ১৮৩৯- সালে সুলতান আবদুল হামিদ গুলহান (Gulhane) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কারের চিন্তা করেছিলেন । মিশরের আলবেনীয় পাশা মুহাম্মদ
আলীর (১৭৬৯-১৮৪৯) কর্মসূচি ছিল আরো গতিশীল তবে নিষ্ঠুরতায় ভরপূর ছিল তা ৷ তিনি তার রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে উলেমাদের ক্ষমতাহীন
করে তোলেন । ফলে আধুনিকতাকে মারাত্মক আঘাত বিবেচনাকরে উলেমাগণ
আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ৷ ফলে স্বদেশে অস্তিত্বমান নতুন
পৃথিবীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তাঁরা ।
এ ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আলীর পোত্র ইসমায়েল পাশা (১৮০৩-৯৫ )ছিলেন বেশী সফল। তিনি চাষাবাদের উন্নতির সঙ্গে
সঙ্গে ছেলে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তবে কায়রোকে আধুনিক
নগরীতে পরিবর্তন করতে পারলে ও মিশরকে অর্থনীতিক ভাবে দেউলিয়া করে বৈদেশিক ঋণ গহণে বাধ্য হন । আর ইউরোপীয়দের বানিজ্যিক
স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৮৮২-সালে ব্রিটেন সামরিক দখলদারির অজুহাত পায় , যা কার্যত স্রেফ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয় ।
এই সব সংস্কার ও
আধুনিকরণের প্রথম সতর্কবাণী উচ্চারণকারীদের অন্যতম হলেন ইরানি রাজনৈতিক কর্মী জামাল-আল-দিন (১৮৩৯-৯৭ ) নিজকে যিনি “আল্-আফগানি” (আফগান) বলে অভিহিত করেছিলেন ; ইরানি শিয়াদের থেকে সুন্নী মুসলিম বিশ্বের অধিক মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে ৷ তিনি উপলব্ধি করেছেন যে অচিরেই পশ্চিমিরা মুসলিম বিশ্বের ওপর প্রধান্য বিস্তার করবে এবং ধ্বংস ডেকে আনবে তাই তিনি ইসলামী বিশ্বের জনগণের প্রতি ইউরোপীয় শক্তির বিরুদ্ধে একাত্ম হবার আহবান
জানিয়ে বলেছেন মুসলিমরা যেন তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অর্থাৎ
ইসলামের বিকাশ ঘটাতে প্রয়োজন হলে “ইজতিহাদের রুদ্ধ
দ্বারের”
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে আর স্বাধীন যুক্তির
ব্যবহার করতে হবে ,যেমনটি কোরান এবং পয়গম্বর নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশ্চাত্যের
দখলদারিত্ব রাজনীতিকে আবার ইসলামী অনুভূতির কেন্দ্রে নিয়ে আসে । পয়গম্বর মুহাম্মদের(সঃ)
আমল থেকেই মুসলিমরা চলমান ঘটনাবলীকে থিওফ্যানি হিসাবে দেখে এসেছে
; তারা এমন একজন ঈশ্বরকে দেখেছে যিনি ইতিহাসে উপস্থিত রয়েছেন এবং একটি উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার স্থায়ী চ্যালেঞ্জ জারি করে রেখেছেন । কিন্তু মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্যের অনুপ্রবেশ জন্ম দিয়েছিল
গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় জিজ্ঞাসার । উম্মাহ্ র অপদস্থ হওয়ার ব্যাপারটা রাজনৈতিক বিপর্যয় ছাড়াও
মুসলিমদের একেবারে আত্মায় আঘাত হেনেছিল । কোরানের প্রতিশ্রুতি ছিল যে
ঈশ্বরের প্রকাশিত ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণকারী কোনো সমাজ ব্যর্থ হতে পারে না । মুসলিম ইতিহাস এর সত্যতা প্রমান করে । বারবার , যখনই বিপদ নেমে এসেছে, ধর্মপ্রাণ
মুসলিমরা ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে,ধর্মকে নতুন পরিস্থিতিতে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে এবং উম্মাহ্ কেবল পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠেনি বরং সাধারণভাবে আরো ব্যাপক সাফল্যের পথে অগ্রসর হয়েছে ।
আল-আফগানির এক সমর্থক
১৮৯৬-এ ইরানের শাহ্ কে হত্যা করে তাঁর উদ্ভট প্রচারণায় আকৃষ্ট হয়ে । তবে তাঁর অন্য সহকর্মী মিশরীয় পণ্ডিত মুহাম্মদ আবদু (১৮৪৯-১৯০৫) ছিলেন চিন্তাবিদ ও জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব , তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিপ্লব নয় ,বরং
শিক্ষাই প্রকৃত সমাধান । তিনি বিশ্বাস করতেন যে সমাজের মানুষ আইন বুঝতে পারে
না, কার্যতঃ সেদেশ আইনবিহীন দেশে পরিণত হয় । তাঁর মতে শুরাহ্ (পরামর্শ)র
ইসলামী নীতি মুসলিমদের গণতন্ত্রের অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে পারে । শিক্ষাকে সংস্কার করে মাদ্রাসার ছাত্রদের আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ করে ইসলামী প্রেক্ষিতে মুসলিমদের আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করতে হবে এবং শরিয়াহ্ কে হালনাগাদ
করে তুলতে হবে ; কিন্তু এই সময়কার এক সাংবাদিক রশিদ রিদা (১৮৬৫-১৯৩৫
) মনে করতেন শরিয়াহ্ কে হালনাগাদ করা এক দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া , আর আরব বুদ্ধিজীবীদের
ক্রমবর্ধমন সেক্যুলারিজমে ও শঙ্কিত ছিলেন তিনি । রিদা মনে করেছেন এতে
কেবল উম্মাহ্ আরো দুর্বল হয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সহজ
শিকারে পরিণত হবে । রিদাই হচ্ছেন অন্যতম প্রধান মুসলিম যিনি সম্পূর্ণ আধুনিক
অথচ
সংস্কৃত শরিয়াহ্ ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন । তিনি এমন একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা
করতে
চেয়েছিলেন যেখানে ছাত্ররা ফিকাহ্ শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন, সমাজবজ্ঞান, বিশ্ব
ইতিহাস, ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা এবং আধুনিক
বিজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে , প্রকৃত আধুনিক প্রেক্ষিতে ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্সে উন্নতি
লাভ করবে এবং যা পূর্ব ও পশ্চিমের ঐতিহ্যকে একসূত্রে গাঁথে কৃষিভিত্তিক আইন ও শরিয়াহ্ কে পশ্চিমে বিকশিত নতুন ধরণের
সমাজের সঙ্গে মানানসই করে তুলবে ।
ভারতে কবি-দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৬-১৯৩৮ ) , যিনি
লন্ডনে পি এইচ.ডি করেছিলেন তিনি জোর দিয়ে বললেন যে ইসলাম
যেকোনো পশ্চিমা ব্যবস্থার মতই যুক্তিভিত্তিক , এবং প্রকৃতপক্ষে এটা প্রচলিত অন্যসব কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসের মাঝে সবচেয়ে যৌক্তিক এবং প্রাগ্রসর । এর কঠোর একেশ্বরবাদীতা মানব
জাতিকে কিংবদন্তী হতে মুক্তি দিয়েছে আর কোরান মুসলিমদের তাগিদ দিয়েছে গভীরভাবে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে ৷ পর্যবেক্ষণের
ফল নিয়ে চিন্তা করতে বলেছে আর কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত পরীক্ষার বিষয়ে
পরিণত করতে বলেছে কোরান । এভাবে আধুনিকতার জন্মদানকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেতনা
আসলে
ইসলাম থেকেই উদ্ভূত । যদিও তাঁর এই দাবী ইতিহাসের আংশিক এবং অযথার্থ ব্যাখ্যা তবে তিনি সুফিবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে সরে এসে ইসলামের যৌক্তিক
চেতনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে আধুনিক ইসলামী যুক্তিবাদকেই মুসলিম বিশ্বের সামনে এগোনোর
একমাত্র উপায় হিসাবে দেখেছেন । তিনি সেক্যুলার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিত্বের ধারণাকে ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন করে একে বহুঈশ্বরবাদী
এবং আশঙ্কাজনকভাবে অশুভ করে তুলছে বলে মতামত দিয়েছেন । এর পরিণামে পাশ্চাত্য আপন
ধ্বংসকেই ডেকে আনবে বলেও তিনি বলেছেন । তাঁর এই ভবিষ্যতবানী যে কতটা বাস্তব ছিল তা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর
উপলব্ধি করা গেছে । তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলিমদের জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন ধ্যানে মগ্ন হয়ে নয় বরং শরিয়াহ্ র আদর্শসমূহকে বাস্তবায়িত করা যাবে এমন
কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহন করার মাধ্যমে জীবনে ঐশ্বরিক মাত্রা লক্ষ্য করার এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন
রয়েছে ।
তবে
উল্লেখিত সংষ্কারকদের কার্যক্রম শুধু বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত
অভিজাতদের মধ্যেই অনেকটা সীমাবদ্ধ ছিল ৷ কিন্তু তখন মিশরে তরুণ এক স্কুলশিক্ষক হাসান আল-বান্না (১৯০৬-৪৯ )এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা তাঁদের চিন্তা ও ধারণাসমূহকে সাধারণ জনগণের
কাছে পৌছে দিয়েছে । দ্য সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্স গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে
এক
গণআন্দোলনের রূপ নেয় এবং সেটাই ছিল
একমাত্র আদর্শবাদ যা সেই সময়ে সমাজের সকল ক্ষেত্রে আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল । আল-বান্না বিশ্বাস করতেন যে মুসলিমদের পাশ্চাত্যের
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে, এর জন্যে তাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহের সংস্কার সাধন করতে হবে , যা আধ্যাত্মিক সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি চলতে হবে । ক্রিশ্চানরা যেখানে মতবাদসমূহের পরিমার্জনার মাধ্যমে
আধুনিকতার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছে , মুসলিমরা সেটা করেছে সমাজিক বা রাজনৈতিক প্রয়াসের (জিহাদের) মাধ্যমে । আল-বান্না জোর দিয়ে বলেছেন যে ইসলাম সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা ; তাই ধর্মকে ব্যক্তি
পর্যায়ে সীমিত রখা যাবে না , পাশ্চাত্য যেমন চেষ্টা
করেছে ।
তাঁর সোসায়েটি নতুন যুগের চেতনার উপযোগি ক’রে কোরানকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছে ; চেষ্টা করেছে ইসলামী জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের , সামাজিক ন্যায়-বিচারের মান -উন্নয়ন, নিরক্ষরতা আর দারিদ্রো বিমোচন এবং মুসলমদের জমি বিদেশী আধিপত্যের কবল থেকে উদ্ধারের । তাঁর ধারণা ছিল, যতদিন মুসলিমরা অন্যদের অনুকরণ করে চলবে ততদিন পর্যন্ত তারা সাংস্কৃতিক সংকর হয়ে থাকবে ।তার সোসাইটির ব্রাদার এবং সিস্টাদের আনুষ্ঠানিক প্রর্থনা আর কোরান-অনুযায়ী জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি আল-বান্না স্কুল , আধুনিক স্কাউট ,শ্রমিকদের নৈশ স্কুল , সরকারী চাকুরির উপযুক্ত করে তোলার জন্যে টিউটোরিয়েল কলেজ ,গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কারখানা নির্মাণ সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম ক’রে তোলার উদ্দেশ্যে ।সোসাইটির সদস্য ১৯৪৮ -এ কয়েক মিলিয়ণ মুসলিমে দাঁড়িয়েছিল এবং যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল; এবং তখন এটাও প্রমানিত হয়েছিলো যে-সিংহভাগ জনগণ আধুনিক এবং ধার্মিক হতে চায়, বুদ্ধিজীবীগণ বা সেক্যুলার সরকারসমূহ যেমনটি মনে করুক না কেন । আর এই ধরনের সামাজিক কার্যক্রম তখন বহু আধুনিক ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল.
তাঁর সোসায়েটি নতুন যুগের চেতনার উপযোগি ক’রে কোরানকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছে ; চেষ্টা করেছে ইসলামী জাতিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার এবং তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের , সামাজিক ন্যায়-বিচারের মান -উন্নয়ন, নিরক্ষরতা আর দারিদ্রো বিমোচন এবং মুসলমদের জমি বিদেশী আধিপত্যের কবল থেকে উদ্ধারের । তাঁর ধারণা ছিল, যতদিন মুসলিমরা অন্যদের অনুকরণ করে চলবে ততদিন পর্যন্ত তারা সাংস্কৃতিক সংকর হয়ে থাকবে ।তার সোসাইটির ব্রাদার এবং সিস্টাদের আনুষ্ঠানিক প্রর্থনা আর কোরান-অনুযায়ী জীবন যাপনের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি আল-বান্না স্কুল , আধুনিক স্কাউট ,শ্রমিকদের নৈশ স্কুল , সরকারী চাকুরির উপযুক্ত করে তোলার জন্যে টিউটোরিয়েল কলেজ ,গ্রামাঞ্চলে ক্লিনিক ও হাসপাতাল, কারখানা নির্মাণ সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম ক’রে তোলার উদ্দেশ্যে ।সোসাইটির সদস্য ১৯৪৮ -এ কয়েক মিলিয়ণ মুসলিমে দাঁড়িয়েছিল এবং যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিশরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল; এবং তখন এটাও প্রমানিত হয়েছিলো যে-সিংহভাগ জনগণ আধুনিক এবং ধার্মিক হতে চায়, বুদ্ধিজীবীগণ বা সেক্যুলার সরকারসমূহ যেমনটি মনে করুক না কেন । আর এই ধরনের সামাজিক কার্যক্রম তখন বহু আধুনিক ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল.
১৯৪৯-এ মিশরের সেক্যুলারিস্ট
সরকারের হাতে প্রাণ হারান তিনি । বর্তমানে আবার মিশরে ইসলামী ব্রাদারহুড
ক্ষমতায় এসেছে ।
আধুনিক মুসলিম
রাষ্ট্র কী ? কিছু রাষ্ট্রের আধুনিকতা প্রয়োগের চেস্টা এবং ফলাফল
প্রসঙ্গ:
ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপের সঙ্গে সংঘাত ইসলামী সমাজকে স্থানচ্যুত করে দিয়েছিল । শিল্পবিপ্লবের পর পৃথিবী
অপরিবর্তীনীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল । পাশ্চাত্যের প্রতি কীভাবে সাড়া
দেয়া উচিত মুসলিমদের পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছিল । কারণ , মুসলিমদের
যদি আধুনিক বিশ্বের পূর্ণাঙ্গ অংশীদার হিসাবে অংশগ্রহণ করতে হয় সেক্ষেত্রে তাদের এসব পরিবর্তন আত্মস্থ করতে হত । আধুনিক বিশ্ব তখন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে রক্ষা করতে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতার প্রয়োজন বলে আবিস্কার করেছিল ।
তখন ইউরোপে জাতীয়তাবাদ ধর্মের প্রতি আনুগত্যের স্থান দখল করেছিল , যা
এর
সমাজগুলোকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম করেছে । উনবিংশ শতাব্দীর এই নিরীক্ষা পরবর্তীতে কিন্তু সমস্যাসঙ্কুল বলে প্রমানিত হয়েছে । ইউরোপের জাতি রাষ্ট্রগুলো ১৮৭০-সালে এক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে শেষ
পর্যন্ত দু-দুটো বিশ্ব-যুদ্ধ ডেকে আনে । সেক্যুলার আদর্শসমূহও পুরনো
ধর্মীয় গোঁড়ামির মতই মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে যা
নাৎসি হলোকাস্ট আর সোভিয়েত গুলাগে (Gulag) স্পষ্ট হয়ে গেছে ।আলোকনপর্বের ফিলোসোফদের (Philosopher) ধারণা ছিল যে মানুষ যত শিক্ষিত হয়ে উঠবে
ততই তারা যুক্তিবাদী ও সহিষ্ণু হবে ।
যা পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ।পরিণামে , শেষ
পর্যন্ত আধুনিক সমাজ গনতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে এবং তা
মোটামুটিভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণের জীবন অনেক বেশী
ন্যায়ভিত্তিক এবং সাম্যবাদী করে তুলেছে ।
রাজনীতি কখনওই ক্রিশ্চান বা ইহুদি ধর্মীয়বোধের কেন্দ্রিয় বিষয় ছিল না , কারণ
জেসাস
বলেছিলেন তাঁর রাজ্য-এ জগতে নয় । ইউরোপের ইহুদিরা ও নীতিগতভাবে
তখন
নিজেদের রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছিল ।
কিন্তু মুসলিমদের কাছে রাজনীতি গৌণ বিষয় নয় । বরং এটাই তাদের কাছে অধিক প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছে এবং গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে একটা প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্রমাগত চেষ্টা চালানো হয়েছে ।এটা এমন এক আকাঙ্খা যার জন্য প্রয়োজন জিহাদ-এই সংগ্রাম যদিও কখনই কোনো ভাল সাধারণ ফলাফল বয়ে আনে না । মুসলিমরা তাওহীদের (একীকরণ; স্বর্গীয় একত্ব, মুসলিমরা তাদের রীতিনীতি ও অগ্রাধিকার সমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং ঈশ্বরের
সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে তাদের ব্যক্তি ও সমজ জীবনে যার
অনুকৃতি আনতে চায় ।) আদর্শকে যেন সেক্যুলারিজমের আদর্শের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করেছে সেসময় , অথচ
অতীতে শিয়া (শিয়াহ-ই-আলী বা আলীর
পক্ষাবলম্বনকারীদের অন্তর্ভূক্ত, এরা বিশ্বাস করে যে
রাশিদুনদের স্থলে পয়গম্বরর নিকটতম পুরষ আত্মীয় আলী ইবনে আবি
তালিবেরই শাসন করা উচিত ছিল, বেশ কয়েকজন ইমামকে মানে তারা ,যারা আলী এবং
পয়গম্বরের কন্যা ফাতিমাহ্ র প্রত্যক্ষ পুরুষ বংশধর
। সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে এদের মতপার্থক্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ) ও সুন্নী ( সুন্নী
রা চার খলিফা বা রাশিদুনকে শ্রদ্ধাকারী ও চলতি ইসলামী ব্যবস্থাকে বৈধতা দানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ
মুসলিমদের বোঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হয় ) উভয়েই ধর্ম ধর্ম ও রাজনীতিক পার্থক্য মেনে নিয়েছিল ।তখন মুসলমদের অনেকের কাছে
রাজনীতি গোলযোগপূর্ণ ও নিষ্ঠুর হিসাবে প্রতিয়মান হয়েছে ,তাদের মতে- আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্র কোনো সহজ বিষয় ছিল
না , বরং রাজনীতির কঠোর বাস্তবতায় কোরানের সমতার আদর্শ অনুসারে বাস্তবায়ন খুবই কঠিন
এবং সৃজনশীল মেধা ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন অনূভব করেছে তারা । ফলে মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজম তখন ধর্ম এবং ধার্মিকের ওপর তীব্র কঠিন আক্রমণের সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ।
উদাহরণস্বরূপ, কামাল
আতাতুর্ক(মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক নামে ও পরিচিত (১৮৮১-১৯৩৮) আধুনিক, সেক্যুলার
টার্কির প্রতিষ্ঠাতা ) সকল মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সুফি ( সুফিবাদ ; সুন্নী ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী ঐতিহ্য ) মতবাদ দমন করেছেন, নারী ও পুরুষ উভয়কে বাধ্য করেছেন আধুনিক পোশাক পরার
জন্যে । এ
জাতীয় নিপীড়ন সবসময়ই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় । টার্কিতে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে না গিয়ে ,স্রেফ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল ।
মুহাম্মদ আলীও মিশরীয়
উলেমাদের (
একবচনে, আলিম ; শিক্ষিত জন,
ইসলামের আইনগত ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের অভিভাবক ।) ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, তাঁদের
জমিজমা কেড়ে নিয়েছেন এবং তাঁদেরকে প্রভাব বঞ্চিত করছেন । পরে জামল আবদ আল-নাসের
(১৯১৮-৭০ ) কিছু সময়ের জন্যে পুরোদস্ত্তর জঙ্গিরূপে এনটি
ইসলামীতে পরিণত হয়ে দমন করেছেন মুসলিম ব্রাদারহুডকে । নাসেরের(নাসের- জামাল আবদ আল: মিসরের প্রেসিডেণ্ট(১৯৫২-৭০), চরম
জাতীয়তাবাদী,
সেক্যুলারিস্ট এবং সোস্যালিস্ট সরকারের নেতৃত্ব দেন )জীবন
নাশের চেষ্টা ছাড়াও লিফলেট বন্টন সহ অন্যান্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে ।
ইরানে পাহ্ লভী রাজাগণও তাঁদের সেক্যুলারিজমের ক্ষেত্রে নিষ্ঠর ছিলেন । রেযা শাহ্
পাহলভী (১৯২১-৪১ পর্যন্ত শাসন করেন ) উলেমাদের তাঁদের বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করে, এক সিভিল ব্যবস্থাকে শরিয়াহ্ র স্থলাভিষ্ণিক্ত করে
ছেন, হুসেইনের সম্মানে আশুরার উৎসব বাতিল ঘোষণা করেন তিনি এবং ইরানিদের জন্যে হজ্জে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন , ইসলামী পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ; রেযার সৈন্যরা বেয়োনেট দিয়ে মহিলাদের বোরখা ছিঁড়ে ফেলত । ১৯৩৫-এ মাশাদে অষ্টম ইমামের সমাধিতে প্রতিবাদকারীদের পোশাক-আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত নিরস্ত্র জনগণের ওপর সৈন্যরা গুলি বর্ষণ করে শত শত প্রাণহানি ঘটায় । উলেমাদের প্রভাব হ্রাস করা হয় । ১৯৩৭-এ রেযাকে আক্রমণকারী আয়াতোল্লাহ্ মুদ্দারিস
শাসকদলের হাতে নিহত হন । প্রতিবাদী শত শত মাদ্রাসা-ছাত্রকে রাজপথে গুলি করে মরার পর মাদ্রাসাসমূহ বন্ধ করে দেয়া ছাড়াও উলেমাদের নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় ,কারারুদ্ধ কিংবা নির্বাসনেও পাঠানো হয়েছিল তাঁদের । এই সেক্যুলার শাসনে
গণতন্ত্রিক বলে কিছু ছিল না । শাহ্’র
গুপ্তপুলিশ বাহিনী SAVAK বিনাবিচারে ইরানিদের কারারুদ্ধ করে নির্যাতন চালিয়েছে,ভীতি প্রদর্শন করেছে
এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোনো সম্ভাবনাই সেখানে ছিল
না।
জাতীয়তাবাদ, বিংশ
শতাব্দীর শেষাংশে এসে খোদ ইউরোপীয়রাই এর থেকে সরে যেতে শুরু করেছিল সেটাও
সমস্যামূলক বলে দেখা গেছে । উম্মাহ্র (মুসলিম
সমাজ) ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে এক মূল্যবান আদর্শ ছিল ; এবার মুসলিম বিশ্ব রাজ্য আর প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে গেল, যাদের সমান্ত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো নিজেদের মত করে
স্থির করে দিয়েছিল। ,মুসলিমরা যেখানে নিজেদের অটোমান নাগরিক এবং দার আল-ইসলামের (ইসলামের
ঘর,যা মুসলিম শাসনাধীন এলাকা ) সদস্য বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিল সেখানে একটা জাতীয় চেতনা গড়ে তোলা সহজ ছিল না । যেমন- সুদানের দক্ষিণ অংশ
ক্রিশ্চান প্রধান এবং উত্তরাঞ্চল মুসলিম প্রধান অংশ
যারা নিজেদের পরিচয় ধর্মের ভিত্তিতে দেখতে আগ্রহী সেখানে
একটা সাধারণ সুদানিজ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা কঠিনই বটে।তিনটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ( সুন্নী,
শিয়া, এবং ম্যারোনাইট ক্রিশ্চান) দেশ লেবাননে এ সমস্যা আরো
প্রকট
ছিল ।
অন্যান্য দেশে, যেমন সিরিয়া.মিশর কিংবা ইরাকে জাতীয়তাবাদ সংখ্যালঘুদের মতবাদ ছিল, যা
অধিকতর রক্ষণশীল জনগণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেনি ।
ইরানে পাহ্ লভীদের(রেযা খান-ইরানের শাহ্ ১৯২১-৪১ এবং পাহলভী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার সরকার আক্রমণাত্মক ধরনের সেক্যুলারিস্ট ও জাতীয়তাবাদী ছিল) জিতীয়তাবাদ সরাসরি ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিল, কেননা তা শিয়া মতবাদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেশটিকে প্রাচীন প্রাক-ইসলামী প্যাগান সংস্কৃতির ভিত্তিতে
গড়ে তুলতে চেয়েছে ।
গণতন্ত্রও সমস্যা সৃষ্টি করেছিল । সংস্কারকদের মাঝে যাঁরা ইসলামী কাঠামোতে আধুনিকতাকে
স্থাপন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা তুলে
ধরেছেন যে গণতন্ত্রের আদর্শ ইসলামের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন নয় । ইসলামী আইন শুরাহ্ (পরামর্শ) এবং ইজমাহ্ কে উৎসাহিত করে, যেখানে
আইন-কানুনে অবশ্যই উম্মাহ্ র জনপ্রতিনিধিশীল অংশের “ ঐকমত্য”
দ্বারা অনুমোদিত হয় ।রাশিদুনগণ (চারজন “সঠিকপথে পরিচালিত” খলিফাহ্ যারা পয়গম্বর
মুহাম্মদের (সঃ) সহচর ও প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী ছিলেন; আবু
বকর ,উমর ইবনে আল-খাত্তাব, উসমান ইবনে আফফান এবং আলী
ইবনে আবি তালিব) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বচিত হয়েছিলেন ।এসবই গণতান্ত্রিক
আদর্শের সঙ্গে মানানসই ।সমস্যার অংশ বিশেষ নিহিত রয়েছে পাশ্চাত্য
প্রণীত গণতন্ত্রে যেখানে “ সরকার জনগণের ,জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্যে” । ইসলামে জনগণ নয় , ঈশ্বরই কোনো সরকারের বৈধতা দান করেন । মানুষের উন্নীত অবস্থান বহুঈশ্বরবাদ (শিরক) বলে মনে হতে পারে যেহেতু তা ঈশ্বরের সার্ভভৌমত্বে হস্তক্ষেপ ।তবে পাশ্চাত্যের অনুসরণ না করেও মুসলিম দেশগুলোর পক্ষে জনপ্রতিনিধিত্বশীল ধরণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব হয়নি । কিন্তু গণতান্ত্রিক
আদর্শ বাস্তবক্ষেত্রে প্রায়শ অপব্যবহৃত হয়েছে। ১৯০৬-এ ইরানি জনগণ সাংবিধানেক বিপ্লবের পর মজলিস(সংসদ) গঠন
করে, রাশানরা তা রদ করতে শাহ্ কে সাহায্য করেছিল । পরবর্তীতে রেযা শাহ্ যখন তাঁর আধুনিকীকরণ কর্মসূচি কার্যকর করতে,ও মজলিস রদ করতে ইরানের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন
করেছেন, আমেরিকান সমর্থন নিয়ে, তখন পাশ্চাত্য এর জনগণের জন্যে সগর্বে গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছে ।মিশরে ১৯২৩ থেকে১৯৫২ সালের সময়কালের মধ্যে সতেরটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় , প্রতিবারই
জনপ্রিয় ওয়াফদ পার্টি জয় পেয়ে , মাত্র পাঁচবার ওয়াফদ দেশ শাসন করার
অনুমতি পেয়েছিল ।ব্রিটিশ কিংবা মিশরের রাজা তাদের ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য
করেছিল ।
সুতরাং
ধর্মকে ব্যক্তিপর্যায়ে ঠেলে দেবে এমন গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র গঠন মুসলিমদের জন্যে কঠিন । অন্য সমাধনগুলোকে খুব
সুবিধাজনক মনে হয়নি ।
১৯৩২-এ
প্রতিষ্ঠিত কিংডম অভ সৌদি আরাবিয়া ওয়াহ্হাবি ( আব্দ
আল-ওয়াহ্হাব,মুহাম্মদ ইবনে ১৭০৩-৯২ ; একজন সুন্নী সংস্কারক যিনি
ইসলামের মৌল বিষয়ে ফিরে যাবার লক্ষ্যে প্রবল প্রয়াস
পেয়েছিলেন ।বর্তমানে সৌদি আরব ইসলমের ওয়াহ্হাবিবাদ ধরণ অনুসৃত হচ্ছে । আদর্শে বিশ্বাসী ।সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংবিধান অপ্রয়োজনীয় , কেননা সরকারের ভিত্তি হচ্ছে কোরানের আক্ষরিক পাঠ ।কিন্তু কোরানে আইনের পরিমাণ
খুবই কম এবং বাস্তব ক্ষেত্রে এর পরিপূরক হিসাবে সব সময়ই জটিল জুরেসপ্রুডেন্স প্রয়োজন বলে দেখা গেছে
।সৌদীরা
দাবী করে যে তারা আরবীয় পেনিনসূলার আদি ইসলামের উত্তরাধিকারী এবং উলেমাগণও রাষ্ট্রের বৈধতা মেনে নিয়েছেন ; বিনিময়ে
রাজাগণ রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়েছেন। নারীদের বোরখার মাধ্যমে আড়ালে নিয়ে যাওয়া এবং বিচ্ছিন্ন রাখা হচ্ছে
( যদিও পয়গম্বরের আমলে ব্যাপারটি এমন ছিল না ) , জুয়া
ও মদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে , চুরির অপরাধে অপরাধীর অঙ্গচ্ছেদের মত ঐতিহ্যবাহী শাস্তি আইন ব্যবস্থায় অঙ্গীভূত করা হয়ছে ।অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র এবং সংগঠন মনে করে না যে কোরানের প্রতি আনুগত্য রক্ষার জন্যে এধরনের প্রাক-আধুনিক শাস্ত ব্যবস্থার জরুরিত্ব আছে । উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম
ব্রাদারহুড একেবারে গোড়া থেকেই সৌদীদের ইসলামী শাস্তি
প্রয়োগকে অযথার্থ আর সেকেলে বলে নিন্দা জানিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে শাসক গোষ্ঠীর বিপুল সম্পদ আর , সম্পদের অসম বণ্টন কোরানের আরও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের বিপক্ষে দঁড়ায় ।
পাকিস্তান ছিল আরএকটি আধুনিক ইসলামী নিরীক্ষা । রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ (১৮৭৬-১৯৪৮ )আধুনিক সেক্যুলার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন । সেই আউরেঙজিবের ( মোঘুল সম্রাট (১৬৫৮-১৭০৭) যিনি আকবরের
সহিষ্ণু নীতিমালা পাল্টে দেন এবং হিনদু ও শিখ বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলেন )
আমল থেকেই ভারতের মুসলিমরা নিরাপত্তাহীনতার বোধে আসছিলো, অসন্ত্তষ্ট
ছিল তারা : নিজেদের পরিচয় নিয়ে আতঙ্কে ছিল তারা , এবং
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল ।১৯৪৭-এ ব্রিটিশ কর্তৃক উপমহাদেশ
বিভক্ত হবার পর এ অবস্থা আরও তীব্র হয়ে সাম্প্রদায়িক
সহিংসতা দেখা দিলে, উভয় পক্ষেরই হাজার হাজার মানুষ
প্রাণ হারায় । জিন্নাহ্ সম্ভবতঃ এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে
চেয়েছিলেন মুসলিমরা যেখানে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের দ্বারা পরিচিত হবে না বা বাধাগ্রস্থ হবে না । কিন্তু মুসলিম পাকিস্তান রাষ্ট্র কোনো ভাবেই যাহাতে “সেক্যুলার”
রাষ্ট্র না হতে পারে সে জন্যে- আবুল আলা মাওদুদি (১৯০৩-৭৯) (পাকিস্তানি মৌলবাদী আদর্শবাদী, সুন্নী
মুসলিম বিশ্বে যাঁর ধারণার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে ) প্রতিষ্ঠিত জামাত-ই
ইসলামী শরিয়াহ্ (কোরান, সুন্নাহ এবং হাদিসসমূহ থেকে সংগৃহীত ইসলামী পবিত্র
আইন )বিধিমালার কঠোর প্রয়োগের জন্যে চাপ দেওয়ায় ১৯৫৬-তে ঘোষিত সংবিধান
পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী রিপাবলিক পরিচয় দেয় । যা দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান
সমূহে ও ধারণ করতে হবে ।
একপর্যায়ে জেনারেল
মুহাম্মদ আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা
করেন. পরবর্তীতে দেশটির পূর্বাঅংশ এক মূক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙলাদেশ নাম ধারণ করে এক সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠন করে ছি ল ।
১৯৭০-র দশকে বর্তমান
পাকিস্তানে ইসলামপন্থী শক্তিগুলো সরকারের প্রধান বিরোধী পক্ষে পরিণত হয় এবং বামপন্থী সেক্যুলারিস্ট প্রধানমন্ত্রীর সরকার (১৯৭১-৭৭)
মদ ও জুয়া নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের কিছুটা শান্ত করার প্রয়াস পান যা যথেষ্ট ছিল না । ১৯৭৭-এর জুলাইয়ে ধর্মপ্রান মুহাম্মদ জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে কিছু ইসলামী পরিবর্তন আনলেও তাঁর নীতিমালা স্পষ্টতই সেক্যুলারিস্ট ছিল । ১৯৮৮-তে এক বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর পাকিস্তানি রাজনীতিতে জাতিগত বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্যদের মাঝে বৈরিতা আর দুর্নীতি দেখা দেয় এবং প্রভাব হারায় ইসলমপন্থীরা । পাকিস্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে এবং জনজীবনেও ইসলামের উপস্থিতি ব্যাপক ; তারপরেও
মূল
রজনীতিকে তা প্রভাবিত করতে পারছে না । তাই রাষ্ট্র যন্ত্র কর্তৃক
নির্যাতিত পাকিস্তানী মুসলিমরা প্রতিবেশী আফগানিস্তানের মৌলবাদী তালিবান সরকারের দিকে ঝুঁকে
পড়ছে ।
মুসলিমরা
এখনও
বিংশ শতাব্দীর উপযোগী আদর্শ রাজনীতির সন্ধান পায় নি বলে ইসলামকে আধুনিকতার সঙ্গে মানানসই বলা যাবে না । রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ইসলামী
আদর্শকে স্থাপন করে একটি সঠিক নেতৃত্বের সন্ধান মসলিমদের
গোটা ইতিহাস জুড়ে আলোড়িত হয়ে এসেছে । ধর্মীয় জীবন কঠিন.আধুনিক সংস্কৃতির
সেক্যুলার যুক্তিবাদ অন্য সকল প্রধান ট্র্যাডিশনের মানষের জন্যে ও বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছে । সকল ধার্মিক জাতিকে যেকোনও যুগে সেই সময়ের বিশেষ আধুনিকতার প্রতি সাড়া দেয়ার জন্যে তাদের ট্র্যাডিশনকে প্রস্তুত করতে হয়। একটি আদর্শ মুসলিম সরকারের অনুসন্ধানকে পথবিচ্যুতি হিসাবে দেখা উচিত হবে না বরং একে অত্যাবশ্যকীয় এবং যথার্থ ধর্মীয় কার্যক্রম বলেই ধরে নিতে হবে ।চলবে...
মৌলবাদ ও ইসলাম এবং অন্যান্য প্রধান ধর্মের
মৌলবাদ প্রসঙ্গ (১)
বর্তমানে যুদ্ধংদেহী এবং কখনও কখন সহিংস
ধার্মিকতাকে “ মৌলবাদ” হিসাবে ধরা হয়ে থাকে । তবে মৌলবাদ কে শুধু যে ইসলামী ব্যাপার বলে
পশ্চিমা গণমাধ্যমে যে ধারণা দিয়ে থাকে তা কিন্তু সঠিক নয় ।
মৌলবাদ এক বিশ্বজনীন ব্যাপার এবং আধুনিকতার সমস্যাদির প্রতি
সাড়া দিয়ে সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রেই আবির্ভূত হয়েছে ।মৌলবাদী জুডাইজমে যেমন আছে, মৌলবাদী ক্রিশ্চানিটিতে আছে, মৌলবাদী হিন্দুধর্মমত , মৌলবাদী বুদ্ধধর্ম , মৌলবাদী শিখধর্ম এবং এমনকি মৌলবাদী
কনফুসিয়বাদ প্রর্যন্ত আছে ।বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিশ্চান
জগতে প্রথম এধরনের ধর্মবিশ্বাস আবির্ভূত হয়েছিল । মৌলবাদের প্রত্যেকটা রূপ (form) একই ট্র্যাডিশনে হলেও, স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়, এর নিজস্ব প্রতীক ও উদ্দীপনা থাকে ।যার ভিন্নতর প্রকাশগুলো একই পারিবারিক
সাদৃশ্যতা বহন করে ।কোন আধুনিকতা আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ প্রতিক্রিয়া হিসাবে মৌলবাদী আন্দোলন
সূচিত হয় না, বরং আধুনিকতার ধারা অনেকটা অগ্রসর হওয়ার পরই
কেবল একটা রূপ নিতে শুরু করে । কারণ এর শুরুতে ধার্মিকরা তাদের ট্র্যাডিশনসমূহকে সংস্কার
করে আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করে , মধ্যপন্থী ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হওয়ার পরই এক মৌলবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ।
তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের ভেতর প্রকৃতপক্ষে ইসলামই সবার
শেষে মৌলবাদী ছোপ পড়েছে । ১৯৬০ -৭০ এর দিকে মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতা আরম্ভের শুরুতেই ক্রিশ্চান ও
ইহুদিদের ভেতর মৌলবাদ জাঁকিয়ে বসেছিল ভালভাবেই ।দেখা গেছে যে প্রতিটি মৌলবাদী আন্দোলন
বিশ্বাস করে , সেক্যুলার প্রশাসন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার
জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ । তখন মৌলবাদীরা আধুনিকতার হামলা-পূর্ব কালীন এক সুসময়ে
প্রত্যাবর্তনের চেষ্টায় থাকে ।মৌলবাদীরা প্রায়ই আধুনিক কোনো পরিবর্তনের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে ,এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও-গণতন্ত্র এবং
সেক্যুলারিজমের তী্র সমালোচক এরা।নারী-মুক্তি বর্তমান সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য তাই মৌলবাদীরা
কৃষিভিত্তিক লিঙ্গ-ভূমিকার ওপর জোর দিয়ে নারীদের
অবগুণ্ঠনের আড়ালে ঘরে আটকে রাখতে চায় ।
মৌলবাদী গোষ্ঠীকে এভাবে আধুনিকতার ছায়া
হিসাবে দেখা যতে পারে; যা অধুনিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু
অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও তুলে ধরতে পারে এটা । মৌলবাদীদের সবার বিশ্বাস তারা অস্তিত্ব
রক্ষার জন্যেই লড়ছে, আর এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে
লড়াই ছাড়া গত্যন্তর নেই তাদের এবং মানুষিকতার এই পর্যায়ে কেউ কেউ সন্ত্রাসবাদের
আশ্রয় গ্রহন করে।যা তাদের কাছে অধিকতর প্রচলিত বৈধ উপায়ে ধর্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণের প্রয়াস
মাত্র ।
ধর্মকে সাইডলাইন থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ঠেলে আনার ব্যাপারে
সফল হয়েছে মৌলবাদ, এমন একটা অবস্থা বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী
সময়ে ছিল অচিন্ত্যনীয় ,যখন সেক্যুলারিজমকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল । ১৯৭০-এর শক থেকে ইসলামী বিশ্বে নিঃসন্দেহে
এটাই ঘটেছে ।
মৌলবাদী আদর্শবাদীদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন
পাকিস্তানে জামাত-ই-ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদি।তিনি দেখেছেন পাশ্চাত্যের প্রবল শক্তি ইসলাম
ধ্বংসের লক্ষ্যে শক্তি সঞ্চয় করছে ।তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে এই আধিপত্যবাদী
সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে অবশ্য অবশ্য ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা , যদি তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে
হয়।
মওদুদি সব সেক্যুলারিস্ট নিয়ম নীতি অগ্রাহ্য ক’রে একটা
ইসলামী মুক্তির থিওলজির প্রস্তাবনা করেছেন, যা তার মতে
ঈশ্বসই যেহেতু একমাত্র সার্বভৌম,
সুতরাং মানুষের কাছ থেকে নির্দেশ
নিতে বাধ্য নয় । ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল অধিকার বা ন্যায়সঙ্গত নয় , বরং তা অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব ।
মওদুদি এক বিশ্বজনীন জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ।ঠিক পয়গম্বর যেমন করে জাহিলিয়াহ্ র
(প্রাক-ইসলামী কালের অজ্ঞতা ও বর্বরতা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন , মুসলিমরাও ঠিক সেভাবে পাশ্চাত্যের আধুনিক
জাহিলিয়াহ্ অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে । তাঁর মতে জিহাদই ইসলামের মূলকথা(tenet) এক নতুন উদ্ভাবন ছিল এটা। এর আগে কেউ কখনও দাবী করেনি যে জিহাদ ইসলামর
পাঁচটি স্তম্ভের সমতূস্য,কিন্তু মওদুদি মনে করেছেন যে বর্তমান জরুরি অবস্থায়
এই উদ্ভাবন যুক্তাসঙ্গত । সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অস্তিত্বহীনতার চাপ ও আতঙ্ক ধর্মকে অধিকতর চরম এবং সহিংস
বিকৃতির দিকে ঠেলে দিয়েছে ।
;-
মৌলবাদ ও ইসলাম এবং অন্যান্য প্রধান ধর্মের
মৌলবাদ প্রসঙ্গ (২)
কিন্তু সুন্নী বিশ্বে ইসলামী মৌলবাদের প্রকৃত
জন্মদাতা হচ্ছেন- সায়ীদ কুতুব(১৯০৬-৬৬)
(সায়ীদ কুতুব- নাসের প্রশাসনের হাতে নিহত মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য এবং সুন্নী
মৌলবাদের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ) তাঁর ওপর মাওদুদির সীমাহীন
প্রভাব ছিল । ১৯৫৩-তে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেয়ার পর তখনকার মিশরের সেক্যুলারিস্ট
অল-নাসেরের প্রশাসন তাঁকে তীব্র চরমপন্থীদের দিকে ঠেলে দেয় ।১৯৫৬-তে কারারুদ্ধ হয়ে তিনি ব্রাদার্স- এর আরো সদস্যদের সঙ্গে নির্যাতন শিবিরে থাকার সময় তাদের উপর চালানো নির্যাতন আর
হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ ক’রে, তিনি স্থির
প্রতিজ্ঞ হয়ে যান যে, কোনো ধার্মিক ব্যক্তি আর সেক্যুলারিস্টদের
পক্ষে এক সমাজে বসবাস করা সম্ভব নয় । তখনকার মিশরে তিনিআরবের জাহিলিয়াহ্ র সকল বৈশিষ্টের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন, যাকে তিনি ধর্ম বিশ্বাসের চিরন্তন
প্রতিপক্ষের বর্বরতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন । এবং এজন্যে পয়গম্বর মুহাম্মদের(সঃ) অনুসরণে মুসলিমদের আমৃত্যু যুদ্ধ করে জয়লাভ করা আবশ্যক মনে করেছেন । মাওদুদি যেখানে কেবল অমুসলিম সমাজকেই জাহিলি হিসাবে দেখেছিলেন ; কুতুব সেখানে প্রাক-ইসলামী সময়ের সকল জাহিলিয়াহ্ র লক্ষণ এই সময়ে মিশরে উপস্থিত দেখেছেন এবং প্রশাসক আল-নাসেরকে একজন ধর্মত্যাগী হিসাবে ঘোষনা দিয়ে ,নির্দেশ দিয়েছেন যে- মুহাম্মদ (সঃ)যে ভাবে
মক্কায় পৌত্তলিক প্রশাসনকে (তাঁর আমলের জাহিলিয়াহ্ ) পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য
করেছিলেন ঠিক সেভাবেই এধরনের সরকারকে উচ্ছেদ করা মুসলিমদের অবশ্যই কর্তব্য । কুতুব মুসলিমদের সমাজের মূলধারা থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে, দরকার হলে অন্য স্থানে হিজরত ক’রে শক্তি অর্জন করে , তারপর প্রবল জিহাদে যোগ দিয়ে সরকারকে উচ্ছেদ
করতে হবে ,বলেছেন ।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ (সঃ) এক অনন্যসাধারণ অহিংস
নীতি অনুসরণ করে বিজয় অর্জন করেছিলেন; ধর্মীয় ব্যাপারে
বল প্রয়োগ এবং নিপীড়নের ঘোরতর বিরোধী কোরান এবং এর দর্শন-বিচ্ছিন্নতা ও বর্জনের
শিক্ষা থেকে বহুদুরে-এবং সহিষ্ণু ও গ্রহনের নীতিতে বিশ্বাসী ৷
কুতুব জোর দিয়ে বলেছেন যে কেবল ইসলামের
রাজনৈতিক বিজয় এবং প্রকৃত মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেই কোরানে জারিকৃত
সহিষ্ণুতার ব্যাপারটি আসতে পারে ।১৯৬৬-তে নাসের প্রশাসন তার শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল ।
প্রত্যেক সুন্নী মৌলবাদী আন্দোলনের ওপরই কিন্তু
কুতুবের চিন্তাধারার প্রভাবরয়েছে এখনও । তাঁর নীতির অনুসারীরা মিশরের পরবর্তী সরকার প্রধানের (আনোয়ার আল-সাদাত ) ও প্রাণ নাশের চেষ্টা করে ,তাকে হত্যায় অনুপ্রাণিত করেছে ।
১৯৯৪-তে আফগানিস্তানে ক্ষমতা লাভকারী তালিবানরাও কুতুবের আদর্শে প্রভাবিত ।তারা ইসলামের আদি মৌলরূপে প্রত্যাবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ ।উলেমারা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন, আর নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে, এবং পেশাগত জীবনে নারীদের অংশ গ্রহণের অনুমোদন নেই
তাদের ।পাথর ছোঁড়া ও অঙ্গচ্ছেদের মত ইসলামী শাস্তির পূনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে সেখানে ।তবে তাদের শাসনে ও অত্যাবশ্যকীয় ইসলামী নীতির
লংঘন ঘটছে ।কারণ তালিবানদের অধিকাংশ পশতুন গোত্রের সদস্য এবং অ-পশতুনদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে চায় তারা-যারা দেশের উত্তরাংশ
থেকে শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ছে ।এরকম জাতিগত হিংসা (শভোনিজম) পয়গম্বর এবং কোরান কর্তৃক নিষিদ্ধ । সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর ওপর তাদের নিষ্ঠুর
আচরণও কোরানের নির্দশের স্পষ্ট পরিপন্থী।নারীদের প্রতি প্রদর্শিত তালিবানদের বৈষম্যও
পয়গম্বরের আচরণ এবং প্রথম উম্মাহ্ র অনুশীলনের সম্পূর্ণ বিপরীত । অবশ্য ধর্ম সম্পর্কে তাদের অতি বাছাইয়ের
দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তালিবানরা বৈশিষ্ট্যগতভাবে মৌলবাদী ; ধর্মকে যা বিকৃত করে এবং প্রত্যাশিত পথের
বিপরিত দিকে টেনে নিয়ে যায় । সকল প্রধান ধর্মবিশ্বাসের মত মুসলিম
মৌলবাদীরাও টিকে থাকার সংগ্রামে ধর্মকে নির্যাতন এমনকি সহিংসতার হাতিয়ারে পরিণত
করে থাকে।
কিন্তু অধিকাংশ সুন্নী মৌলবাদীরা এধরণের চরম পন্থার আশ্রয়
গ্রহণ করেনি ।১৯৬৭-তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের শোচনীয় পরাজয়বরণের পর
সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা প্রবণতা দেখা গেছে । আল-নাসেরের সেক্যুলার নীতি অকার্যকর বলে মনে
হয়েছে তাদের । যুদ্ধে পরাজয়কে ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত না হওয়ার কারণেই এটা ঘটেছে বলে অনেকে
বিশ্বাস করেছে । তাদের ধারণা , সেক্যুলারিজম এবং গণতন্ত্র পশ্চিমা বিশ্বে
কাজ করলেও সেগুলো সাধারণ মুসলিমদের কোনো উপকারে আসে না ,এতে বরং ইসলামী জগতের সংখ্যালঘু অভিজাত শ্রেণীই লাভবান হয় । তাই সমগ্র ইসলামীবিশ্ব জুড়ে ছাত্র ,এবং শ্রমিকরা সহ ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তাদের
পরিপার্শ্ব পরিবর্তনের কাজ শুরু করে , তারা তাদের
বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারখানাগুলো সহ মুসলিম প্রধান এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা ছাড়াও
বান্না-কায়দায় (বান্না
, হাসান আল-(১৯০৬-৪৯) মিশরীয় সংস্কারক এবং
সোসাইটি অভ মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা, ১৯৪৯-এ মিশরের সেক্যুলারিস্ট সরকারের হাতে প্রাণ হারান ) ইসলামী পরিচয় সমৃদ্ধ কল্যাণমূলক সোসাইটি গঠন
ক’রে এটা প্রমাণ করতে চেয়েছে যে সেক্যুলারিস্ট সরকারের চেয়ে জনগণের কল্যাণে
ইসলামই বেশী অগ্রসর ।
ইসলামী পোশাকে প্রত্যাবর্তনের পেছনেও একই নীতিমালা কাজ করছে ।এটা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া হলে
তখন নির্যাতনমূলক হয়ে দাঁড়ায়,
তালিবানরা এখন যেমন করছে ,পূর্বে রেযা শাহ্ পাহলভীও (মুহাম্মদ রেযা পাহলভী, শাহ্; ইরানের
দ্বিতীয় পাহলভী শাহ্ ১৯৪৪-৭৯ ,যার আক্রমণাত্মক আধুনিকীকরণ ও সেক্যুলারকরণের
নীতিমালা ইসলমী বিপ্লবের জন্ম দেয় মিশরে ) তখন তেমন করেছিলেন, অনেক সময় এর জন্য তীব্র পাল্টা প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করতে পারে ।জরিপে দেখা গেছে পর্দাধারী নারীদের বিপুল অংশ লিঙ্গ প্রসঙ্গের মত বিষয়ে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ।তবে কিছু কিছু নারীর ক্ষেত্রে, বিশেষ ক’রে প্রথম জেনারেশনের শিক্ষিত নারীরা, যারা গ্রামাঞ্চল থেকে কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে, তাদের ইসলামী পোশাক ধারণের অনুভূতি আধুনিকদের
থেকে কম যন্ত্রণাময়হিসাবে
দেখা দেয় ।কা রণ তারা অধুনিক বিশ্বের দিকে অগ্রসর হতে চায় তাদের নিজস্ব কায়দায় এবং ইসলামী
প্রেক্ষিতে যা তাদের এক পবিত্র অর্থ দেয়।অন্যদিকে পোশাকের সমরূপতা শ্রেণী বৈষম্য দূর
করে এবং পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের বিপরীতে গোষ্ঠী বা সমাজের গুরুত্বের ওপর
জোর দেয় ।
আবার শিয়া ও সুন্নী মৌলবাদীদের কেউ কেউও
আধুনিক সংস্কৃতির অচেনা সুরকে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে ধর্মকে ব্যবহার ক’রে একে
আরও সুগম করে তোলার জন্যে ধর্ম কে ব্যবহার করছে , একে আরও সুগম করে তোলার জন্যে অর্থের ও আধ্যাত্মিকতার একটা প্রেক্ষিত দিয়ে , তারা আভাসে জানিয়ে দিচ্ছে যে পাশ্চাত্য
নির্ধারিত শর্তের বাইরেও ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে আধুনিক হওয়া সম্ভব ।
১৯৬০-র দশকে আয়াতোল্লাহ্ রুহোল্লাহ্ খোমিনি (১৯০২-৮৯) (পাহ্ লভী শাসনের বিরুদ্ধে ইসলামী
অভ্যূথ্থানের আধ্যাত্মিক পরামর্শক এবং ইরানের সর্ব্বোচ্চ ফাকিহ্ , ১৯৭৯-৮৯ ) (ফাকিহ্; জুরিস্ট-বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ ) মুহাম্মদ রেযা শাহ্ র বর্বর এবং অসাংবিধানিক
নীতিমালার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্যে ইরানের জনগণকে রাজপথে বের করে আনতে সক্ষম হন ।জনগণ, যারা
সোস্যালিস্টদের বিপ্লবের আহ্বানে হয়ত সড়া দিত না ,তারাও
খোমিনির ডাকে সাড়াদিয়ে, তাদের গভীরতম ট্র্যাডিশনে আলোড়িত হয়ে ছিল ।যার ফলে খোমিনি,শাহ্ এর সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের বদলে, শিয়া বিকল্পের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন ।তিনি সাহসিকতার সঙ্গে অবিচারের বিরুদ্ধে
দাঁড়িয়ে , প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষ নিয়েছেন, তাই তিনি সকল ইমামের মত সক্রিয়
অতীন্দ্রিয়বাদী হিসাবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন খোমিনি ।
সেক্যুলারিস্ট আর বুদ্ধিজীবীরা ও উলেমাদের মত
খোমিনিকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
তাই একমাত্র ইরানি বিপ্লবই বিংশ শতাব্দীর
কোনও আদর্শবাদ অনুপ্রাণিত বিপ্লব (রাশিয়া ও চীনা বিপ্লব উভয়েই কাল মার্কস-এর
ঊনবিংশ শতাব্দীর আদর্শবাদে অনুপ্রাণিত ছিল )
খোমিনি শিয়া মতবাদের একেবারে ভিন্নতর ব্যাখ্যা খাড়া করেছিলেন; গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে একমাত্র করতে পারেন তিনি ।শতাব্দীর পর শতাব্দী দ্বাদশবাদী শিয়ারা
ধর্মীয় ইমামদের সরকারে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে রাখার অবসান করেন খোমিনি তার ইসলামী
বিপ্লবের বা জুরিস্ট-এর ম্যান্ডেট এর মাধ্যমে । তখন ধর্ম এমন এক শক্তিশালী শক্তি হিসাবে
প্রমাণিত হয়েছে যা পাহ্ লভী রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে, যাকে কিনা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী বলে মনে হয়েছিল ।
কিন্তু সকল মৌলবাদীর মত খোমিনির দর্শনও ছিল
বিকৃতিপ্রবণ ।তেহরাণে আমেরিকানদের জিম্মি হিসাবে আটক (পরে এর উদাহরণে
লেবাননের শিয়া চরমপন্থীদের হাতে আমেরিকান বন্দীত্ব) বন্দীদের প্রতি কোরান
নির্দেশিত নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘনঃ বন্দীদের সঙ্গে অবশ্যই মার্যাদা ও সম্মানসূচক আচরণ
করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তি দিতে হবে, আক্রমণকারী পক্ষটিও নিজের হাত থেকেই মুক্তিপণের টাকা দিতেও বাধ্য থাকবে । প্রকৃতপক্ষে কোরান রীতিসিদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি
ছাড়া অন্য সময়ে কাউকে আটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা নিশ্চিতভাবে বৈরী অবস্থার অনুপস্থিতিতে
কাউকে জিম্মি করা অনুমোদন করে না ।বিপ্লবের পর খোমিনি সবরকম ভিন্নমত দমন করেন,মানুষের বাকস্বাধীনতা ও হরণ করেন ।কিন্তু ইসলাম কখনও আদর্শগত সমরূপতার ওপর জোর
না দিয়ে জোর দিয়ছে কেবল চর্চার সমরূপতার ওপর ।ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি কোরানে নিষিদ্ধ । খোমিনির আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা-শিক্ষক
মোল্লা সদরাও (মোল্লা সদরা-শিয়া অতীন্দ্রিয়বাদী দার্শনিক ,যাঁর রচনাবলী ইরানের বুদ্ধিজীবী, বিপ্লবী ও আধুনিকতাবাদীদের অনুপ্রেরণার উৎস
ছিল ।) একে ঘৃণা করতেন ।খোমিনির রূশদির ( দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসের লেখক)
বিরুদ্ধে ফাতওয়াহ্(ইসলামী আইন বিষয়ে ধর্মীয় পণ্ডিতের আনুস্ঠানিক
আইনি মতবাদ বা সিদ্ধান্ত) জারির বিপরিতে, আল-আযহার এবং
সৌদী আরবের উলেমাগণ এই ফাতওয়াহ্ কে অনৈসলামিক ঘোষণা করেন, এবং ইসলামী কনফারেন্সে ৪৯টি সদস্য রাষ্ট্রের
৪৮টি দেশ কর্তৃক নিন্দিত হয়।
কিন্তু এটা হয়ত প্রতীয়মান হয়েছে যে ইসলামী বিপ্লব ইরানি
জনগণকে তাদের মত করে আধুনিকতায় উত্তোরণে সাহায্য করেছে এবং আধুনিক রাষ্ট্রের
চাহিদাসমূহ শিয়াদের গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করেছে ।
\
কিন্তু কোরানের চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত অথচ
বর্তমান পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিতে সক্ষম একটি টেকসই ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণ এখনও
ইরানি জনগণের প্রধান অগ্রাধিকার রয়ে গেছে ।
(শেষ পর্ব) নবীজী(সঃ) এর
ইসলাম , খলিফাহ্ দের
শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
বর্তমান ইসলামী মৌলবাদ ও পশ্চিমা বিশ্ব (২০০১ সাল পর্যন্ত )
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
বর্তমান ইসলামী মৌলবাদ ও পশ্চিমা বিশ্ব (২০০১ সাল পর্যন্ত )
পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে ক্রুসেডের সময় ক্রিশ্চানরাই যেখানে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একাধিক নৃশংস পবিত্র যুদ্ধের সূচনা করেছিল, তখন ইউরোপের শিক্ষিত পণ্ডিত-মনষ্করাই ইসলামকে উৎপত্তিগতভাবে সহিংস এবং অসহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাস হিসাবে বর্ণনা করেছে যা কিনা কেবল তরবারির সাহায্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল । ইসলামের কল্পিতগোড়ামিপূর্ণ অসহিষ্ণুতার কিংবদন্তী পাশ্চাত্যের অন্যতম বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে ।
সুন্নী চিন্তাবিদগণও অনুরূপ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে অজ্ঞতা থেকে ইসলামের প্রতি পাশ্চাত্যের বৈরিতা জন্ম নিয়েছে । সুন্নী নেতা রশিদ আল-গানোচি (Rashid al- Ghannouchi) মতে খ্রিষ্টধর্মের অশুভ অভিজ্ঞতা এর উদ্ভবের কারণ ,যা চিন্তা আর সৃজনশীলতাকে রুদ্ধ করেছিল ।নিজকে তিনি “ গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থী” ঘোষণা করে বলেন যে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মাঝেকোনও অসামজ্ঞস্যতা তিনি লক্ষ্য করেননি ; তবে তিনি পশ্চিমের সেক্যুলারিজমকে প্রত্যাখ্যানকরে বলেছেন, মানুষকে এভাবে বিভক্ত আর টুকরো করা যায় না । তাওহীদের মুসলিম আদর্শ ( তাওহীদঃ-একীকরণ । স্বর্গীয় একত্ব, মুসলিমরা তাদের রীতিনীতি ও অগ্রাধিকার সমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়ে তাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যার অনুকৃতি আনতে চায় । ) দেহ এবং আত্মা, বুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিকতা, নারী ও পুরুষ, নৈতিকতা ওঅর্থনীতি, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বৈততা আস্বীকার করে । মুসলিমরাও আধুনিকতা চায় , কিন্তু সেটা পশ্চাত্য কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া আধুনিকতা নয় । যদিও মুসলিমরা তাদের দক্ষও চমৎকার প্রযুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল । কিন্তু তারা পশ্চিমা সমাজে কোনো আলো দেখতে পান না ,হৃদয় আর আধ্যাত্মিকতার ও কোন চিহ্ন তাদের চোখে পড়ে না পশ্চিমা সমাজে । মুসলিমরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও নৈতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে পাশ্চাত্য-সভ্যতার সেরা কিছু বৈশিষ্ট্য আত্মস্থ করতে চায়।
আল-আযহারের ডিগ্রিধারী এবং মুসলিম ব্রাদার কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সুন্নাহ্ এন্ড শরিয়াহ্ র বর্তমান (২০০০ সাল) পরিচালক ইউসুফ আবদাল্লাহ্ আল-ক্বারাদাওয়ি অনুরূপ চিন্তার অংশীদার হলেও মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী , দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি যে মুসলিম বিশ্বেরসম্প্রতি আবির্ভূত গোঁড়ামি মানুষকে অপরাপর মনুষের অন্তর্দৃষ্টি আর দর্শন থেকে বঞ্চিত করার ভেতর দিয়ে হীনতর করবে । তিনি আরো মনে করেন যে বর্তমান ইসলামী বিশ্বের কোথাও কোথাও চলমান চরমপন্থা মুসলিম চেতনার দূরবর্তী এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না । তিনি জোর দিয়ে বলেন, পাশ্চাত্যকে অবশ্যই মুসলিমদের তাদের ধর্ম অনুসরণ করে জীবন যাপনের অধিকার এবং যদি কেউ চায় তবে তাদের রাজনীতিতে ইসলামী আদর্শ যোগ করার অধিকারও মেনে নিতে হবে । তাদেরকে বুঝতে হবে জীবনযাপনের নানান উপায় আছে, বৈচিত্র্য গোটা বিশ্বকেই লাভবান করে । ঈশ্বর মানুষকে বেছে নেয়ার অধিকার ও ক্ষমতা দিয়েছেন এবং কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্রসহ ধর্মীয় জীবনের পক্ষে মত দিতে পারে , অন্যরা যেখানে সেক্যুলারআদর্শের পক্ষপাতি ।
শত শত বছর ধরে ইসলাম মুসলিম চেতনার সম্মুখ সারিতে সামাজিক ন্যায়-বিচার, সাম্য,সহিষ্ণুতা আর বাস্তব সহমর্মিতার ধারণাকে স্থান দিয়ে এসেছে । কিন্তু মুসলিমরা সবসময় এইসব আদর্শ অনুসরণ করতে পারেনি এবং বারবার এগুলোকে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহে ধারণ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে , তাই এগুলো অর্জনের সংগ্রাম শত শত বছর ধরে ইসলামী আধ্যাত্মিকতার মুখ্য বিষয় রয়ে গেছে ।
পশ্চিমা বিশ্বের সময় সময় বিশেষ ভূমিকা গ্রহনের ফলেই মৌলবাদীদের চিন্তায় ও কাজে নিশ্চিতভাবেই বর্তমান এই পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে; তাই মৌলবাদীদের বর্তমান মৌলবাদ দর্শনের মূলে নিহিত ভীতি ও হতাশা প্রশমিত করার জন্যে উচিৎ তৃতীয় খ্রিস্টীয়সহস্রাব্দে ইসলাম সম্পর্কে অধিকতর সঠিক উপলব্ধি গড়ে তোলা এবং মুসলিম বিশ্বে পশচিমাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের নীতি পরিহার করা। যা মুসলিম বিশ্বে সহিংস মৌলবাদের জন্ম তরান্নিত করেছে ।
অন্যদিকে সেক্যুলার সংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাবের সংশোধনের প্রয়াস চালাতে গিয়ে ও পাল্টা লড়াই আরম্ভ করে ইসলামী মৌলমূল্যবোধ থেকে দুরে সরে যায় এবং মানুষের অন্য যেকোনওকর্মকাণ্ডের মত ধর্মও প্রায়শ অপব্যবহৃত হয় । অতীতে ধর্ম যেমন নৃশংসতার জন্ম দিয়েছে ,সেক্যুলার আক্রমন এবং নিপীড়ন ও প্রায়ই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার জন্ম দিয়েছে । আগ্রাসী সেক্যুলারিজম এমন এক ধার্মিকতার জন্ম
দিয়েছে যা প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাসের অপমান মনে করেছে মৌলবাদীরা, যা গণতন্ত্রের ধারণাকেই কুলুষিত করেছে, বলে ধরে নেওয়া হয়েছে ।
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হলেও যেন এর সীমাবদ্ধতা রয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে । সেপ্টেম্বর-১১, ২০০১ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চরমপন্থী মৌলবাদীদের হামলার ভয়াবহতা আধুনিকতার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের যুদ্ধকে নতুন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে ।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সেপ্টেম্বরের এই প্রলয়কাণ্ডে আতঙ্কে শিউরে উঠেছে এবং যুক্তি দেখিয়েছে যে এই ধরনের নৃশংসতা ইসলামের অধিকাংশ পবিত্র ধারণার পরিপন্থী । কোরান সব রকম আক্রমণাত্মক যুদ্ধবিগ্রহের নিন্দা করে এবং শিক্ষা দেয় যে আত্মরক্ষার লড়াইইএকমাত্র ন্যায় যুদ্ধ ।
কিন্তু ওসামা বিন লাদেন এবং তার অনুসারীরা দাবী করেছে যে ইসলাম আক্রান্ত। তিনি সৌদী আরবের পবিত্র ভূমিতে আমেরিকান বাহিনীর উপস্থিতি, আমেরিকান ও ব্রিটিশ ফাইটার প্লেন থেকে ইরাকে অবিরাম বোমা বর্ষণ ; ইরাকে আমেরিকার নেতৃত্বে আরোপিত অবরোধ , যার ফলে হাজার হাজার বেসামরিক নারী এবং শিশু প্রাণ হারিয়েছে-ইসরায়েলের হাতে শত শতপ্যালেস্টাইনির মৃত্যু, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান প্রধান মিত্র এবং সৌদী আরবের রাজ পরিবারের মত যেসব সরকারকে বিন লাদেন দুর্নীতিবাজ ও নিপীড়ক বলে মনে করেন, যেসব সরকারের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনঃ ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন । যা কোরান বা শরিয়াহ্ য় যার কোনো বিধান নেই ।
মৌলবদীরা যে ট্র্যাডিশনকে রক্ষা করতে চায় তাকেই বিকৃত করতে বসে, সেপ্টেম্বর-১১-এর ঘঠনার চেয়ে আর কোথাও তা এত স্পষ্ট নয় । ধর্মের এমন নিদারুণ অপব্যবহার এর পূর্বে খুবই কম দেখা গে ছে ।মৌলবাদীরা যে ট্র্যাডিশনে রক্ষা করতে চায় তকেই বিকৃত করে বসে, এবং সব মৌলবাদীদের দর্শনের পেছনে ক্রিয়াশীল আতঙ্ক ও ক্রোধ সব সময়ই রয়ে গেছে ।
ইসলামের বিকৃত রূপ নির্মাণ, একে গণতনত্র ও জন্মগতভাবে শুভ মূল্যবোধের প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা এবং মধ্যযুগীয় ক্রুসেডরদের গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হবে বিপর্যয়কর । এটা কেবল বিশ্বে ১.৬ বিলিয়ন মুসলিমকেই ক্ষিপ্ত করে তুলবে না ,বরং তা সত্যের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং অন্যের পবিত্র অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাকেও লঙ্ঘন করবে যা ইসলাম ও পশ্চিমা সমাজ উভয়েই সর্বোত্তম অবস্থায় বৈশিষ্ঠ্যায়িত করে
সূত্র;-ইসলাম-
সংক্ষিপ্ত
ইতিহাস
ক্যারেন
আর্মস্ট্রং, অনুবদ শওকত হোসেন।
ইনতেকাম
After The Phophet-The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam by Lesley Hazleto
ইসলামের জন্ম বিকাশ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
সহায়ক হিসেবে- উইকিপিডিয়া।
ইনতেকাম
— সুব্রত শুভ
এই লেখাটি আমার লেখার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এই লেখাটি আমার
লেখার শেষ পর্বে আগ্রহী পাঠকদের জন্যে যুক্ত করা হলো ৷ (সৌজন্যে এই লেখাটির লেখক
সুব্রত শুভ )
“ইনতেকাম” শব্দের অর্থ প্রতিশোধ। ইনতেকাম নিতে গিয়েই ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দল ও
কোরানের প্রথম রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দলের জন্ম কোন
প্রেক্ষিতে হয়েছে এবং কোরান কীভাবে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয়, শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব কীভাবে শুরু হয় সবকিছুর পেছনে রয়েছে এই ইনতেকাম!
নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবের রাষ্ট্র প্রধান অর্থাৎ খলিফা কে হবে তা
নিয়ে খলিফা পদের দাবীদাররা দ্বন্দ্ব জড়িয়ে পড়েন। খলিফা প্রতিযোগিতার সবাই ছিলেন
নবীজির আত্মীয়: শ্বশুর, মেয়ে জামাইরা, চাচাত ভাই। ফলে নবীজির লাশ ফেলে রেখে চলে খলিফা নির্বাচনের লড়াই। এখানে
স্মরণ রাখা উচিত আত্মীয়তার চাদরে মূলত আরবের গোত্র গত দ্বন্দ্বই আবার মাথা চাঙা
দিয়ে উঠে।
নবী মুহাম্মদ ও সুন্নি মত অনুসারে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর কোরাইশ
বংশের দুই গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের দুই জনের পূর্ব পুরুষ ছিলেন আবদে মনাফ।
আবদে মনাফের দুই পুত্র ছিল: আবদে শামস ও আবদে হাশিম। পরবর্তীতে ক্ষমতার লড়াই চলে
এই গোত্রের মধ্যে। আবদে শামসের মৃত্যুর পর পুত্র উমাইয়া নেতৃত্বের দাবী করলে এই
নিয়ে আবদে হাশিমের সাথে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এর ফলে কোরাইশরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে
যায়: হাশিমী গোত্র ও উমাইয়া গোত্র। মক্কার কাবা গৃহের দায়িত্ব চলে যায় হাশিমী
গোত্রের হাতে অন্যদিকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব যায় উমাইয়া গোত্রের হাতে। কাবা শরীফ
হাত ছাড়া হওয়ায় উমাইয়া গোত্র অর্থের দিক থেকে হাশিমী গোত্র থেকে পিছিয়ে পড়েও
প্রশাসনিক দক্ষতা, কূটনৈতিক বিষয়ে তারা বেশ দক্ষতা অর্জন
করে। ফলে দিনকে দিন হাশিমী ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে বিরোধ বাড়তেই থাকে। এমনকি এক
দলের হাতে অন্যদলের রক্তারক্তি ছিল তৎকালীন স্বাভাবিক ঘটনা। কালের পরিক্রমায়
হাশিমী গোত্রে জন্ম নেয় নবী মুহাম্মদ ও হযরত আলি। হযরত আলি ছিলেন নবীর সবচেয়ে
কাছের মানুষ। সম্পর্কে তাঁর চাচাত ভাই ও মেয়ের ( হযরত ফাতেমা) জামাই ও প্রথম ইসলাম
ধর্ম গ্রহণকারী। যিনি কখনো মূর্তি পূজাও করেন নি।
আলির বীরত্বের জন্যে আলি’কে বলা হতো
Lion Of God. নবী মুহাম্মদ ও খাদিজার সবচেয়ে কাছের
মানুষ ছিলেন হযরত আলি। ইসলাম ধর্ম যখন শিশু ঘরে সেই সময় থেকেই আলি নবী মুহাম্মদের
ইসলাম জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেন। এমনকি কোরাইশরা যখন নবী মুহাম্মদকে হত্যা করার
ষড়যন্ত্র করেছিল তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আলি নবীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। নবীজির সাথে
আলি’র সম্পর্ক কীরূপ ছিল তা বোঝা যায় নবীজির
এই উক্তিতেই-“যে লোক আমার আলিকে দুঃখ দেবে, মনে করো সে আমাকেই দুঃখ দিল, যে লোক আমার আলির বিরুদ্ধাচরণ করবে, মনে করো সে আমারই বিরুদ্ধাচরণ করলো।” এছাড়াও নবীজী যখন স্ত্রীগণের উপর বিরক্ত হয়ে তাদের ত্যাগ করেছিলেন তখন তিনি
বলেছিলেন-“প্রফেটের তরফ থেকে আলি চাইলে যে কোন
নবী-পত্নীকে ডিভোর্স দিতে পারবেন।”
খলিফা ইস্যুতে কথা উঠলে সকল ঐতিহাসিকগণ একটি কথা বলে থাকেন যে, নবী মুহাম্মদ খলিফা নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই। সুতরাং কথাটি স্পষ্ট যে
তিনি চেয়েছিলেন খলিফা নির্বাচন করতে কিন্তু খলিফা নির্বাচন করে যেতে পারেন নাই।
মৃত্যু শয্যায় তিনি কাগজ কলম আনতে বলেছিলেন তখন ওমরের বাঁধার কারণে নবীজি আসলে
কাকে খলিফা করে যেতেন কিংবা নির্দেশ দিতে চেয়েছিলেন তা আর জানার কোন সুযোগ নেই।
ফলে নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে খলিফা পদের ভাগীদাররা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।
আলি যখন তাঁর প্রিয় নবীকে গোসল করাচ্ছিলেন সেই ফাঁকে বৃদ্ধ আবু বকরকে খলিফা
নির্বাচিত করা হয়। এখানে স্মরণ রাখা উচিত ওসমানের মৃত্যুর পর জনগণের তরফ থেকে আলি’কে খলিফা নির্বাচিত করা হোক এমন দাবী ওঠা ছাড়া কোন খলিফাই গণতান্ত্রিক
উপায়ে ক্ষমতায় দখল করে নি। বৃদ্ধ আবু বকরকে প্রথম খলিফা করা হয় উমাইয়া গোত্রের
কাছে যেন ক্ষমতায় আসে সেই লক্ষ্যে। কারণ বৃদ্ধ আবু বকরকে খলিফা করা হলে
স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী ক্ষমতা চলে আসবে উমাইয়া গোত্রের ওমর, ওসমানের হাতে। অন্যদিকে হাশিমী গোত্রের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আলি।
শিয়ারা নবী মুহাম্মদের কন্যা,
আলির
স্ত্রী হযরত ফাতেমা’কে হলি মা হিসেবে গণ্য করেন। যেভাবে
খ্রিস্টানরা মাতা মরিয়মকে হলি মা হিসেবে দেখেন। ফাতেমা বিবি খাদিজা ও নবীর কন্যা
ছিলেন, ছিলেন আলির স্ত্রী এবং ইমাম হাসান-হোসেনের
মা। সে জন্যে তিনি শিয়াদের কাছে পবিত্র মাতা হিসেবে বিবেচিত। নবী মুহাম্মদ মারা
যেতে না যেতেই খলিফার পদ দখলকে কেন্দ্র করে মা ফাতেমা’র ঘরে আগুন দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল ওমর। অথচ ইসলামের প্রথম যুগে বিশ্বাস ও
আইন ছিল যে- যে ব্যক্তি মুসলিম হয়ে অন্য মুসলিমকে হত্যা করবে সে জাহান্নামে যাবে।
এটি ছিল ইসলামের মূল বিশ্বাসের একটি। এবং কোন ব্যক্তি এই কাজ করলে তার কঠিন সাজার
হুকুম ছিল। কিন্তু হযরত ওসমানের সময় হযরত ওমরের পুত্রের হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তির
মধ্য দিয়ে সাম্যবাদ ইসলামের আরেক দফা ভাঙনের সূত্রপাত হয়। হযরত ওমরের পুত্র
ওবায়দুল্লাহ একসাথে তিনটি খুন করে। এর নিহত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন
মুসলিম। সুতরাং স্বাভাবিক নিয়মে সবাই আশা করেছিল ওবায়দুল্লাহ ফাঁসির হুকুম হবে
কিন্তু হযরত ওসমান ওবায়দুল্লাহ’কে বেকসুর
খালাস দেন। অনেকেই ইতিহাস না জেনে কিংবা এক ধরনের কল্পনা প্রসূত ধারণা থেকে বলে
থাকেন যে, ইসলামের সত্যযুগ ছিল চার খলিফার আমল। অথচ
ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার লোভে আরবের গোত্র
দ্বন্দ্ব মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠে। সেই দ্বন্দ্বে আহত হয়ে গর্ভাবস্থায় মারা যান নবী
মুহাম্মদের কন্যা হযরত ফাতেমা। ওমর ফাতেমার ঘরে ঢোকার জন্যে দরজায় জোরে লাথি
মারেন। দুর্ভাগ্যবশত এই লাথিতে আহত হোন ফাতেমা। পরবর্তীতে তিনি তাঁর স্বামী’কে বলে যান-তিনি মারা গেলে তাঁর দাফন যেন অতি গোপনে করা হয় তাতে ওমরের মতন
লোক তাঁর জানাজায় অংশ নিতে না পারে। পরবর্তীতে তার নির্দেশ অনুসারেই রাতের আঁধারেই
তাঁকে দাফন করা হয়। বনু হাশেমের গোত্রের মানুষ ছাড়া খুব কম সংখ্যক সাহাবী জানাজায়
শরীক হোন। এখানে পয়েন্ট করর বিষয় হল;
অন্য
খলিফাদের দাফন নবীর কবরের পাশে হলেও ফাতেমার কবর হয় অন্যত্র। (রাতের আঁধারে কবর
দেওয়ার প্রসঙ্গে ভিন্ন মত আছে অনেকেই বলেন যে;
তিনি
লজ্জাবতী ছিলেন তাই ওনার কবরে যাতে বেশি মানুষ না আসে তার জন্যে রাতের আঁধারে করব
দেওয়া হয়।) এছাড়াও আবু বকরকে খলিফা করায় আলি,
ফাতেমা
অসন্তুষ্ট হোন। পরবর্তীতে পিতার সম্পত্তির ভাগ চাইলে আবু বকর ফাতেমাকে বলে দেন যে, এই সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় ভাবে দান করা হয়েছে। সুতরাং এই সম্পত্তির ভাগ তিনি
ফাতেমাকে দিতে পারেন না।
হযরত আয়েশা ছিলেন নবীজির পুরাতন সাহাবি আবু বকর-এর কন্যা। আয়েশা ছিলেন
সুন্দরী অহংকারী মহিলা। কিন্তু সেই অহংকারেও চূর্ণ হয় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। গলার
প্রিয় হার খুঁজতে গিয়ে তিনি তিনি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাঁকে ফেরে রেখেই
সবাই চলে যায়। সেই সময় সাফওয়ান নামক এক সাহাবির সাথে দেখা হয়। কারণ সাফওয়ান ছিলেন
কাফেলার পেছনে আসা শেষ মানুষ। সাফওয়ান নবীর স্ত্রীকে চিনতে পারেন এবং নিজের উঠের
পিঠে করে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ২০ মাইল দূরে মধ্যরাতে আয়েশা নিজের দলে এসে পৌছাতে
সক্ষম হোন। আয়েশা যে মিসিং ছিলেন তা কেউ খেয়ালই করে নি। কিন্তু দেরি করে ফিরে আসা
নিয়ে অনেকে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে থাকেন। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবে যে
হযরত আয়েশা ছিলেন পবিত্র ও নির্দোষ। কিন্তু আরবের লোকেরা নবী পত্নী হওয়ার পরও
আয়েশার নামে কুৎসা রটানো বন্ধ করে নাই। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলি ও ফাতিমা আয়েশা’কে ডিভোর্স দিওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু নবীজি তা দেন নি। এরপর প্রায় এক মাস
পর নবীজি ঘোষণা করলেন যে, আল্লাহ বলেছেন- যে ব্যক্তি নবী পত্নীর
বিরুদ্ধে অহেতুক কুৎসা রটনা করবে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এবং কোন অভিযোগ করতে করলে
কম করে চারজন ব্যক্তি সাক্ষী হিসেবে থাকতে হবে। বর্তমান শরিয়া আইনে যে চারজন পুরুষ
সাক্ষীর কথা বলা হয় তা এই ঘটনা থেকে ধার করা কিংবা এই ঘটনা থেকে শরিয়া আইনটি করা
হয়। যদিও আয়াতটি ছিল এক অসহায় নির্দোষ নারীকে অপবাদ করা থেকে রক্ষা করার
উদ্দেশ্যে। কারণ চারজন মানুষের সামনে বা সাক্ষী রেখে কেউ অপরাধ করবে না সুতরাং
বর্তমানে যারা শরিয়া আইনের পক্ষে কথা বলে তারা আসলে অপরাধীর পক্ষেই কথা বলছে। যাই
হোক আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি।
পূর্বের সূত্র ধরেই মনমালিন্যের কারণে হযরত আয়েশা কখনো চান নি হযরত আলি
খলিফা হোক। পরবর্তীতে আবু বকর মারা যাওয়ার পর আবু বকরের একজন বিধবা স্ত্রী’কে বিয়ে করেন এবং সে ঘরের পুত্র সন্তান যার নামও ছিল মুহাম্মদ তাকে পুত্র
হিসেবে আলি গ্রহণ করেন। সম্পর্কের হিসাবে আলি ও আয়েশা মেয়ের জামাই-শাশুড়ি আবার
অন্যদিকে কন্যা-পিতার সম্পর্কেও জড়িয়ে যায়। তবে তৎকালীন আরব সমাজে এটি স্বাভাবিক
একটি প্রথা হিসেবে বিবেচিত ছিল। তবে শিয়ারা হরত আয়েশাকে পবিত্র নারী হিসেবে জ্ঞান
করে না। তারা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে যে,
আয়েশা যদি
শুদ্ধতম নারী হতেন তাহলে আল্লাহ তাঁকে শাসন করার জন্যে সুরা নাজিল করতেন না। তার
নামে কুৎসা রটানোর সাহসও কেউ পেত না। তাই নবীর পরিবার বলতে শিয়ারা ফাতেমার
পরিবারকে বুঝিয়ে থাকেন। এই বিষয়ে রেফারেন্স হিসেবে নবীজির বিভিন্ন উক্তি, ঘটনার বর্ণনা ও হাদিস রেফারেনস হিসেবে তারা ব্যবহার করে থাকে।
ওমর মারা যাওয়ার আগে নিজের স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার জন্যে ওমর
খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আব্দুর রহমান বিন আউফ ও তার ওমরের পুত্র
আব্দুল্লাহ হাতে। তারা যখন ষড়যন্ত্র করে নবী মুহাম্মদের দুই কন্যার স্বামী সত্তর
বয়স্ক ওসমানের নাম ঘোষণা করেন তখন হযরত আলি চিৎকার করে বললেন-নাহ আমি মানি না, এটা প্রহসন, ধর্মের নামে মিথ্যাচার, অন্যায়, এটা প্রতারণা। ওসমানের শাসন আমলে আরবে
বিদ্রোহ মাথা চাঙ্গা দিয়ে উঠতে থাকে। স্বজনপ্রীতি,
দুঃশাসনের
কারণে সাধারণ জনতা ওসমানের বাড়িও ঘেরাও করে। এতো কিছু পরও ওসমান ক্ষমতা হস্তান্তর
কিংবা ক্ষমতা ছাড়ার জন্য রাজি হয় নাই। ফলে আততায়ীর হাতেই নিজ ঘরে খুন হোন ওসমান।
ওসমান খুন হওয়ার পর গুজব কিংবা লোক কানাকানি ছড়িয়ে পড়ে যে এই হত্যায় আলির হাত
রয়েছে। আলি-পন্থীরা যে সিংহাসন দখলের জন্যে ২৫ বছর সংগ্রাম করল নির্যাতন সহ্য করল
তাদের সেই ক্ষমতা দখলের সময় খুব সুখকর ছিল না। কারণ একদিনে জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ
অন্যদিকে ওসমানের বিচারের দাবী। আবার ওসমানকে যারা হত্যা করেছে তাদের একটা বড় অংশ
আলির সাথে যোগ দিয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আলি ক্ষমতা আরোহণ খুব সুখকর ছিল না।
এখানে স্মরণ রাখা উচিত যে, ইতোমধ্যে
আরবের আশে পাশের সব জায়গা, এছাড়া রাজ্য পরিচালনার বড় বড় পদ সবগুলো
মক্কার উমাইয়া গোত্র দখল করে নেয়। ফলে মদিনার মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়
এছাড়া হাশিমী গোত্রের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আলি। সিরিয়ার শাসন মুয়াবিয়া ছিলেন
যেমন চতুর তেমনি ক্ষমতাধর মানুষ। তার পরামর্শেই মূলত ওসমান শাসন কাজ পরিচালন
করতেন। মুয়াবিয়া ছিলেন আবু সুফিয়ানের সন্তান। মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর এক
প্রকার বাধ্য হয়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।এছাড়া নবী মুহাম্মদের দলের
হাতেই খুন হোন সুফিয়ানদের অন্য সদস্যরা। মুহাম্মদের দলের হাতে আবু সুফিয়ান গোত্রের
পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো ভোলে নি। এই কারণেই নবী বংশ ধ্বংস না করা পর্যন্ত
মুয়াবিয়া বংশ শান্ত হয় নাই। মুয়াবিয়া সুদর্শন,
চতুর, বুদ্ধিমান ছিলেন ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন।
মুয়াবিয়া ঠিকই জানতেন পৃথিবীর সবাই মুয়াবিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিলেও আলি কখনো মেনে
নেবে না। অন্য দিকে আলিও জানতেন মুয়াবিয়া তাকে ছেড়ে দেবে না। বনু হাশিম ও
উমাইয়াদের মধ্যে কীরূপ দ্বন্দ্ব ছিল তা জানার জানা প্রয়োজন-আবু সুফিয়ানের জোয়ান
ছেলে নবী মুহাম্মদের বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ায় সেই খুনের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন
পুত্রহারা মা হিন্দা। উহুদ যুদ্ধে নবী মোহাম্মদের চাচা আমীর হামজার লাশ কেটে কলিজা
বের করে চিবিয়ে খেয়েছিল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মুয়াবিয়ার মা হিন্দা। তাই আলি জানত
ষড়যন্ত্র করে হোক কিংবা যুদ্ধ করে হোক সে আলিতে পরাজিত করতে চাইবে। অনেকে প্রশ্ন
করে যে; ওসমান খুনের বদলা নেওয়াকে কেন্দ্র করে
হযরত আয়েশা ও হযরত আলীর মধ্যে যে যুদ্ধ হল তখন মুয়াবিয়া নীরব ভূমিকা পালন করল কেন? এর উত্তর খুন সহজ। কারণ যুদ্ধটা হচ্ছে নবীর পরিবারের মধ্যে তাই মুয়াবিয়া
তাদের হানাহানিতে না জড়িয়ে রক্তপাত দেখেছিলেন মাত্র। আলি ও আয়েশার যুদ্ধ ইতিহাসে
উঠের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। সেই যুদ্ধে আয়েশা পরাজিত হোন এবং নিজের কর্মের জন্যে
আলির কাছে ক্ষমা চান। সেই যুদ্ধে সাহাবিরা অংশগ্রহণ করেন এবং নিহত হোন। তবে জামাল
যুদ্ধের দায় নিতে হয় শেষ পর্যন্ত আলিকেই। ইসলামের ইতিহাসে জামাল যুদ্ধ প্রথম ও শেষ
যুদ্ধ যেখানে একজন নারীর নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল আরব পুরুষরা।
৬৫৭ সালের জুলাই মাসে সিরিয়ার সিফফিনের ময়দানে আলির বিপরীতে যুদ্ধে নামে
মুয়াবিয়া। সেই যুদ্ধে আলি থেকে কুট কৌশল ও সামরিক সৈন্যে আলি থেকে মুয়াবিয়ার শক্তি
বেশি হলেও সেই যুদ্ধে আলি জয়ের পথেই ছিলেন। আলি মুয়াবিয়া থেকে বড় যোদ্ধা হলেও
কূটকৌশলে তিনি দক্ষ ছিলেন না। তিনি বড় যোদ্ধা ছিলেন কিন্তু বড় রাজনৈতিক নেতা নন।
ফলে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে মুয়াবিয়া তার শেষ অস্ত্র ধর্মের আশ্রয় নিলেন। মুয়াবিয়ার
সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরানের পাতা লাগিয়ে যুদ্ধ করতে নামলো। এতে আলীর বাহিনীর
মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী কুরান সামনে রেখে যুদ্ধ করতে নামায়
আলীর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তারা মুয়াবিয়ার কথা ফাঁদে পড়ে
মুয়াবিয়ার সুরে যুদ্ধ বন্ধ করে কোরানের মাধ্যমে সমাধানের পথে এগুতে বলেন।
মুয়াবিয়াও তখন নিজের কিছু লোক আলির শিবিরে পাঠিয়ে ওসমান হত্যাকারীদের বিচারেরও
দাবী তোলেন। কারণ মুয়াবিয়া জানতেন এই খুনে আলির হাত না থাকলেও বর্তমানে আলির
শিবিরের অনেকেই ওসমান হত্যায় জড়িত। একদিনে ওসমান হত্যার দাবী অন্যদিকে কোরানের
মাধ্যমে সমাধানের দাবী সব কিছু মিলিয়ে আলি বুঝে গেছেন তিনি ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন।
তিনি তার লোকদের যতোই বোঝেতে চেষ্টা করছেন যে আর কিছুক্ষণ যুদ্ধ করলে আমরা জিতে
যাব। মুয়াবিয়া একটা শয়তান। সে ছলনা করে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছে কিন্তু সে সময় কেউ
আলির কথা শুনল না। আলি মুয়াবিয়ার অতীত ইতিহাস সবাইকে স্মরণ করতে অনুরোধ জানান।
তারপরও তার সৈন্যরা যুদ্ধ করতে আর রাজা হল না। ফলে মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করতে
বাধ্য হলেন আলি। এবং এই কারণে পরবর্তীতে আলীর রাজনৈতিক ও ক্ষমতার পরাজয় ঘটে।
সিফফিনের ময়দানে মুয়াবিয়ার হাতেই হয় প্রথম কোরানের রাজনৈতিক ব্যবহার। মুয়াবিয়ার
সাথে সন্ধির কারণে আলির পক্ষ অনেকেই ত্যাগ করেন তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাব
অন্যতম।
ইসলামের প্রথম উগ্রবাদী দল খারিজি:
ওসমান কে পছন্দ না করলেও ওসমান হত্যায় আলির সমর্থন ছিল না, এমনকি ওসমানকে রক্ষা করার জন্যে একসময় আলি নিজের ছেলেদের ওসমানের কাছে
পাঠান। কিন্তু ওসমান হত্যা পরবর্তীতে ওসমানের হত্যাকারীদের অধিকাংশ আলিকে সমর্থন
করে থাকায় ওসমান হত্যায় আলি জড়িত এমনই একটা ধারনা মানুষের মধ্যে জন্ম নেয়। যদিও
আলি ক্ষমতায় বসার ইচ্ছুক ছিলেন না কারণ তিনি জানতেন তিনি ক্ষমতায় বসলে ওসমান
হত্যায় তাঁকে পরোক্ষভাবে জড়িত করা হবে তাই তিনি প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে
সবার চাপে পড়ে ক্ষমতা গ্রহণে সম্মত হোন। মুয়াবিয়া নিজের স্বার্থে আলির বিরুদ্ধে
নিজের পক্ষে মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্যে নিহত ওসমানের রক্তাক্ত পাঞ্জাবী ও তার
স্ত্রীর কাটা আঙ্গুলের অংশ জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখেন। মুয়াবিয়ার কৌশলের কাছে আলি
পরাজিত হোন এবং নিজের দলের লোকদের চাপে পড়ে তিনি সন্ধি করতে সম্মত হোন। সেই সময়
আলি পক্ষের একটি অংশ আলি ভুল করেছেন বলে আলির দল থেকে বেরিয়ে যান। তারাই খারিজি (Those who go out) নামে পরিচিত। হযরত আলি ভুল করেছেন এটাই
ছিল তাদের যুক্তি। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে এমন ধারণা জন্মায় যে; পাপী ব্যক্তি শাসক হওয়ার অযোগ্য। আলি যেহেতু মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেছেন
সেহেতু আলি নিজেও অযোগ্য হয়ে গেছেন। তারা এতোটাই চরমপন্থী অবস্থায় চলে গেছে যে
তারা অন্য মুসলিমদের কাফের হিসেবেও আখ্যায়িত করা শুরু করে। তারা মনে করতো যে পাপ
হল কুফর অর্থাৎ আল্লাহকে অবিশ্বাস করা। সুতরাং কেউ পাপ করলে পাপের ফলে সে
অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এই ধরণের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে এদের হত্যা করা যাবে।
এমনকি এরা যদি নবীজির সাহাবিও হোন তারপরও এদের হত্যা করা যাবে। এরা এতোটাই উগ্র
ছিল যে এদের সাথে কেউ যদি একমত না হতো তাহলে তাদের কাফের এবং তাদের হত্যার করতে
এদের একটুও বাঁধত না। বলা হয়ে থাকে এসব খারিজিরা বেশির ভাগ ছিল বেদুইন ও অশিক্ষিত।
এরা কোরান হাদিস সম্পর্কে খুব একটা বুঝত না। কিন্তু এরা সংখ্যায় কম হলেও চেতনায়
এতোটাই উন্মাদ ছিল যে এদের অগ্রাহ্য করা কোন শাসকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে আলি
এদেরকে নিজের দলে আনার চেষ্টা করেন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে চিঠিও লেখেন। খারিজিরা
উল্টো আলিকে জবাব দেয়; আলি আপনি নিজেই কোরান বোঝেন না।
খারিজিদের হারুবিয়াহ নামেও উল্লেখ করা হয়। কারণ আলির বিরুদ্ধে প্রথম
বিদ্রোহের আওয়াজ তোলা হয় হারুবা নামক স্থানে তাই তাদেরকে অনেকে হারুবিয়া নামেও
অভিহিত করা হয়। আলির দল ত্যাগ করে খারিজিরা আব্দুল্লাহ ইবন ওয়াহাবকে তাদের দলপতি
নির্বাচিত করে। এবং পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে নাহরাওয়ান নামক স্থানে তারা শিবির
স্থাপন করে। তারা সেখান থেকে আলির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত
বাধ্য হয়ে খারিজিদের সাথে আলিকে যুদ্ধ করতে হয়। সেই যুদ্ধে খারিজিদের দলপতি সহ
অনেক খারিজি নিহত হয়। প্রাণে বাঁচে মাত্র ৪'শ জন।
বতর্মানে জঙ্গিরা যেভাবে বেহেস্তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শরীরে বোমা নিয়ে হামলা করে
খারিজিরা ঠিক একই ভাবে যুদ্ধের ময়দানে উচ্চারণ করেছিল- Hasten to Paradise! to
Paradise! পরবর্তীতে খারিজিরা সিরিয়ার শাসক মুয়াবিয়া,
ও তার
উপদেষ্টা মিশরের শাসনকর্তা আমর ইবন আস কে হত্যার চেষ্টা চালায়। সৌভাগ্যক্রমে তারা
দুইজন নিহত না হলেও হযরত আলী মসজিদ থেকে আসার পথে খারিজি আব্দুর রহমান ইবন
মুলযিমের হাতে নিহত হোন। খারিজিরা এতোটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল যে, পরবর্তীতে উমাইয়া, আব্বাসিয় শাসকরা এদের যন্ত্রণায় অস্থির
ছিলেন। তারা মেসোপটেমিয়া পূর্ব আরব ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলে অশান্তির সৃষ্টি করে।
অবশেষে মিসরের ফাতেমি শাসনগণ খারিজিদের শক্তি সমূলে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে
রাজনৈতিক প্রচারণা বর্জন করে তারা শুধু একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
মুয়াবিয়ার, খারিজির ইতিহাস অনেক পুরাতন হলেও তাদের
অনুসারীরা এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন-সিরিয়াস ISIS সালাফি সুন্নি দল হলেও তারা খারিজিদের মতন বাংলাদেশের আরেক জামাত-ই-ইসলামকে
ইসলামের শত্রু কাফের হিসেবে তারা তাদের ম্যাগাজিন-এ উল্লেখ করেছে। যেমনটি করেছিল
খারিজিরা। এছাড়াও বাংলাদেশের মতন পৃথিবীর অনেক দেশেই বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী
তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও স্বার্থ হাসিল করার জন্যে কোরানকে সামনে নিয়ে আসে। ঠিক
যেমনটি করেছিল মুয়াবিয়া সিফফিনের ময়দানে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ইসলামিক রাজনৈতিক
দলগুলো খারিজিদের মতন একই ধরণের ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাদের মতের মতন না হলে সে কাফের
কিংবা প্রকৃত মুসলমান নয় এমন তত্ত্ব তারা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের জামাত শিবির, ওহাবীপন্থী, আহলে হাদিস দলগুলোকে অনেকে খারিজিদের
বংশধর মনে করে থাকে। বাংলাদেশে শিয়া-সুন্নির বিরোধ নেই।কিন্তু আরব অঞ্চলে শিয়া
সুন্নির মধ্যে যে বিরোধ এবং অন্যকে অস্বীকার করার যে প্রবণতা তা বুঝতে গেলে
ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। তাকাতে হবে শত বছরের পুরনো ইনতেকামের দিকে।
সহায়ক
গ্রস্থ-
After The Phophet-The Epic Story of the Shia-Sunni Split in Islam by Lesley Hazleto
ইসলামের জন্ম বিকাশ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র।
সহায়ক হিসেবে- উইকিপিডিয়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন