নবীজী(সঃ) এর ইসলাম , খলিফাহ্ দের শাসন এবং শিয়া ও সুন্নী ধারার
বিকাশের প্রাথমিক কাহিনী প্রসঙ্গে
ষষ্ঠ
ইমাম জাফর আল-সাদিক(মৃত্যু-৭৬৫) নাসের মতবাদকে উন্নত এবং নিশ্চিত করে ঘোষণা দেন যে
যদিও নির্বাচিত ইমাম হিসাবে তিনিই উম্মাহ্র প্রকৃত নেতা, কিন্তু তিনি তাঁর প্রজন্মকে স্বর্গীয় ইলম্ শিক্ষা দেবেন এবং কোরানের বাতিন
পাঠে পথনির্দেশনা যোগাবেন, কিন্তু শিয়াদের অবশ্যই তাদের সব
মতবাদ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস গোপন রাখতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমের আরও
সহজগম্য ধার্মিকতার প্রয়োজন ছিল এবং তারা এক নতুন ধরনের ভক্তি আবিস্কার করে যা ঐ আমলে
ব্যাপকতা লাভ করে। এটা জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তিবাদের অনুরূপ,যেহেতু এখানে কোরানকে ঈশ্বরের অনির্মিত(uncreated word) হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা অনন্তকাল ধরে তাঁর
সঙ্গে অস্তিত্ববান ছিল ইত্যাদি , এ বক্তব্য মুতাযিলাদের
আতঙ্কিত করে তুলেছিল, এটা তাদের যুক্তিনির্ভর ধার্মিকতা এবং
ঈশ্বরের একত্ব এবং পরম সরলতার ধারণাকে আক্রান্ত করেছিল। কিন্তু
গুপ্ত শিয়া ও মুতাযিলা মতবাদ সংখ্যালঘু বুদ্ধিজীবীদের বিষয় ছিল। কোরানের
প্রতি এই ভক্তির অনুসারীগণ আহ্লল আল-হাদিস বা হাদিসের জনগন
নামে পরিচিতি পায় ৷ তারা জোর দিয়ে বলেছে মুসলিমদের আইনকে
অবশ্যই পয়গম্বরের আদর্শ এবং সুন্নাহ্ এবং ‘প্রত্যক্ষদর্শীর’র ভিত্তিতে প্রণীত হতে হবে। তারা আবু হানিফাহ্ র অনুসারীদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ
করেছে ৷ যিনি মনে করেছিলেন যে জুরিস্টদের ‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগের’ (ইজতিহাদ) ক্ষমতা ব্যবহার
করা আবশ্যক । তাঁর যুক্তি ছিল যে তাঁদের অবশ্যই নতুন নতুন আইন
নির্মাণের স্বাধীনতা থাকতে হবে যদি তারা কোন ও হাদিস বা কোরানের
কোনও উচ্চারণের ওপর নির্ভর করতে না পারেন তবে ইজতিহাদের উপর নির্ভর করতে হবে তাদের ।
আহল
আল-হাদিস’রা ছিল রক্ষণশীল ; সকল
রাশিদুনকে বা প্রথম চার খলিফাহ্ এমনকি মুয়াবিয়াহ্ কে ও শ্রদ্ধা করত তারা ৷ মুতাযিলাদের বিপরিত কাজ ছিল এটা । যার ফলে তাদের প্রতি হারূন আল-রশিদেরও সমর্থন ছিল। তাই মুতাযিলারা খলিফাহ্ র সু- নজর থেকে বঞ্চিত হয়ে কারাগারেও যেতে হয়েছে মুতাযিলাদের । এর প্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যে এক ধরনের
বিভেদ সৃষ্টি হয় । ফিকহ্’র বিকাশে উৎসাহিতরা উমাঈয়াদের অধীনে
প্রত্যেক শহরে আলাদা নিজস্ব ফিকাহ্ কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং উলেমাদের মধ্যেও একটা আলাদা শ্রেণীও
আবির্ভূত হতে শুরু করে তখন । তখন দু’জন অসাধারণ আলিম চিরন্তন অবদান রেখে
গেছেন । এর একজন মদীনায়
মালিক ইবন আনাস(মৃত্যু-৭৯৫) ৷এবং তাঁর সংকলিত গ্রন্থের নাম আল-মুতাওয়াত্তাব(The
Beaten path) ৷ এটা ছিল মদীনার প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশীলনের
বিস্তারিত বিবরণ ৷ যা পয়গম্বরের সমাজের মূল বা আদি সুন্নাহ্ ধরে রেখেছে বলে মালিকের বিশ্বাস
ছিল । মালিকের অনুসারীরা তাঁর ধর্মতত্ত্বকে মালিকি মতবাদ(মাযহাব) হিসাবে পূর্ণাঙ্গ
করে তুলেছিল ৷ যা মদীনা, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকায় বিস্তার লাভ
করে। কিন্তু অন্যরা একথা মানেত চায়নি যে বর্তমান
কালের মদীনা আদি ইসলামের পথে সত্যই নির্ভরযোগ্য পথপ্রদর্শক হতে পারে ।
অন্য
আর এক আলিম বা পণ্ডিত
ব্যক্তি ছিলেন মুহাম্মদ ইদ্রিস ইবন আল-শাফী(মৃত্যু-৮২০) ৷ তিনি
যুক্তি তুলে ধরেন যে মাত্র একটি ইসলামী শহরের ওপর নির্ভর করা নিরাপদ নয় এর মর্যাদা যতই উন্নত হোক না কেন । তার পরিবর্তে সকল
জুরিসপ্রুডেন্সের ভিত্তি হওয়া উচিত পয়গম্বর সম্পর্কিত আহাদিস বা হাদিসসমূহ ৷ যাঁকে কেবল কোরানের প্রচারক হিসাবে নয় বরং অনুপ্রাণিত ব্যাখ্যাকারী হিসাবে
দেখা উচিত । ফলে ঐশীগ্রন্থের নির্দেশ ও অইন-কানুন এবং মুহাম্মদ(সঃ)এর বাণী সহ তাঁর কর্মধারার আলোকে
উপলব্ধি করা যেতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বললেন যে প্রত্যেকটা
হাদিসকে অবশ্যই নির্ভরযোগ্যভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের একটি পরস্পরা(ইসনাদ) দ্বারা
স্বয়ং পয়গম্বর অবধি সমর্থিত হতে হবে । আল-শাফী আহল আল-হাদিস এবং ইজতিহাদের
প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপকারী আবু হনিফাহ্র মত জুরিস্টদের মাঝে মধ্যস্থতার
প্রয়াস পেয়েছিলেন ;
শাফী একটা মাত্রা পর্যন্ত ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছিলেন ; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন একে অবশ্যই পয়গম্বরের রীতি আর সমসাময়িক আচার অনুষ্ঠানের কঠোর মিলের (কিয়াস)মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। শাফী শিক্ষা দিয়েছেন যে পবিত্র আইনের(উসুল আল-ফিকাহ্ র) চারটি ‘মূল’ রয়েছে : কোরান, পয়গম্বরের সুন্নাহ্ (analogy) এবং ইজমাহ্ সমাজের ‘ঐকমত্য’ (consensus)।
ঈশ্বর সমগ্র উম্মাহ্ কে ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হতে দিতে পারেন না সুতরাং কোনও আচার যদি সকল মুসলিম কর্তৃক গৃহীত হয় তবে তাকে অবশ্যই সঠিক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ যদি এর সমর্থনে কোরানের কোনও সূত্র বা হাদিস নাও পাওয়া যায় । যদিও ইহা পয়গম্বরের সুন্নাহ্ র কঠিন ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিশ্চিত করার উপযুক্ত ছিল না - কিন্তু এতে করে গভীর এবং সন্তোষজনক ধর্মীয় অনুভূতি দানকারী একটা জীবনধারা নির্মাণের অবলম্বন পেয়েছিল মুসলিমরা ।
শাফী একটা মাত্রা পর্যন্ত ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েছিলেন ; কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন একে অবশ্যই পয়গম্বরের রীতি আর সমসাময়িক আচার অনুষ্ঠানের কঠোর মিলের (কিয়াস)মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। শাফী শিক্ষা দিয়েছেন যে পবিত্র আইনের(উসুল আল-ফিকাহ্ র) চারটি ‘মূল’ রয়েছে : কোরান, পয়গম্বরের সুন্নাহ্ (analogy) এবং ইজমাহ্ সমাজের ‘ঐকমত্য’ (consensus)।
ঈশ্বর সমগ্র উম্মাহ্ কে ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হতে দিতে পারেন না সুতরাং কোনও আচার যদি সকল মুসলিম কর্তৃক গৃহীত হয় তবে তাকে অবশ্যই সঠিক হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ যদি এর সমর্থনে কোরানের কোনও সূত্র বা হাদিস নাও পাওয়া যায় । যদিও ইহা পয়গম্বরের সুন্নাহ্ র কঠিন ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিশ্চিত করার উপযুক্ত ছিল না - কিন্তু এতে করে গভীর এবং সন্তোষজনক ধর্মীয় অনুভূতি দানকারী একটা জীবনধারা নির্মাণের অবলম্বন পেয়েছিল মুসলিমরা ।
আল-শাফীর
অসাধারণ কাজের ফলে অন্য পণ্ডিতগণ তাঁর মানদণ্ড অনুযায়ী আহাদিস গবেষণায় উৎসাহিত হয়ে
ওঠেন। আল-বুখারি(মৃত্যু ৮৭০) এবং মুসলিম(মৃত্যু-৮৭৮) দু’টি নির্ভরযোগ্য এবং কর্তৃত্বপূর্ণ সংকলন সম্পাদন করেন যা ফিকাহ্’র প্রতি আগ্রহ জোরালো ক’রে এবং শরিয়াহ্ আইনের ভিণ্ডিতে
এক বিশাল ইসলামী সমরূপ ধর্মীয় জীবন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে।
মুসলিমরা আজও গভীরভাবে শরিয়াহ্ কে আঁকড়ে রেখেছে যা তাদের খুবই গভীর স্তরে মুহাম্মদের(সঃ) আদর্শ চরিত্রকে আত্নীকরণে সাহায্য ক’রে ৷ এবং তাঁকে সপ্তম শতাব্দী থেকে তুলে এনে তাদের জীবনে জীবন্ত সত্তা এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে । তবে শরিয়াহ্ ও রাজনৈতিক যা রাজদরবারের আভিজাত্য ও বিশেষ প্রথা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে তা কিন্তু খলিফাহ্ দের ক্ষমতাকে সীমিত করেছে ৷ এবং জোরের সঙ্গে বলেছে তাঁদের ভূমিকা পয়গম্বর বা রাশিদুনের অনুরূপ নয়।
মুসলিমরা আজও গভীরভাবে শরিয়াহ্ কে আঁকড়ে রেখেছে যা তাদের খুবই গভীর স্তরে মুহাম্মদের(সঃ) আদর্শ চরিত্রকে আত্নীকরণে সাহায্য ক’রে ৷ এবং তাঁকে সপ্তম শতাব্দী থেকে তুলে এনে তাদের জীবনে জীবন্ত সত্তা এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করে । তবে শরিয়াহ্ ও রাজনৈতিক যা রাজদরবারের আভিজাত্য ও বিশেষ প্রথা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে তা কিন্তু খলিফাহ্ দের ক্ষমতাকে সীমিত করেছে ৷ এবং জোরের সঙ্গে বলেছে তাঁদের ভূমিকা পয়গম্বর বা রাশিদুনের অনুরূপ নয়।
হারূন
আল-রশিদ সাম্রাজ্যকে দুই পুত্রের ভাগ করে দিলেও গৃহযুদ্ধ (৮০৯-১৩)বন্ধ হয় নাই। আল-মামুন (৮১৩-৩৩) বিজয়ী হয়ে
শাসন শুরু করেন ,তখন একটা রাজদরবারের অভিজাত গোষ্ঠী,
অন্যটি শরিয়াহ্- ভিত্তিক সাম্যবাদী এবং সংবিধানবাদী গোষ্ঠীতে ভাগ
গেছে সাম্রাজ্য । তিনি মুতাযিলাদের প্রতি আগ্রহ দেখালে,মুতাযিলারা আহল আল-হাদিসের ওপর চড়াও হয়, নেতৃস্থানীর
হাদিসপন্থীরা করাবদ্ধ হন ,এবং জনপ্রিয় আহমদ ইবন
হানবাল(মৃত্যু ৮৩৩-এ) পরিণত হন গণমানুষের নেতায়। আল-মামুন
এক পর্যায়ে , শিয়াদের অষ্টম ইমাম আলী আল-রিদাকে উত্তরাধিকারী
ঘোষণা ক’ রেও সাধারণ নাগরিকের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। খলিফাহ্ আল-মুতাসিম(৮৩৩-৪২) সময়ে
অসংখ্য সশস্ত্র বিদ্রোহ ও সংঘটিত হয়। তখন তুর্কিরা ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
এই
রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদের সময়কালে সুন্নী ইসলাম নামে পরিচিতি হয়ে ওঠা অংশটি
শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন আইনবিদ , মুতাযিলা এবং আহল আল-হাদিস তাদের মতভেদ বিসর্জন দিয়ে পরস্পরের কাছাকাছি হয়। এই প্রক্রিয়ায় একজন
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন আবু আল-হাসান আর-আশারি(মৃত্যু-৯৩৫) ৷ যিনি মুতাযিলা এবং হাদিসপন্থীদের থিয়োলজি সমন্বিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নিয়ম
বলে কিছু নেই ; ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ নির্দেশে প্রতিমূহূর্তে
বিশ্বজগত সংগঠিত হচ্ছে। স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই ; ঈশ্বর যতক্ষণ তাদের মাঝে এবং মাধ্যমে চিন্তা না করছেন ততক্ষণ নারী বা
পুরুষ কোনও কিছু ভাবতে পারে না ; আগুন জ্বলে তার বৈশিষ্ট্য বলে নয় বরং তা ঈশ্বর ইচ্ছা করেছেন বলে। পরে আশারিবাদ সুন্নী ইসলামের
প্রভাবশালী দর্শনে পরিণত হয়েছিল। এই দর্শন শরিয়াহ্ র চেতনার সঙ্গেও মানানসই ছিল।
দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ এই শরিয়াহ্ ভিত্তিক ধার্মিকতা গোটা সাম্রাজ্য
জুড়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। মোট
চারটি স্বীকৃত আইন মতবাদ বা মাযহাব রয়েছে যার প্রতিটিই মুসলিম সাম্যবাদী দৃষ্টিতে
সমভাবে বৈধ ; হানাফি , মালিকি ,
শাফীই , এবং হানবালি মতবাদ বা মাযহাব । শেষোক্তটি ইবন হানবাল এবং
হাদিস-পন্থীদের আদর্শ ধারণ করে। তবে একজন মুসলিম যে কোনও মাযহাব বেছে নিতে পারে।
সুন্নীরা শিয়াদের মত প্রথম
তিন রাশিদুনকে অবজ্ঞা করে না ; শিয়াদের বিশ্বাস অনুযায়ী কেবল
আলীই উম্মাহ্ র বৈধ ইমাম ছিলেন । সুন্নী ধার্মিকতা শিয়াদের তুলনায় আশাবদী । তাঁদের বিশ্বাস, মুসলিমরা যদি শরিয়াহ্ অনুযায়ী জীবন যাপন করে, তাহলে
তারা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দেবে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে নতি
স্বীকারে বাধ্য করবে ।
শিয়াদের নিজস্ব জাফরি মাযহাব , ইসলামে সুফিবাদ , ফায়লাসুফরা দর্শন , সপ্তবাদী বা ইসমাইলি শিয়া ও
দ্বাদশবাদী শিয়া এবং গোপন ধর্মীয় আন্দোলন :-
সুন্নীদের ধার্মীকতা অবশ্য সকল মুসলিমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি , যদিও
তা
সংখ্যাগরিষ্ঠজনের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। তবে আব্বাসীয় আমলে আরও চারটি
জটিল
ধরনের ইসলামী দর্শন এবং আধ্যাত্নিকতার আবির্ভব ঘটেছিল , যাহা
সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে গোপন রাখা হয়েছিল ,ভুল
বুঝাবুঝির আসংকায়। এই গোপনীতার আবার স্বয়ং-রক্ষক ব্যবস্থাও ছিল। শিয়াদের ষষ্ঠ ইমাম জাফর
আস-সাদিক তাঁর অনুসারীদের আপন নিরাপত্তার স্বার্থেই তাক্বিয়াহ্ বা
গোপনীয়তা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় পণ্ডিত ও
উলেমাগণও এসব গুপ্ত সংগঠনের অর্থডক্সির ব্যাপারে সন্দিহান
ছিলেন। তবে
নিগূঢ় বিদ্যাধারীরা তাদের ধারণাকে ধর্মদ্রোহী বলে ভাবেনি। তারা উলেমাদের তুলনায় অধিকতর
গভীরভাবে প্রত্যাদেশ উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন বলে বিশ্বাস করত এবং তারা
ইসলামের অত্যাবশ্যকীয় অনুশীলন বা পাঁচ “স্তম্ভ” (রুকন)মেনে চলেছে । তারা মুসলিম বিশ্বাসের সংক্ষিপ্ত ঘোষণা শাহাদা: “আল্লাহ্
ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই এবং মুহাম্মদ(সঃ) তাঁর পয়গম্বর” সম্পর্ণ
মেনেছে । দৈনিক পাঁচবার সালাত প্রার্থনা করেছে, যাকাত দান করেছে, রমজান
মাসে উপবাস পালন করেছে এবং হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায়
ও গেছে তারা। ইসলামের স্তম্ভসমুহের প্রতি বিশ্বস্ত যে কেউ অবশ্যই প্রকৃত
মুসলিম, তাদের বিশ্বাস যাই হোক না কেন, এ বিশ্বাস তাদের ছিল।
শিয়ারা সুন্নীদের মতই শরিয়াহ্ ভিত্তিক ধার্মিকতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলতবে তা তাদের নিজস্ব মাযহাব (জাফর মতবাদ, স্বয়ং ইমাম আস-সাদিকের নামানুসারে তাদের তাদের মযহাবের নাম) অনুসারে, অবশ্যই। কিন্তু তারা প্রধানত দিক-নির্দেশনার জন্য বর্তমান ইমামের দিকে চেয়ে থাকত, যিনি তাঁর প্রজন্মের জন্য
স্বর্গীয় ইলিমহ্ এর গ্রহিতা, নিস্পাপ আধ্যাত্মিক পরিচালক
এবং আদর্শ কাজি। শিয়ারা মনে করে তাদের ইমামদের সকলেই তাঁর সময়কালের খলিফাহ্ র হা তে
নিহত হয়েছেন । দশম শতাব্দী নাগাদ শিয়ারা আশুরার(১০মুহরম) উপবাসের দিন, মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রকাশ্যে হুসেইনের শোকে মাতম করা আরম্ভ করে। নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয় প্রশাসনের সঙ্গে শিয়াদের বৈরতা আবার বেড়ে যায় । খলিফাহ্ আল-মুতাওয়াক্কিল(৮৪৭-৬১)
দশম ইমাম আলী আল-হাদিকে গৃহবন্দী করে রাখেন । এর পর
থেকে ইমামগণ কার্যত:শিয়াদের নাগালের বাইরে চলে যান এবং কেবল “প্রতিনিধি”র
মাধ্যমেই বিশ্বাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ৮৭৪-এ একাদশ ইমামের পরলোকগমনের পর বলা হয় যে তিনি একজন তরুণ পুত্র সন্তান রেখে গেছেন যিনি আত্মরক্ষার খাতিরে আত্মগোপন করেছেন। দ্বাদশ ইমামের কোনও সন্ধান আর মেলেনি। কিন্তু আজও প্রতিনিধিগণ তাঁর পক্ষে শিয়াদের শাসন করছেন,তাদের কোরানের গৃঢ়ার্থ পাঠে সাহায্য করছেন, যাকাত আদায় করছেন এবং আইনি
রায় প্রদান করছেন। ৯৩৪-এ গোপন ইমাম স্বাভাবিক জীবনের শেষ প্রান্তে
পৌছালে “প্রতিনিধি”
শিয়াদের জন্য তাঁর কাছ থেকে এক নতুন বাণী এনে হাজির করেন। তিনি “গোপন স্থানে”
(occultation) চলে গেছেন এবং ঈশ্বর অলৌকিক উপায়ে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন;
তিনি আর শিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। একদিন আবার ফিরে আসবেন তিনি, ন্যায় বিচারের যুগের উদ্বোধন করার জন্যে, কিন্তু
সেটা দীর্ঘ কয়েক যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর। কেননা খলিফাহ্ গণ পৃথিবী হতে
আলীর বংশধারা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং ইলম্ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এর পর থেকে শিয়া উলেমাগণ গুপ্ত ইমামের প্রতিনিধিতে পরিণত হন। বার জন ইমামে বিশ্বাসী দ্বাদশবাদী (Twelver) শিয়ারা আর রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করেনি, কেননা উম্মাহ্ র প্রকৃত নেতা গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকার বৈধ হতে পারে না , তাই তারা ইমামের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রয়েছে।
শিয়াদের সবাই
দ্বাদশবাদী ছিল না, সবাই রাজনীতিও ত্যাগ করেনি। কেউ কেউ সাত ইমামে বিশ্বাসী
বা সপ্তবাদী-Seveners
বা ইসমায়েলিরা মনে করে যে আলীর বংশধারা জাফর-আস-সাদিকের পুত্র ইসমায়েলের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে, যিনি মনোনীত ইমাম ছিলেন কিন্তু পিতার আগেই পরলোকগমন করেছেন। তারা জাফরের
দ্বিতীয় পুত্র মুসা আল-কাযিমের বৈধতা স্বীকার করেনি, দ্বাদশবাদীরা যাকে সপ্তম ইমাম হিসাবে মর্যাদা দিয়েছিল্ । তারাও এক গূঢ় আধ্যাত্মিকতার বিকাশ ঘটিয়েছিল যা ঐশীগ্রন্থের গোপন বা বাতিন অর্থের সন্ধানী, তারা
ভিন্নতর এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়াস পেয়েছিল এবং
রাজনীতিতে ও সক্রিয় কর্মী ছিল তারা। ৯০৯-এ এক ইসলায়েলি নেতা
টিউনিসিয়ার এক প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করতে সক্ষম হলে নিজকে
মেসিয়ানিক খেতাব আল-মাহদি(নির্বাচিত ব্যক্তি) প্রদান
করেন। ৯৮৩-তে
ইসমায়েলিরা আব্বাসীয়দের কাছ থেকে মিশর ছিনিয়ে নিয়ে কায়রোয়
পাল্টা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে, যা প্রায় দু’শ’ বছর
টিকে ছিল। সিরিয়া,
ইরাক, ইরান ও ইয়েমেনেও গোপন ইসমায়েলি সেল ছিল। সদস্যরা স্থানীয় দাই(dai:প্রতিনিধি) দ্বারা আস্তে আস্তে সম্প্রদায়ের অঙ্গীভূত হত। নিম্ন পর্যায়ের
অনুসূত ধর্ম সুন্নীদের বিপরিত কিছু ছিল না । তবে শিক্ষার্থী আরো অগ্রসর
হলে তাঁকে বিমূর্ত দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হত। কোরান নিয়ে ইসমায়েলিদের ধ্যান ইতিহাস সম্পর্কে তাদের মাঝে আবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়েছিল, যাকে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে শয়তানের বিরোধিতার পর থেকে ক্রমাবনতিশীল বলেই বিশ্বাস করেছে। মোট ছয় জন মহান পয়গম্বর ছিলেন[ ,এডাম
, নোয়াহ্ ,আব্রাহাম ,মোজেস,জেসাস এবং মুহাম্মদ(সঃ)। যাঁদের প্রত্যেকেই এই নিম্নমুখী
প্রবণতা উল্টে দিয়েছেন। প্রত্যেক পয়গম্বরের একজন করে “কর্মী” (executor) ছিলেন যিনি তাঁর বাণীর গোপন অর্থ যোগ্যদের শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন;-হারুন
ছিলেন মোজেসের কর্মী আর আলী ছিলেন মুহাম্মদের(সঃ)। বিশ্বাসীরা যখন তাদের শিক্ষা বাস্তবায়নের সংগ্রামে লিপ্ত হবে তখন তারা পৃথিবীকে চূড়ান্ত শান্তির পর্বের জন্যে প্রস্তুত করে তুলবে, এবং
সপ্তম পয়গম্বর মাহ্ দি যার সূচনা ঘটাবেন।
ইসমায়েলিরা মুহাম্মদকে(সঃ) ছয়জন প্রধান পয়গম্বরের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করে, কিন্তু এটাও জোর দেয়ে বলে যে আরবদের কাছে অবতীর্ণ প্রত্যদেশের পূর্ণ তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে কেবল ইমাম মাহ্ দির আগমনের পরেই। যা অধিকতর রক্ষণশীল উলেমাদের জন্য ছিল উদ্বেগজনক।
ইসমায়েলিরা তাদের
চিন্তার উল্লেখযোগ্য আংশই এসময়ে আবির্ভূত তৃতীয় গূঢ় তত্ত্বীয় আন্দোলন ফালসাফাহ্ থেকে গ্রহন
করেছিল। আব্বাসীয়দের সময় সূচিত সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ, বিশেষ করে গ্রিক দর্শন,
বিজ্ঞান আর চিকিৎসা শাস্ত্র সেই সময়ে আরবী ভাষার মুসলিমের
নাগালের মধ্যে আসায় সেখান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এই আন্দোলন। ফায়লাসুফরা হেলেনিস্টিক যুক্তিবাদ দ্বারা আলোড়িত হয়েছিল, তারা যুক্তিবাদকে ধর্মের
সর্বোচ্চ পর্যায় বলে বিশ্বাস করত এবং একে অধিকতর উচ্চ স্তরের দর্শনকে
কোরানের প্রত্যাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে চেয়েছিল। একেশ্বরবাদীরা যেখানে
ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছে ফায়লাসুফরা সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে
ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছে , ফায়লাসুফরা সেখানে গ্রিকদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে যে ইতিহাস কুহেলিকা: এর কোনও আদি মধ্য বা অন্ত নেই, কেননা
বিশ্বজগৎ আদি কারণ(First Cause) হতে চিরন্তনভাবে উৎসারিত হচ্ছে। ফায়লাসফরা ইতিহাসের ক্ষণস্থায়ী প্রবাহের অতীতে গিয়ে এর অভ্যন্তরস্থ স্বর্গীয় পরিবর্তনহীন আদর্শ জগৎ প্রত্যক্ষ করতে শিখতে চেয়েছিল। মানুষের যুক্তিজ্ঞানকে তারা
পরম
কারণ (Absolute Reason) অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব
হিসাবে দেখেছে । ফায়লাসুফরা বিশ্বাস করত
ক্যাথারসিসের (Catharsis) এই প্রক্রিয়া গোটা মানব জাতির আদি ধর্ম । অন্যসব বিশ্বাস (Cult) স্রেফ যুক্তির প্রকৃত ধর্মের অপূর্ণাঙ্গ রূপ মাত্র । কিন্তু ফায়লাসুফরা ধার্মিক
ছিল, নিজদের তারা ভাল মুসলিম বলে বিশ্বাস করত ।
ইয়াকুব ইবন ইসহাক আল-কিন্দি
(মৃত্যু: -৮৭০) ছিলেন মুসলিম বিশ্বের প্রথম প্রধান ফায়লাসুফ বা “দার্শনিক” , তিনি প্রত্যাদেশকে যুক্তির বশীভূত করতে চাননি বরং ঐশীগ্রন্থের
অভ্যন্তরীণ সত্তা দেখতে চেয়েছেন তিনি, অনেকটা
শিয়ারা যেভাবে কোরানের বাতিন অর্থ অনুসন্ধান করেছে সেরকম । অবশ্য তুর্কি বংশোদ্ভূত একজন
সঙ্গীতযন্থবাদকই যুক্তিভিত্তিক দর্শনের ইসলামী ট্র্যাডিশনের
পূর্ণ প্রতিষ্া করেছিলেন ।
আবু নাসর আল-ফারাবি (মৃত্যু-৯৫০) দর্শনকে প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের তুলনায় উন্নত বিবেচনার ক্ষেত্রে আরও আনেক বেশী অগ্রসর হন, ধর্ম তাঁর কাছে
নিতান্ত সুবিধাজনক একটা বিষয় এবং স্বাভাবিক সামাজিক প্রয়োজনীয়তায় পরিণত
হয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে তিনি একজন সক্রিয়(Practising) সুফি ছিলেন।
অতীন্দ্রিয়বাদের প্রতি আকৃষ্ট শিয়া ও ফায়লাসুফরা শিয়া ও সুফিদের মত পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে,
যাদের ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আধ্যাত্মিক
দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একই রকম।
সুন্নী ইসলামের
অতীন্দ্রিয় রূপ সুফিবাদ ও অন্যান্য আলোচিত মতবাদের চেয়ে আলাদা। কেননা এটা রাজনীতি প্রবন দর্শন গড়ে তোলেনি। পরিবর্তে এটা যেন আবার পুরানো ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করেছে।
নবম শতাব্দীর গোড়ার
দিকে তাসাউফ (যেখান থেকে “সুফি” শব্দটি এসেছে) শব্দটি
আব্বাসীয় ধীর গতিতে গড়ে ওঠা অতীন্দ্রিয়বাদী আনদোলনের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় ।
উলেমা
ও জুরিস্টরা যেখানে ক্রমবর্ধমান হারে প্রত্যাদেশকে পূয্ণাঙ্গ ও চুড়ান্ত মনে
করেছিলেন, সেখানে শিয়াদের মত সুফিরাও নতুন সত্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে ছিল উদর । কোরান যেখানে কঠোর বিচারক
ঈশ্বরের বর্ণনা দিয়াছে, সেখানে মহান মহিলা সাধু রাবিয়াহ্(মৃত্যু:৮০১)র মত
সুফিরা একজন ভালোবাসার ঈশ্বরের কথা বলেছেন। কিছ অতীন্দ্রিয়বাদীরা “মাতাল
সুফি”
(drunken Sufis )হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এধরনের একজন মাতাল সুফি হলেন
আবু ইযাযিদ আল
-বিস্তামি (মৃত্যু-৮৭৪) যিনি আল্লাহ্ কে একজন প্রেমিকের মত
মিনতি
জানিয়েছেন, তিনি ফানাহ্ র (বিলীন) কৌশল ও
শিখেছিলেন: আস্তে আস্তে অহমবোধের সমস্ত স্তর খসিয়ে ফেলার
মাধ্যমে আল-বিস্তমি আপন সত্তার(being) ভিত্তিভূমিতে এক বর্ধিত সত্তার(self) সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন যা স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ নন,
যিনি বিস্তামিকে বলেছেন; “তোমার মাধ্যমেই আমি:
তুমি ছাড়া আর কোনও ঈশ্বর নেই।
হুসেইন
আল-মনসুর(মৃত্যু:৯২২) যিনি আল-হাল্লাজ বা উল-কারডার নামেও পরিচিত, তিনি
চিৎকার করে বলেছিলেন “ আনা
আল-হাক্ক “
বা আমিই সত্য বা আমিই বাস্তব, অন্যদের মতে এটা হওয়া
উচিত “আমি সত্য দেখছি” বাড়িতে অবস্থান করেই আত্মার মাধ্যমে বৈধ হজ্জ করা
সম্ভব
দাবী করার কারণে উলেমাদের হাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন
হাল্লাজ।
বাগদাদের যুনায়েদ(মৃত্যু:৯১০) একজন “স্থির সুফি”(sober sufi) এই
জাতীয় চরমপন্থা থেকে সরে আসেন, তার বিশ্বাস, একজন
সুফি যখন প্রথম ঐশী আহ্বান শুনতে পায় ,সে নারী
বা পুরুষ যেই হোক, অস্তিত্বের সকল উৎসের সঙ্গে কষ্টকর বিচ্ছেদ সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। অতীন্দ্রিয় যাত্রা মানুষের জন্য যা একেবারেই স্বাভাবিক সেখানে ফিরে যাওয়া মাত্র। এই মতবাদ বুদ্ধদের অনুসৃত মতবাদের অনুরূপ। নিজেদের যদিও তারা ধার্মিক, নিবেদিত মুসলিম বলে দাবী করেছিল, কিন্তু
গৃঢ় তাত্ত্বিকরা সবাই পয়গম্বরের ধর্মকে বদলে ফেলেছে।
মুসলিম সংস্কারকগণ ইসলামের অতীন্দ্রয়বাদী ধরনকে নির্ভরযোগ্য নয় বলে আবিস্কার করেছেন ,এবং পরবর্তীকালে সংযোজনে বিকৃত হবার আগের প্রথম উম্মাহ্ র নিখাঁদ অবস্থায় ফিরে যাবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু ইসলাম প্রমান করছে, যে
ইসলামের সেই সৃজনশীল ক্ষমতা রয়েছে।.
দশম শতাব্দীর
চিন্তাশীল মুসলিমরা বুঝতে পেরেছিল খেলাফত সঙ্কটাপন্ন; কিন্তু তারা এই পতনকে মুক্তি হিসাবেই অনুভব করেছ ;-
নবম ও দশম শতাব্দীর মুসলিমরা মদিনার প্রথম অবরুদ্ধ ক্ষুদ্র উম্মাহ্ র চেয়ে বহুদুর অগ্রসর হয়েছিল। তাদের দর্শন, ফিকাহ্ এবং অতীন্দ্রিয়বাদী
অনুশীলনের মূলে ছিল কোরান এবং পয়গম্বরের চরিত্র, কিন্তু
ঐশীগ্রন্থ যেহেতু ঈশ্বরের বাণী,তাই
অসংখ্যরূপে এর ব্যাখ্যায়িত হওয়ার ক্ষমতা আছে মনে করা হত। যার জন্যে
রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ইসলামী ধর্ম ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। বাগদাদে র একটিমাত্র
সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবর্তে আরো একাধিক কেন্দ্র গড়ে
ওঠে। কায়রো
শিল্পকলা ও জ্ঞানার্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে দর্শন বিকাশ লাভ করে
এবং দশম শতাব্দীতে খলিফাহ্ গণ আল-আযহার মহাবদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
করেন, যা একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে
পরিণত হয়। এ পর্যায়ের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তি হলেন ;ফায়লাসুফ আবু আলী ইবনে সিনা(৯৮০-১০৩৭) ,আভিসেনা বা ইবনে সিনা ছিলেন
আল-ফারাবির অনুসারী, তাঁর চোখে একজন পয়গম্বর হলেন
আদর্শ দার্শনিক, এবং শুধু বিমূর্ত যৌক্তিক
সত্যের বাহকমাত্র নন,কেননা তাঁর এমন অন্তর্দৃষ্টির কাছে পৌছার ক্ষমতা ছিল যা এলোমেলো সামঞ্জস্যহীন চিন্তা-ভাবনার ওপর নির্ভরশীল নয় । ইবনে সিনা
সুফিবাদে আগ্রহী ছিলেন, এবং স্বীকার করতেন যে অতীন্দ্রিয়বাদীরা অলৌকিকের এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় যা সম্ভব নয় ,তবে ফায়লাসুফদের ধারণার সঙ্গে যার সামঞ্জস্য রয়েছে ।
মুসলিম কবি ইবনে হাযাম(৯৯৪-১০৬৪) অপেক্ষাকৃত সরল ধার্মিকতার উদ্ভাবন করেন, যা কেবল আহাদিসের ওপর নির্ভরশীল , যা জটিল ফিকাহ্ , ম্যাটাফিজিক্যাল
দর্শন
পরিত্যাগ করেছিল । স্পেনের বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন ফায়লাসুফ আবু আল-ওয়ালিদ আহমাদ ইবনে রূশদ(১১২৬-৯৮), তাঁর যুক্তিনির্ভর
ধ্যান-ধারণা
MAIMONIDES, THOMAS AQUINAS এবং ALBERT THE GREAT এর মত ইহুদি ও ক্রিশ্চান দার্শনিকদের
প্রভাবিত করেছিল । ERNEST RENAN ইবনে
রূশদকে(পাশ্চাত্যে এভেরোস নামে খ্যাত)মুক্তমনের অধিকারী বলে প্রশংসা ও
করেছিলেন, অন্ধ বিশ্বাসের বিরোধিতাকারী ও যুক্তিবাদের আদি পতাকাবাহী ছিলেন ইনি। আবার ধার্মিক মুসলিম ও শরিয়াহ্ আইনের কাজিও ছিলেন তিনি। ইবনে সিনার
মত তিনিও ধর্ম ও ফায়লাসুফদের মাঝে কোনো বিরোধ দেখেন নি ।
খেলাফত পরিত্যক্ত হওয়ার ইসলাম যেন নতুন করে প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছিল। ইবনে ইসহাক এবং আবু জাফর অল-তারাবি(মৃত্যু-৯৩২) মত মুসলিম ঐতিহাসিকগণ পয়গম্বরের জীবনের কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী বিবরণের মাঝে সামঞ্জস্য বিধানের খুব একটা প্রয়াস পাননি,বরং পরস্পর বিরোধী বিবরণ পাশাপাশি উল্লেখ করে গেছেন, সমান
গুরুত্ব দিয়ে । এবার মুসলিমরা আরো অনুকূল রাজনৈতিক ব্যবস্থা লাভ
করায় ইসলামী ধার্মিকতায় এক পরিবর্তন এসেছিল।
পারসিয়ান উযির নিযামুলমুলক(১০৬৩-৯২) এর শাসন কালে, স্থানীয় পর্যায়ে আমির এবং উলেমাগণ আদেশ কার্যকর করতেন, ফলে তাঁরা বিচ্ছিন্ন সামরিক
রাজ্যগুলোকে একত্রিত রেখেছিলেন। দশম শতাব্দীতে উলেমাগণ নিজেদের শিক্ষার মান উন্নতির
জন্যে এবং ইসলামী বিজ্ঞানের গবেষণার লক্ষে প্রথমবারের মত
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
গড়ে ওঠায় উলেমাগণ এবার ক্ষমতার একটা ভিত্তি পান, যা আমিরদের সামরিক দরবারের চেয়ে আলাদা কিন্তু সমমানের দাঁড়ায় । শ্রেণীকৃত মাদ্রাসাসমুহ সমগ্র সেলজুক অঞ্চলে শরিয়াহ্ নির্দেশিত পথে মুসলমানদের একই রকম জীবনযাত্রা উৎসাহিত করে । উলেমাগণ শরিয়াহ্ আদালতের আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন । আমিররা খুব স্বল্প বা অস্থায়ী দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন, আর
ঊলেমা আর সুফি শিক্ষক(পির)গণ সাম্রাজ্যের সামগ্রিক আদর্শবাদ সরবরাহ করতেন সম্পূর্ণ আলাদা এক বলয় থেকে। এভাবে খেলাফতের
কার্যকর বিলুপ্তির পর সাম্রাজ্য আরো ইসলামী হয়ে ওঠে । আমিরগণ এসেছেন, বিদায়
নিয়েছেন; কিন্তু শরিয়াহ্ সমর্থক উলেমাগণ একমাত্র স্থিতিশীল কর্তৃপক্ষে
পরিণত হন; এবং সুফিবাদ আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে,সাধারণ মানুষের ধার্মিকতা গভীর হয় এবং এক অভ্যন্তরীণ মাত্রা লাভ করে । এসময় সর্বত্র সুন্নী ইসলামের অগ্রযাত্রা যেন স্পষ্ট হেয়ে ওঠে, এবং চরমপন্থী ইসমায়েলিদের কেউ কেউ ফাতিমীয় সাম্রাজ্যের বেলায় আশাহত হয়ে গেরিলাদের এক আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওআর্ক গঠন করে । সেলজুকদের উৎখাত এবং সুন্নীদের ধ্বংসের কাজে নিবেদিত ছিল
এরা ।১০৯২
নাগাদ তা পূর্ণাঙ্গ বিদ্রোহে রূপ নিয়েছিল । ইসমায়েলিরা নিজেদের সাধারণ
মানুষের রক্ষক বলে বিশ্বাস করত, যারা নিজেরাই প্রায় আমিরদের হয়রানির
শিকার হত,কিন্তু তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম অধিকাংশ মুসলিমকে ইসমায়েলিদের
বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে, উলেমাগণ তাদের নিয়ে অবিশ্বাস্য আর ভ্রান্ত কাহিনী ছড়াতে থাকেন। সন্দেহভাজন ইসমায়েলিদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। এই বিরোধিতা সত্ত্বেও
ইসমায়েলিরা আলামূতের আশেপাশে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম
হয়েছিল, যা ১৫০ বছর টিকে ছিল এবং কেবল মঙ্গোল হানাদাররাই একে
ধ্বংস করতে পেরেছিল । অবশ্য তাদের জিহাদের
প্রত্যক্ষ ফলাফল আশানুযায়ী মাহদির আগমন ছিল না, বরং গোটা শিয়া
সম্প্রদায়ের অপমান ছিল ।
এই পর্যায়ে দ্বাদশবাদী (Twelvers) শিয়ারা ইসমায়েলি বিদ্রোহে অংশগ্রহন হতে বিরত থাকে এবং সুন্নী কর্তৃপক্ষকে সযত্নে খুশি রাখে ও যেকোনো রাজনৈতিক সংশ্রব থেকে দুরে সরে থাকে ।
সুন্নীরা এসময় একজন থিয়োলজিয়ানের ভূমিকায় সড়া দেয়, যিনি সুন্নীদের ধর্ম
বিশ্বাসের প্রমাণিক সংজ্ঞা প্রদানে সক্ষম হয়েছিলেন, যাঁকে
পয়গম্বল মুহাম্মদের(সঃ) পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম
বলে অভিহিত করা হয় । তিনি হলেন নিযামুলমুলকের আশ্রয়প্রাপ্ত আবু হামিদ
মুহাম্মদ আল-গাযযালি(মৃত্যু-১১১১) এবং বাগদাদস্থ নিযামিয়াহ্
মাদ্রাসার লেকচারার এবং ইসলামী আইনের বিশেষজ্ঞ ও ছিলেন তিনি । তিনি দশ বছর জেরুজালেমে সুফি
চর্চা করে ,
ইরাকে ফিরে আসার পর রচনা করেন এক অসাধারণ
গ্রন্থ- ইয়াহ্ আলাম আল-দিন ( দ্যা রিভাইভাল অভ দ্যা রিলিজিয়াস সায়েন্সেস ) এটা
কোরান আহাদিসের পর সর্বাধিক উদ্ধৃত গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক
ভিত্তি হল কেবল আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনাই মানুষকে ঈশ্বর
সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান জোগাতে পারে ; কিন্তু থিয়োলজি(কালাম)
এবং ফালসাফাহ্ র যুক্তিসমুহ ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা
দিতে পারে না । ইয়াহ্ মুসলিমদের এক দৈনন্দিন আধ্যাত্মিক ও প্রায়োগিক
কর্মধারার যোগান দেয়, যা তাদের এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতা অর্জনে
প্রস্তুত করে তোলে । খাওয়া,
ঘুমানো, ধোয়া, স্বাস্থ্য এবং প্রর্থনা সংক্রান্ত সকল শরিয়াহ্ আইনের ভক্তিমূলক ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, ফলে
সে গুলো আর নেহাত বহ্যিক নির্দেশাবলী না থেকে মুসলিমদের
কোরান উল্লেখিত ঈশ্বর সম্পর্কে চিরন্তন সচেতনতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম করে
তুলেছে । এভাবে শরিয়াহ্ সামাজক ঐক্য বজায় রখার কায়দা এবং পয়গম্বর ও তাঁর
সুন্নাহ্ র যান্ত্রিক বাহ্যিক অনুকরণের অতিরিক্ত কিছুতে পরিণত হয়েছে; এটা
হয়ে দাঁড়িয়েছে অভ্যন্তরীণ ইসলাম অর্জনের উপায় । আল-গায্ যালি সাধারণ
ধার্মিকদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন । তিনি মনে করতেন , তিন ধরনের মানুষ আছে; যারা
বিনা প্রশ্নে ধর্মীয় সত্যকে মেনে নেয় , যারা
কালামের যুক্তিভিত্তিক অনুশীলনে তাদের বিশ্বাসের পক্ষে
যুক্তির সন্ধান করে; আর সুফিগণ , যাদের ধর্মীয় সত্যের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে । ইমামের প্রতি
ইসমায়েলিদের অগাধ ভক্তি তাঁর অপছন্দ ছিল । ফালসাফাহ্ কে তিনি গণিত আর
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মত শাস্ত্রের জন্যে অপরিহার্য হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগের অতীত
আধ্যাত্মিক বিষয়াবলী সম্পর্কে এটা নির্ভরযোগ্য পথনির্দেশ দিতে
পারে না ।আল-গাযযালির দৃস্টিতে সুফিবাদই সমাধান, কারণ
এর অনুশীলন ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারে
। এভাবে
আল-গাযযালি অতীন্দ্রিয়বাদকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের কর্তৃত্ব আর মার্যাদা
ব্যবহার করে মুসলিম জীবনের মূলধারায় এর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করছেন
। তিনি
শরিয়াহ্ র পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতায়ও উৎসাহিত করে বলেছেন, ইসলামের
জন্যে উভয়ই গুরুত্বপৃর্ণ । তাই তাঁর সময়ে সুফিবাদ জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল । তিনি তাঁর আপন সময়ের সর্ব্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ হিসাবে স্বীকৃত
ছিলেন । গৃঢ় বিদ্যার্থী মুসলিমদের একান্ত অনুশীলনের পরিবর্তে জিকর(dhikr)- ঐশী
নাম জপ- দলীয় চর্চায় পরিণত হয়, যা মুসলমনদের পিরের
নির্দেশনার চেতনার বিকল্প স্তরে পৌছে দিয়েছিল । সুফিরা তাদের দুর্জ্ঞেয়ের
সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সঙ্গীত শুনত।
পিরের চারপাশে জমায়েত হত তারা, শিয়ারা
যেমন এককালে ইমামদের ঘিরে থাকত, তাঁকে ঈশ্বরের পথে পরিচালক হিসাবে দেখত। যখন কোনো পির পরলোকগমন করতেন, কার্যত:
একজন “ সাধু” তে (Saint)
পরিণত হতেন তিনি- পবিত্রতার কেন্দ্রবিন্দু-
আর লোকে তাঁর সমাধিতে প্রার্থনা আর জিকর অনুষ্ঠান করত। প্রত্যেক শহরে এসময় মসজিদ বা
মাদ্রাসার মত আলাদা খানকাহ্ {আশ্রম} ছিল, যেখানে
স্থানীয় পির তাঁর অনুসারীদের নির্দেশনা দান করতেন। নতুন নতুন সুফি পদ্ধতি(ত্বরিকাহ্) গড়ে ওঠে, যেগুলো নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় সীমিত না থেকে সমগ্র দার আল-ইসলামে শাখা বিস্তার করে আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছিল। ইহা একেবারে
অশিক্ষিতদের ধর্ম বিশ্বাসেও পরিণত হয়েছিল, পূর্বে যা কেবল অভিজাত এবং বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর করায়ত্ব ছিল।
এরপর আর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে গভীরভাবে সংমিশ্রিত নয় এমন ধর্মতাত্ত্বিক বা দার্শনিক আলোচনার অস্তিত্ব থাকেনি। নতুন “ থিয়োসফাররা”(Theosophers) এই নয়া মুসলিম সিনথেসিসের প্রচার করেন্ ।
আলেপ্পোয় ইয়াহিয়া সুহরাওয়ার্দি (মৃত্যু-১১৯১) প্রচীন প্রাক ইসলামী ইরানি অতীন্দ্রিয়বাদের পর ভিত্তি করে আলোকনের (আল-ইশরাক) নতুন মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন । প্রকৃত দর্শনকে তিনি ফালসাফাহ্ র মাধ্যমে মননের সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ এবং সুফিবাদের মাধ্যমে হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন, এ
দুয়ের মিশেলের ফলাল হিসাবে দেখেছেন। অতীন্দ্রিয়বাদীদের দর্শন(vision)এবং কোরানের প্রতীকসমূহ(যেমন-স্বর্গ, নরক
ও শেষ বিচার) অভিজ্ঞতার আলোকে প্রমান করা যাবে না
; বরং ধ্যানীর প্রশিক্ষিত সজ্ঞামূলক গুণাবলী দিয়ে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। অতীদ্রিয় মাত্রার বাইরে ধর্মের কিংবদন্তী কোনো অর্থ বহন করে না , কেননা
সেগুলো আমাদের স্বাভাবিক সচেতনতা দিয়ে অনুভূত জাগতিক ঘটনাবলীর মত “ বাস্তব” (“real”) নয়। একজন অতীন্দিয়বাদী নারী বা পুরুষ নিজকে সুফি অনুশীলনের
মাধ্যমে জাগতিক অস্তিত্বের অভ্যন্তরীণ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করার জন্যে প্রশিক্ষিত করে তোলে । মুসলিমদের আলম আল-মিথালর- “ খাঁটি
প্রতিবিম্বের জগৎ” (the world of pure images) অনুভূতি গড়ে তুলতে হয় , যা নশ্বর জগৎ আর ঈশ্বরের মাঝে
বিরাজমান । এমনকি যারা প্রশিক্ষিত অতীন্দ্রিয়বাদী নয় তারাও নিদ্রিত অবস্থায়
বা ঘোরে থাকার সময় বা হিপনোগোগিক ইমেজারিতে এই জগত সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে । সুহ্ রাওয়ার্দি বিশ্বাস করতেন, যখন কোনো পয়গম্বর বা অতীন্দ্রিয়বাদী কিছু প্রত্যক্ষ করেন(vision) অন্তস্থ: জগত সম্পর্কে
সজাগ
হয়ে ওঠেন, যা আজকের দিনে আমরা যাকে
অবচেতন মন বলি তার অনুরূপ ।
ইসলামের এই ধরন হাসান আল-বাসরি বা শাফীর কাছে অচেনা ঠেকত । নিজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুহ্ রাওরর্দির মৃত্যুদণ্ড হতে পারত, কিন্তু ধার্মিক মুসলিম
ছিলেন
তিনি, তিনি কোরান থেকে সবচেয়ে উদ্ধৃতি দিয়েছেন । তাঁর রচনা আজও অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্রুপদী সাহিত্য হিসাবে পাঠিত হয়ে থাকে। যেমন পাঠিত হয়, স্প্যানিশ
থিয়োসফার মুঈদ আল-দিন ইবনে আল-আরাবির (মৃত্যু-১২৪০) গ্রন্থসমূহ । তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে , ঈশ্বরকে
পাওয়ার উপায় সৃজনশীল কল্পনার (creative imagination) মাঝে নিহিত । তিনি অতীন্দ্রিয়বাদীকে সকল
ধর্মবিশ্বাসকে সম বৈধভাবে দেখতে হবে এবং তাকে সিনাগগ, মসজিদ
,গির্জা বা মন্দিরে সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে হবে, যেমন
কোরানে ঈশ্বর বলেছেন; “ আর যেদিকেই তুমি মুখ
ফেরাও, সেদিকই আল্লাহ্ র দিক” (কোরান-২:-১০৯)
।
এভাবে খেলাফতের বিলোপের পর এক ধর্মীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল । এতে করে সাধারণ শিল্পী এবং অভিজাত বুদ্ধিজীবীগণ সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন । একটা প্রকৃত মুসলিম জাতি অস্তিত্ববান হয়ে ঊঠেছিল, যারা ধর্মকে গভীর স্তরে মেনে
নিতে
শিখেছিল । মুসলিমরা এক ব্যাপক আধ্যাত্মিক নবজাগরণের মাধ্যমে
রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতি সাড়া দিয়েছিল যা নতুন ব্যবস্থার
সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা
করেছে ।
ইসলাম এসময় রাষ্ট্রীয়
সমর্থন ছাড়াই বিকশিত হচ্ছিল , প্রকৃতপক্ষেই রাজনৈতিক পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটাই কেবল
অপরিবর্তনীয় । চলবে..
উমাঈয়াহ্ এবং আব্বাসীয় যুগের পতন , নয়া
এক ব্যবস্থা (৯৩৫-১২৫৮ )
খেলাফতের পতন সত্ত্বেও মুসলিমরা এবার এমন দুটি এলাকায় সম্প্রসারিত হল যা কখনওই দার-আল-ইসলামের অংশ ছিল না--পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের একটা অংশ- এবং যে এলাকাটি অদুর ভবিষ্যতে অত্যন্ত সৃজনশীল অঞ্চলে পরিণত হয় ।
খলিফাহ্ আল-নাসির (১১৮০-১২২৫) বাগদাদ এবং এর আশপাশে খেলাফতের পূন:প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেছিলেন । ধর্মীয় পূনর্জাগরণের শক্তি উপলব্ধি করে ইসলামের আশ্রয় নেন তিনি এবং আলিম হওয়ার লক্ষ্যে চারটি সুন্নী মতবাদ নিয়েই পড়াশোনায় লিপ্ত হয়ে, এক ফুতুওয়াহ্ সংগঠনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি । তার পরলোকগমনের পর ও এই নীতিমালা তাঁর উত্তরাধিকারীগণ অব্যহত রাখেন, তবে শেষ পর্যন্ত
আব্বাসীয় খেলাফতের সহিংস ও করুণ পরিসমাপ্তি ঘঠে , এবং
মঙ্গোল গোত্রের (১২২০-১৫০০) আবির্ভাব হয় ।
দুরপ্রাচ্যে মঙ্গোল গোত্র অধিপতি জেংঘিস খান এক বিশ্ব-সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন. ইসলামী জগতের সঙ্গে তাঁর সংঘাত ছিল অনিবার্য । তিনি হিংস্র, যুদ্ধবাজ এবং ধ্বংসাত্মক ক্ষমাতার অধিকারী ছিলেন ।
খয়ারাযমিয়ান তুর্কিদের শাহ মুহাম্মদ(১২০০-১২২০) যখন ইরান এবং ওক্- স্রাস অঞ্চলে নিজস্ব মুসলিম খেলাফত গড়ে তুললে,মঙ্গোল সেনাপতি হুলেগু(Hulegu)একে ঐদ্ধত্য ধরে
নিয়ে ১২১৯-১২২৯ পর্যন্ত মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র জালাল আল-দিনকে ইরান থেকে আযেরবাইজান হয়ে সিরিয়া পর্যন্ত ধাওয়া করেছে, একের
পর এক মুসলিম নগরী ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে ।
প্রথম যে মুসলিম শাসক মঙ্গোলদের ঠেকিয়ে দেন , তিনি হলেন তুর্কি দাস বাহিনী
শাসিত
নতুন মিশরীয় রাষ্ট্রের সুলতান বায়বরস। ১২৫০ -এ মামলুক আমিরগণ
আইয়ুবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সফল অভ্যুথ্থানে নেতৃত্ব দিয়ে
নিকট প্রাচ্যে নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৬০-এ উত্তর প্যালেস্টাইনের
আইন জালুটে বায়বরস মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন।
মঙ্গোলরা চারটি বৃহদাকার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু নাগাদ চারটি মঙ্গোল সাম্রাজ্যেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল । তখন মঙ্গোলরা কেন্দ্রীয় ইসলামী মূল এলাকার প্রধান মুসলিম শক্তি হয়ে ওঠে । তখন ইসলামের সাম্যবাদী চেতনার সঙ্গে তাদের শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক পার্থক্য ছিল । আমিরগণ গ্যারিসনে অবস্থান করে
শাসন কাজ চালাতেন আর সাধারণ মানুষ ও উলেমাগণ চলতেন তাদের নিজস্ব ইসলামী ব্যবস্থায় ।
পঞ্চদশ শতাব্দী নাগাদ ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে উলেমাগণ আর নিজস্ব স্বাধীন বিবেচনা বোধ (ইজতিহাদ) প্রয়োগ করে আইন নির্মান করতে পারবেন না ; বলা
হয় যে
“ ইজতিহাদের দ্ধার” বন্ধ
হয়ে গেছে । মুসলিমরা অতীতের কর্তৃপক্ষের বিধিবিধান মেনে নিতে বাধ্য
হল । নীতিগতভাবে
শরিয়াহ্ প্রতিষ্ঠিত নিয়মকানুনের একটা ব্যবস্থায় পরিণত
হল , যা শাসক পরিবারের অধিকতর গতিশীল বংশগত আইনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারবে না ।
মুসলিম জীবনে মঙ্গোল হস্তক্ষেপ ছিল বেদনাদায়ক । কিন্তু মুসলমানরা তাদের ইতিহাসে বারবার বিপর্যয়ের প্রতি ইতিবাচক প্রতক্রিয়া দেখিয়েছে , তো
মঙ্গোল-আগ্রাসনের পরেও তাই ঘটেছে।
সুফি অতীন্দ্রিয়বাদী জালাল আল-দিন রুমির(১২০৭ ৭৩) দর্শনে এ ব্যাপারটা পরিস্কার ধরা পড়েছে । তিনি নিজে মঙ্গোলদের শিকার ছিলেন । রুমির জন্ম হয়েছিল খুরাসানে, তাঁর
পিতা ছিলেন একজন আলিম এবং সুফিগুরু । রুমি স্বয়ং ফিকাহ্, থিয়োলজি, আরবী
এবং পারসিয়ান সাহিত্যে বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন । তাঁরা কোনিয়ায়
শরণার্থী হিসাবে আসেন মঙ্গোলদের কবল থেকে রক্ষা পেতে । রুমির আধ্যাত্মিকতা
সৃষ্টির গৃহহীনতা আর ঐশী উৎস ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিতে
পরিপূর্ণ । মানুষের উপর নেমে আসা সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ভাগ্য হল, বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা অনুভব
না করা, যা নারী বা পুরুষকে ধর্মীয় অনুসন্ধানে তাড়িত করে । আমাদের অবশ্যই নিজের অসম্পূর্ণতা উপলব্ধি করে হবে, বুঝতে হবে যে আমাদের আত্মবোধ
এক মায়া । আমাদের অহম বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে এবং অহমবোধ ও স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দেয়ার ভেতর দিয়ে আমরা আবিস্কার করব যে একমাত্র ঈশ্বরই অস্তিত্ববান ।
রুমি ছিলেন “
মাতাল সুফি” (drunken Sufi ) তাঁর
আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিজীবন বিভিন্ন চরম আবেগের পর্যায়
স্পর্শ করেছে;
নৃত্য, সঙ্গীত , কবিতা এবং গানে পরমানন্দের(ecstacy) অনুসন্ধান করেছেন তিনি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত
ব্যবস্থার সদস্যদের প্রায়ই তাদের অনন্য ঘূর্ণি-নৃত্যের কারণে “ ঘূর্ণায়মান
দরবেশ”
(Whirling Dervishes) বলে অভিহিত করা হয় ; এই নাচ অতিলৌকিকের এক
ঘোরলাগা অবস্থার সৃস্টি করে । রুমি তাঁর স্পষ্ট অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও জীবৎকালে অনুসারীদের কাছে মাওলানাহ্
বা আমাদের প্রভু হিসাবে পরিচিত ছিলেন, আজও
টার্কিতে তাঁর মাওলানাহ্ ব্যবস্থার বিপুল প্রভাব রয়েছে । তাঁর প্রধান
রচনা মাসনাবি (Mathnawi ) সুফি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত । ইবনে আল-আরাবি
যেখানে মনমশীলদের জন্যে লেখালেখি করেছেন, রুমি সেখানে সমগ্র মানব জাতিকে নিজদের উর্ধ্বে ওঠার আহ্বান জানিয়ে, দৈনন্দিন জীবনের
নৈমিত্তিকতাকে ছাড়িয়ে যেতে বলেছেন । মাসনাবি সুফি জীবনধারাকে
বিধি-সম্মত করে তোলে যা যে-কাউকে স্বর্গলোক এবং
আত্মার মাঝে চিরন্তন যুদ্ধে অপরাজেয় বীরে রূপান্তরিত করতে পারে
এবং রুমি ছিলেন এক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শ
।
এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত নতুন সুফি তরিকাহ্ সমূহ মানবজীবনে সীমাহীন সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়েছে । মঙ্গোলরা জাগতিক রাজনীতিতে যা অর্জন করেছিল সুফিগণ সেটাই আধ্যত্মিক
পর্যায়ে অনুভব করতে পারে । চলবে..
সূত্র;-ইসলাম-
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ক্যারেন আর্মস্ট্রং, অনুবদ শওকত হোসেন।
0
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন